শিবের যৌনজীবনের এক রমণীয় চিত্র আমরা রামেশ্বরের শিবায়ন-এ পাই । রামেশ্বরের শিব একেবারে বাঙলার ঘরের মানুষ । রামেশ্বরের শিবানী দুলের মেয়ে । সুতরাং বিবাহসূত্রে শিবও দু’লে– বাঙলার নিম্নকোটির লোক । বেদের সময় শিব ছিলেন অনার্য দেবতা । এই কাব্যেও শিব হয়েছেন সেকালের বাঙলার ওই ধরনের শ্রেণীর প্ৰতীক । বাঙলার নিম্নকোটির আর পাঁচজন লোকের মত, রামেশ্বরের শিবও নিঃস্ব । ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়া, তার আর কোন উপজীব্য নেই। ভিক্ষায় বেরিয়ে শিব কুচনীপাড়ায় গিয়ে কুচনীদের সঙ্গে প্রেম করে । দিনের শেষে ভিক্ষা করে যা নিয়ে আসে, তুই ছেলে কাৰ্তিক, গণেশ তা খেয়ে ফেলে। কিন্তু কাৰ্তিকের ছয় মুখ আর গজাননের সুবৃহৎ উদার । তাদের ক্ষুধিত উদর কখনই পূর্ণ হয় না। গৃহিণী নিজেও সর্বদা ক্ষুধিতা । উদাসীন স্বামীকে নিয়ে গৌরীর খুবই বিড়ম্বনা । গৌরী স্বামীকে বলেন–‘তোমার এত অভাব । এত অনটন। কোনদিন তোমায় দুটি ভাত দিতে পারি, আবার কোনদিন তা-ও পারি না । তোমার এত দুঃখ আমি দেখতে পারি না । তুমি চাষ কর । তোমার গৃহে অন্নের অভাব হবে না । যেভাবে চাষ করতে হবে, তা আমি বলে দিচ্ছি। পুকুরের ধারে জমি নেবে যাতে জলের অভাবে তুমি পুকুর থেকে জল সেঁচে আনতে পার । ফসল হলে, তুমি নিজের ঘরের ভাত কত সুখে খাবে । আরও, তোমাকে আর সব সময় কেঁদো বাঘের ছাল পরে থাকতে হবে না । তুমি কার্পাসের চাষ করে, তুলা বের কর । তা থেকে তোমার পরবার কাপড়ও তৈরী হবে ।’ এ যেন আত্মভোলা মহাবোধিকে কৰ্মযোগে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে । শিব গৌরীর পরামর্শে চাষী হন। নিজের ত্ৰিশূলের মাথা কেটে লাঙ্গলের ফলা তৈরী করান। ইন্দ্রের কাছ থেকে জমি সংগ্ৰহ করেন, কুবেরের কাছ থেকে ধানের বীজ। আর হলকর্ষণের জন্য নিজের বৃষ তো আছেই। তাছাড়া, যমের কাছ থেকে মহিষও চেয়ে নেন । তারপর রামেশ্বরের ভাষায়— ‘মান্য জান্য মঘবান মহেশের লীলা । মহীতলে মাঘ শেষে মেঘরস দিলা ॥’ এ তো সেই বাঙলার চাষীর মুখে ডাকের বচনেরই প্ৰতিধ্বনি -“ধন্য রাজার পুণ্য দেশ, যদি বর্ষে মাঘের শেষ।’
তারপর শুভদিনে শিব ক্ষেতের কাজ আরম্ভ করলেন । জমি চৌরস করলেন, আল বাঁধলেন। বীজ বপন করলেন । বীজগুলি বেরুল । বর্ষার জল পেয়ে ধানের পাশে আরও নানারকম গাছপালা জন্মাল । তখন শিব নিড়ানের কাজ আরম্ভ করলেন । বর্ষার সঙ্গে জোক মশা মাছির উপদ্রব বাড়ল । কিন্তু তা-বলে তো কাতর হয়ে চাষী চাষ বন্ধ রাখে না । শিবও বিরত হন না । ধানগাছের মূলটুকু ভিজা থাকবে, এমন জল রেখে বাকী জল নালা কেটে, ভাদ্র মাসে ক্ষেত থেকে বের করে দেন। আবার আশ্বিন-কার্তিকে ক্ষেতের জল বাঁধেন । এর মধ্যে ডাক সংক্রান্তি এসে পড়ে । শিব ক্ষেতে নল পুতেন। দেখতে দেখতে সোনালী রঙের ধান দিগন্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। শিবের আনন্দ ধরে না । দেখতে দেখতে পৌষ মাসে ধান কাটার সময় আসে। শাখ বাজিয়ে গৌরী ধান ঘরে তুললেন । সব শেষে রামেশ্বর দিয়েছেন বাঙালী কৃষক গৃহস্থের মত নবান্নে ও পৌষ পার্বণে শিবের দুই ছেলের সঙ্গে ভোজনের এক মধুময় আনন্দচিত্র।
