নারীসঙ্গম ও তন্ত্রধর্ম
হিন্দু ধর্মের এক বিশেষ “ইডিয়াম” হচ্ছে তান্ত্রিক সাধনা, তান্ত্রিক সাধকদের মধ্যে যাঁরা বামাচারী তাদের নারী সঙ্গমই হচ্ছে সাধনার প্রধান অঙ্গ । কিভাবে ধর্মের সঙ্গে নারী সঙ্গম জড়িত হয়ে পড়েছিল তার বিবরণ নীচে দিচ্ছি।
সকলেরই জানা আছে যে সভ্যতার সূচনা হয়েছিল ভূমিকৰ্ষণ নিয়ে। ভূমিকৰ্ষণই মানুষকে বাধ্য করেছিল স্থায়ী বসবাস স্থাপনে। এই স্থায়ী বসবাস প্ৰথমে গ্রামের রূপ নিয়েছিল, পরে বিকশিত হয়েছিল নগরে ৷ স্থায়ী বসবাস স্থাপনের পূর্বে মানুষ ছিল যাযাবর প্রাণী। কেননা, তখন পশুমাংসই ছিল তার প্রধান খাদ্য । পশুশিকারের জন্য তাকে স্থান থেকে স্থানান্তরে ভ্রমণ করতে হত । পশুশিকার ছিল পুরুষের কর্ম। আর ভূমিকৰ্ষণের সূচনা করেছিল মেয়েরা। পশু শিকারে বেরিয়ে পুরুষের যখন ফিরতে দেরি হত, তখন মেয়ের ক্ষুধার তাড়নায় গাছের ফল (ইভের গাছের ফল খাওয়া তুলনা করুন) এবং ফলাভাবে বন্য অবস্থায় উৎপন্ন খাদ্য শস্য খেয়ে প্ৰাণধারণ করত । তারপর তাদের ভাবনাচিন্তায় স্থান পায় এক কল্পনা । সন্তান উৎপাদনের প্রক্রিয়া তাদের জানাই ছিল। যেহেতু ভূমি বন্য অবস্থায় শস্য উৎপাদন করে, সেইহেতু তারা ভূমিকে মাতৃরূপে কল্পনা করে নেয়। যুক্তির আশ্রয় নিয়ে তারা ভাবতে থাকে পুরুষ যদি নারীরূপ ভূমি (আমাদের সমস্ত ধর্মশাস্ত্ৰেই মেয়েদের ‘ক্ষেত্র’ বা “ভূমি” বলে বর্ণনা করা হয়েছে) কর্ষণ করে সন্তান উৎপাদন করতে পারে, তবে মাতৃরূপ পৃথিবীকে কৰ্ষণ করে শস্য উৎপাদন করা যাবে না কেন ? তখন তারা পুরুষের লিঙ্গস্বরূপ এক ষষ্টি বানিয়ে নিয়ে ভূমি কর্ষণ করতে থাকে ( Przyluski তাঁর “Non-Aryan Loans in Indo Aryans” প্ৰবন্ধে দেখিয়েছেন যে “লিঙ্গ”, “লাঙ্গুল” ও “লাঙ্গল” এই তিনটা শব্দ একই ধাতুরূপ থেকে উৎপন্ন ) । মেয়েরা এইভাবে ভূমিকৰ্ষণ করে শস্য উৎপাদন করল । যখন ফসলে মাঠ ভরে গেল, তখন পুরুষরা তা দেখে অবাক হল। লক্ষ্য করল লিঙ্গপুরী যষ্টি হচ্ছে passive, আর ভূমিরূপী ও তাদের মেয়েরা হচ্ছে active | Active মানেই হচ্ছে শক্তির আধার। ফসল তোলার পর যে প্রথম নবান্ন উৎসব হল সেই উৎসবেই জন্ম নিল লিঙ্গ ও ভূমিরূপী পৃথিবীর পূজা। এ সম্বন্ধে Clodd তার Animism গ্রন্থে বলেছেন :
“In earth worship is to be found the explanation of the mass of rites and ceremonies to ensure fertilisation of the crops and cattle and woman herself.” এ থেকে কিভাবে লিঙ্গ ও শক্তিপূজার উদ্ভব হল, সে সম্বন্ধে বিশদ বিবরণ ও ব্যাখ্যা অবগত হবার জন্য বর্তমান লেখকের “Pre-Aryan Elements in Indian Culture”, Calcutta Review 1931 দেখুন।
