শিবকে বাঙালী ঘরের মানুষ করে নিয়েছিল । বাঙালী নিজে ছিল কৃষক। সেজন্য মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে শিবও হয়েছিল কৃষক । এটাই ছিল কবির কাছে ঘরের জামাই শিব সন্মন্ধে স্বাভাবিক কল্পনা !
উর্বর পলি মাটির দেশ বাঙলা ছিল সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা । তার কৃষিসম্পদ ছিল জগৎবিখ্যাত । কৃষি ও কৃষক ছাড়া বাঙালীর কাছে গৌরবের বিষয় আর কিছুই ছিল না । সেজন্য কবিদের কাছে শিব ছিল কৃষক, আর কবিরা ছিলেন কৃষকের কবি ।
শূন্যপুরাণের রামাই পণ্ডিত থেকে শুরু করে শিবায়নের রামেশ্বর পৰ্যন্ত অসংখ্য-কবি শিবের চাষ করার বর্ণনা দিয়ে গেছেন । এ সব কবির মধ্যে ছিলেন–বিনয়লক্ষ্মণ, কবি শঙ্কর, রতিদেব ও রামরাজা, শঙ্কর কবিচন্দ্ৰ চক্রবর্তী, রামকৃষ্ণ রায় দাস, জীবন মৈত্র, সহদেব চক্রবর্তী, দ্বিজ কালিদাস, কবি ষষ্ঠীবর, দ্বিজ ভগীরথী, দ্বিজ নিত্যানন্দ, দ্বিজ রামচন্দ্র রাজ, পৃথ্বীচন্দ্ৰ, কবি কৃষ্ণদাস, প্যারীলাল মুখোপাধ্যায় ও হরিচরণ আচাৰ্য ।
শিব ঠাকুরকে নিয়ে যে কাব্য রচনা করা হত, তাকে ‘শিবায়ন’ বলা হত । অনেকে আবার এগুলিকে শিব-সংকীর্তন বলতেন । যতগুলি শিবায়ন রচিত হয়েছিল তার মধ্যে রামেশ্বরের শিবায়নই প্ৰসিদ্ধ ।
রামেশ্বরের শিব হচ্ছে বাঙালীর নিজস্ব কল্পনা । পৌরাণিক কল্পনা অনুযায়ী শিব মহাদেব । তার মানে শিবের স্থান দেবতাদের পুরোভাগে । কিন্তু গোড়াতে শিব ছিলেন অবৈদিক দেবতা । শুধু অবৈদিক দেবতা নন, তিনি প্রাগ্বৈদিক দেবতা। শিবের প্রতীকের সঙ্গে আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ হয় প্রাগ্বৈদিক সিন্ধু সভ্যতায় । সেখানে আমরা মৃগ, হস্তী, ব্যাঘ্র, গণ্ডার, মহিষ বেষ্টিত যোগাসনে উপবিষ্ট উৰ্দ্ধলিঙ্গ পশুপতি শিবকে এক সীলমোহরের ওপর মুদ্রিত দেখি । তাঁর উপাসকদের মধ্যে ছিল অবৈদিক জাতিগণ–যেমন অসুর, রাক্ষস ইত্যাদি । অসুররাজ বাণ তাঁর পরম ভক্ত ছিল । অনুরূপভাবে লঙ্কেশ্বর রাক্ষসরাজ রাবণও তাঁর পরম ভক্ত ছিল । প্ৰাগাৰ্য বা অনাৰ্য বলেই বৈদিক যাগযজ্ঞে শিবের হবির্ভাগ ছিল না । দক্ষ এই কারণেই তাঁর যজ্ঞে শিবকে আমন্ত্রণ জানান নি । শিব এই যজ্ঞ পণ্ড করবার পরই, শিব আর্যসমাজে স্বীকৃতি লাভ করে । সৃষ্টি, স্থিতি ও ধ্বংসের নিয়ামক হিসাবে দেবাদিদেব শিবের স্বীকৃতি দানে সেদিন সহায়ক হয়েছিলেন বিষ্ণু ।