রামেশ্বরের শিবায়নে দেবতারা মানুষ । ব্ৰহ্মার গায়ে গা দিয়ে বসে গোপকন্যা । শিব-গৌরীও কৈলাসের শিব-গৌরী নন । তঁরা বাঙলার কৃষক ও কৃষকগৃহিণী, বাঙালী তার দেবতাদের মানুষ ও মানুষীর রূপ দিয়ে তঁদের আপনজন করে নিয়েছিল । আর পাঁচটা বাঙালী মেয়ের মত গৌরী পুতুল খেলা করে । পুতুলের বিয়ে দেয় নিজের । পুতুলের বিয়েতে নিজের সখীদের বিকল্প ভোজন করায় । অন্য বাঙালী মেয়ের মত গৌরীর বিয়েতেও ঘটকের প্রয়োজন হয় । ভাগনে নারদই মামার বিয়ের ঘটকালী করে । বিয়েতে পালনীয় সব কর্মই অনুষ্ঠিত হয় । এয়োরা আসে, কন্যা সম্প্রদান হয়, যৌতুকও বাদ যায় না । রামেশ্বর এয়োদের যে নামের তালিকা দিয়েছেন তা থেকে আমরা তৎকালীন মেয়েদের নামের নমুনা পাই। তবে অন্যান্য মঙ্গলকাব্যে যেমন কবিরা পতি নিন্দার অবতারণা করেছেন, রামেশ্বর তা করেন নি। তার পরিবর্তে তিনি শাশুড়ীদের মুখ দিয়ে জামাতাদের নিন্দা প্ৰকাশ করেছেন । রামেশ্বরের কাব্যের এই অংশ অত্যন্ত কৌতুকাবহ ।
অন্য কৃষকপত্নীদের মত গৌরীও শিবঠাকুরকে খাবার দিতে মাঠে যায়। গৌরীকে দেখে শিবঠাকুর হাল ছেড়ে দিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করেন—’কি গো খাবার আনতে এত দেরী কেন ?’ গৌরী বলে— ‘ছেলেপুলের সংসার এক হাতে সব করতে গেলে এমনই হবে।’ কথায় কথা বাড়ে। ক্ষুধিত শিব গৌরীর চুল ধরে টানে। এটা অবশ্য রামেশ্বরের শিবায়নে নেই। আছে ওড়িয়া সাহিত্যে । তবে বাঙালী গৃহস্থ ঘরে স্বামী-স্ত্রীর কোন্দলের অনুসরণ করে। রামেশ্বর তার শিবায়নে হর-গৌরীর ঝগড়ার বর্ণনা দিয়েছেন । শিব রাগ করে গৌরীকে বলে–’ক্ষেমা কর ক্ষেমঙ্করি খাব নাঞি ভাত । যাব নাঞিঃ ভিক্ষায় যা করে জগন্নাথ ।’ আবার অন্য সময় শিব আদর করে গৌরীর হাতে শাখাও পরিয়ে দেন ।
রামেশ্বর অপূর্ব বর্ণনা দিয়েছেন গৌরীর স্বামী-পুত্রকে খাওয়ানোর–
‘তিন ব্যক্তি ভোক্তা এক অন্ন দেন সতী ।
দুটি সুতে সপ্তমুখ, পঞ্চমুখ পতি ॥
তিন জনে বার মুখে পাঁচ হাতে খায়।
এই দিতে এল নাঞি হাঁড়ি পানে চায় ॥
সুক্ত খায়্যা ভোক্তা যদি হস্ত দিল শাকে ।
অন্নপূর্ণা অন্ন আন রুদ্রমূর্তি ডাকে ॥
কার্তিক গণেশ বলে অন্ন আন মা ।
হৈমবতী বলে বাছা ধৈৰ্য্য হইয়া খা ॥
ঊল্বন চর্বনে ফির্যা ফুরাইল ব্যঞ্জন ।
এককালে শূন্য থালে ডাকে তিন জন ॥
চটপট পিষিত কর্যা যুষে ।
বাউবেগে বিধুমুখী ব্যস্ত হয়্যা আসে ॥
চঞ্চল চরণেতে নূপুর বাজে আর ।
রিনি রিনি কিঙ্কিনী কঙ্কণ ঝনকার ॥’