।। দুই ।।
এই আদিম ধারণা থেকেই উদ্ভূত হয়েছিল শিব ও শক্তির কল্পনা । এবং এদের উপাসনা নিয়েই উদ্ভূত হয়েছিল তন্ত্রধর্ম। সুতরাং তন্ত্রধর্মটা হচ্ছে মূলত এক অতি প্ৰাচীন ধর্ম, যদিও পরবর্তীকালে এটা বিকশিত হয়েছিল নানারূপে । শিব ও শক্তির আরাধনা মোটেই বৈদিক উপাসনা পদ্ধতির অন্তভুক্ত ছিল না। লিঙ্গ পূজা নবপলীয় যুগ থেকেই হয়ে এসেছে (লেখকের “Beginnings of Linga Cult in India” in Annals of the Bhandarkar Oriental Institute’’ 1929 দ্রষ্টব্য) । আর আদি শিব ও মাতৃকাদেবীর পূজার অজস্র নিদর্শন আমরা প্ৰাগাৰ্য সিন্ধুসভ্যতার কেন্দ্ৰসমূহে পেয়েছি। সিন্ধুসভ্যতা ছিল কৃষিভিত্তিক সভ্যতা । কিন্তু আর্যরা প্ৰথমে কৃষিকৰ্ম জানতেন না । এটা শতপথব্ৰাহ্মণের (২।৩৭-৮ ) এক উক্তি থেকে প্ৰকাশ পায় । সেখানে বলা হয়েছে-“প্রথমতঃ দেবতারা একটি মানুষকে বলিস্বরূপ উৎসর্গ করলেন, তার উৎসর্গীকৃত আত্মা অশ্বদেহে প্ৰবেশ করল। দেবতারা অশ্বকে উৎসর্গ করলেন। উৎসগীকৃত আত্মা অশ্বদেহ হতে পুনরায় বলীবৰ্দে প্ৰবেশ করল। বলীবর্দকে উৎসর্গ করা হলে, ওই আত্মা মেষদেহে প্ৰবিষ্ট হল । মেষ উৎসর্গীকৃত হলে, উহা ছাগদেহে প্রবিষ্ট হল । ছাগ উৎসৰ্গীকৃত হলে, পৃথিবীতে প্ৰবেশ করল । দেবতারা পৃথিবী খনন করে গম ও যাব আকারে ওই আত্মাকে পেলেন । তদবধি সকলে শস্যাদি কর্ষণ দ্বারা পেয়ে থাকে।” শতপথব্রাহ্মণের এই বিবরণটি অত্যন্ত অর্থদ্যোতক । এর মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় লুক্কায়িত আছে আর্যদের কৃষ্টির ইতিহাস। এ থেকে বুঝতে পারা যায় যে আর্যর প্রথমে ভূমিকৰ্ষণ দ্বারা শস্যাদি উৎপাদন করতে জানত না । সুতরাং তাদের মধ্যে তন্ত্রধর্মের প্রচলন ছিল না ।
আমি বহুকাল ধরে বহু জায়গায় বলে এসেছি যে আর্যরা যখন এদেশে আসে, তখন তাদের সঙ্গে মেয়েছেলের সংখ্যা ছিল কম । সেজন্য তারা অনার্য রমণীদের বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিল। ‘গৃহিণী গৃহমুচ্যতে’, এই বচন অনুযায়ী অনার্য রমণী যখন গৃহিণী হয়ে বসলেন, তখন তিনি ধর্ম সম্বন্ধে আৰ্য চিন্তাধারাকে প্ৰভাবান্বিত করলেন । তখনই শিব ও শিবানীর অনুপ্ৰবেশ আর্য দেবতামণ্ডলীতে ঘটল । প্ৰথমেই শিবের কথা ধরুন । বৈদিক রুদ্রদেবতা যে মহেঞ্জোদারোর