দক্ষযজ্ঞের পর শিবজায়া সতী হিমালয়-পত্নী মেনকার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন এবং মহাদেবকে পতিরূপে পাবার জন্য কঠোর তপস্যা করেন । তখন মহাদেবও কঠোর তসস্যায় রত ছিলেন। এদিকে তারকাসুরের অত্যাচারে উৎপীড়িত দেবতারা জানতে পারেন যে, মহাদেবের ঔরসে যে পুত্র জন্মাবে সেই পুত্রই তারকাসুরকে বধ করবে। সেজন্য পাৰ্বতী ও মহাদেবের মিলন করাতে এসে কামদেব বা মদন মহাদেবের কোপে ভস্মীভূত হয়। তারপর পাৰ্বতী ও মহাদেবের মিলন হলে মদন পুনর্জীবন লাভ করে। এই মিলনের ফলে কার্তিকের জন্ম হয় । কার্তিককে দেবসেনাপতি করা হয়। কার্তিক তারকাসুরকে বধ করেন । মহাভারতে আছে যে ব্রহ্মা থেকে আরম্ভ করে পিশাচ পর্যন্ত সকলেই মহাদেবকে পূজা করেন। একবার ব্ৰহ্মা মহাদেবকে অসম্মানসূচক কথা বলেছিলেন বলে মহাদেব ব্ৰহ্মার একটি মস্তক কর্তন করেন । সেই থেকে, ব্ৰহ্মা চতুর্মুখ। আগে ব্ৰহ্মার পাঁচ মুখ ছিল। শিবই একটা মুখ কেটে দিয়েছেন।
শিবের নিবাস কৈলাসে। তাঁর তিন স্ত্রী সতী, পাৰ্বতী ও গঙ্গা । দুইপুত্র কার্তিক ও গণেশ। দুই কন্যা লক্ষ্মী ও সরস্বতী। বিষ্ণু শিবের জামাতা । শিবের অনুচরদের মধ্যে আছে নন্দী ও ভৃঙ্গী ।
শিব অত্যন্ত সংযমী দেবতা । আৰ্যদেবতামণ্ডলীর দেবতাগণের মত শিব কামপরায়ণ নয় । ব্রহ্মার আদেশে বিশ্বকর্ম যখন তিলোত্তমা নামে এক অপরূপ সুন্দরী নারী সৃষ্টি করেছিল, তখন তিলোত্তমাকে দেখার জন্য ব্ৰহ্মার চারিদিকে চারিটি মুখ নির্গত হয়েছিল ও ইন্দ্রের সহস্ৰ নয়ন হয়েছিল । একমাত্র শিবই তখন স্থির হয়ে বসেছিলেন । সেইজন্য শিবের আর এক নাম স্থানু ।
গায়ক হিসাবে শিবের সুনাম ছিল। সঙ্গীত বিদ্যায় তিনি নারদকেও পরাহত করেছিলেন । শিবের সঙ্গীতের শ্রোতা ছিলেন। ব্ৰহ্মা ও বিষ্ণু।
মহাদেবের তৃতীয় নেত্ৰ উদ্ভব সম্বন্ধে পুরাণে আছে যে পাৰ্বতী একবার পরিহাসছলে মহাদেবের দুই নেত্রী হস্তদ্বারা আবৃত করেন । তখন সমস্ত পৃথিবী তমসাচ্ছন্ন ও আলোকবিহীন হয়। তাতে পৃথিবীর সব মানুষ বিনষ্ট হবার উপক্রম হয়। পৃথিবীর লোকদের রক্ষা করবার জন্য তিনি ললাটে তৃতীয় নেত্ৰ উদ্ভব করেন ।
ললাটে তৃতীয় নেত্ৰ উদ্ভবের কাহিনী থেকেই আমরা শিবের প্রকৃত স্বরূপের পরিচয় পাই। পৌরাণিক যুগের তিন শ্রেষ্ঠ দেবতা ব্ৰহ্মা, বিষ্ণু ও শিব, এই তিনের মধ্যে শিবই হচ্ছেন সংহারকর্তা । কিন্তু শিব মাত্ৰ সংহারকর্তা নন। সংহারের পর তিনি আবার জীব সৃষ্টি করেন । আমরা আগেই বলেছি যে শিব গোড়াতে সৃজনশক্তিরই দেবতা ছিলেন । সৃজনের জন্য প্রয়োজন হয় প্রজনন । প্রজনন একটা জৈবিক প্রক্রিয়া । এই জৈবিক প্রক্রিয়ার প্রতীক হচ্ছে গৌরীপষ্ট্রের মধ্যে স্থাপিত শিবলিঙ্গ । শিবের এই রূপই হচ্ছে একটা মহান বৈজ্ঞানিক সত্যের প্রকাশ । এর মধ্যে চিত্তবিকারজনিত কোন ব্যাপার নেই।