আদি শিবের প্রতিরূপেই কল্পিত হয়েছিল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই । কেননা ঋগ্বেদে বলা হয়েছে যে রুদ্র সুবর্ণ নির্মিত অলঙ্কার ধারণ করেন, এবং মহেঞ্জোদারোয় আমরা আদি-শিবের যে মূর্তি পেয়েছি, সেখানেও আমরা আদি-শিবকে বাহুতে ও কণ্ঠে অলঙ্কার ধারণ করতে দেখি । বৈদিক রুদ্র যে আর্যদের একজন অর্বাচীন দেবতা ছিলেন, তা বুঝতে পারা যায়। এই থেকে যে, সমগ্ৰ ঋগ্বেদে তাঁর উদ্দেশ্যে মাত্র তিনটি স্তোত্র রচিত হয়েছিল, এবং অগ্নিদেবতার সঙ্গে তাঁর সমীকরণ করা হয়েছিল। আর্যরা যখনই তঁদের দেবতামণ্ডলীতে কোন নূতন দেবতার পত্তন করতেন, তখনই অগ্নির সঙ্গে তাঁর সমীকরণ করে নিতেন । এটা কালী ও করালীর অনুপ্রবেশের সময়ও করা হয়েছিল, অথচ আমরা জানি কালী ও করালী অনার্য দেবতা । এখানে উল্লেখযোগ্য যে সংস্কৃতে ‘রুদ্র’ শব্দের অর্থ হচ্ছে রক্তবর্ণ, এবং দ্রাবিড় ভাষাতেও ‘শিব’ শব্দের মানে হচ্ছে ‘রক্তবর্ণ’ । এছাড়া শতপথ ব্ৰাহ্মণে বলা হয়েছে যে ‘শৰ্ব’ ও ‘ভব’ এই দেবতাদ্বয় প্রাচ্য দেশীয় অসুরগণ ও বাহকগণ কর্তৃক পূজিত হন । কিন্তু বাজসনেয়ী সংহিতায় এ দুটি দেবতা অশনি, পশুপতি, মহাদেব, ঈশান, উগ্ৰদেব প্ৰভৃতির সঙ্গে আর্য দেবতামণ্ডলীতে স্থান পেয়ে অগ্নি দেবতার সঙ্গে সমীকৃত হয়েছেন । অগ্নিদেবতার সঙ্গে সমীকরণের ফলে শেষের দিকের বৈদিক সাহিত্যে আমরা হর, মৃন্দ, শর্ব, ভব, মহাদেব, উগ্র, পশুপতি, শঙ্কর, ঈশান-প্ৰভৃতি দেবতাকে শিবের সঙ্গে অভিন্ন হিসাবে দেখি । বৈদিক রূদ্রাগ্নির উপাসনাই এটাকে সম্ভবপর করেছিল । এ সম্বন্ধে বেরিয়েডেল কীথের একটা মন্তব্য বিশেষ প্ৰণিধানযোগ্য । তিনি বলেছেন- “এ প্রশ্ন মনে উদয় হয় যে বৈদিক যুগের শেষের দিকের রুদ্র দেবতার মধ্যে আমরা একাধিক দেবতার সমন্বয় ও আর্য মানসিকতার ওপর অনার্য প্রভাব পাই কিনা ? এটা নিশ্চয়ই সম্ভবপর যে কতকগুলি অরণ্য, পর্বত ও কৃষি সংক্রান্ত দেবতা বা মৃতাত্মা সম্পকিত দেবতা বৈদিক রুদ্র দেবতার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে শিবরূপে কল্পিত হয়েছিল । পরবর্তী কালের শিবের মধ্যে আমরা কৃষি সম্পকিত অনেক ধ্যান-ধারণা লক্ষ্য করি এবং দেখতে পাই যে শিবের লিঙ্গ পূজা যে ঋগ্বেদে নিন্দিত হয়েছে তা হিন্দুদের মধ্যে যেরূপ জনপ্রিয়, ভারতের আদিবাসিগণের মধ্যেও সেরূপ জনপ্রিয় ” (A.K. Sur. “Pre-Aryan Elements in indian Culture”, Calcutta Review 1931 দ্রষ্টব্য)।