শিব সংযমী দেবতা
ইন্দ্র থেকে ব্ৰহ্মা-বিষ্ণু পর্যন্ত সকলেই ব্যভিচারী দেবতা । একমাত্র শিবই ব্যভিচারী বা কামুক দেবতা নন । বরং তার কৃতিত্ব হচ্ছে তিনি কামদেবকে ভস্ম করেছিলেন । শিব মহাযোগী। কিন্তু মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে শিব ঘোর সংসারী ।
বাঙলার লোকের কাছে শিব অত্যন্ত জনপ্ৰিয় দেবতা । বাঙলার লোক লিঙ্গরূপেই শিবকে পূজা করে থাকে। এই লিঙ্গরূপে পূজা করার মধ্যেই শিবের আদিম ইতিহাস নিহিত । শিব জৈবিক-সৃজন শক্তিভিত্তিক কৃষি দেবতা । আর্যরা এদেশে আসবার অনেক আগে থেকেই এদেশের লোক শিবের পূজা করত। শিব ও শক্তির পূজা একসঙ্গেই হত । কিভাবে শিবশক্তি পূজার উদ্ভব হল, তার ইতিহাস এখানে সংক্ষেপে বলে নিই।
আদিম মানুষ যখন খাদ্য-আহরণের জন্য পশুশিকারে বেরুত, তখন অনেক সময় তাদের ফিরতে দেরি হত । মেয়েরা তখন ক্ষুধার তাড়নায় গাছের ফল এবং ফলাভাবে বন্য অবস্থায় উৎপন্ন খাদ্যশস্য খেয়ে প্ৰাণ ধারণ করত । তারপর তাদের ভাবনা চিন্তায় স্থান পায় এক কল্পনা । সন্তান উৎপাদনের প্রক্রিয়া তাদের জানাই ছিল। যেহেতু ভূমি বন্য অবস্থায় শস্য উৎপাদন করে, সেই হেতু ভূমিকে তারা মাতৃরূপে কল্পনা করে নেয়। যুক্তির আশ্রয় নিয়ে তারা ভাবতে থাকে। পুরুষ যদি নারীরূপ ভূমি ( আমাদের সমস্ত ধৰ্মশাস্ত্ৰেই মেয়েদের ‘ক্ষেত্র’ বা ভূমি বলে বর্ণনা করা হয়েছে ) কর্ষণ করে সন্তান উৎপাদন করতে পারে, তবে মাতৃরূপ পৃথিবীকে কৰ্ষণ করে শস্য উৎপাদন করা যাবে না কেন ? তখন তারা পুরুষের লিঙ্গস্বরূপ এক যষ্টি বানিয়ে নিয়ে ভূমিকৰ্ষণ করতে থাকে। প্রৎমুলুসকি তাঁর ‘আর্য ভাষায় অনার্য শব্দ’ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে ‘লিঙ্গ’, ‘লাঙ্গুল” ও ‘লাঙ্গল’, এই তিনটা শব্দ একই ধাতুরূপ থেকে উৎপন্ন । মেয়েরা এইভাবে ভূমিকৰ্ষণ করে শস্য উৎপাদন করল । যখন ফসলে মাঠ ভরে গেল, তখন পুরুষরা তা দেখে অবাক হল। চিন্তা করল লিঙ্গরূপী যষ্টি হচ্ছে passive, আর ভূমিরূপী পৃথিবী ও তাদের মেয়েরা হচ্ছে active. Active মানেই হচ্ছে শক্তির আধার । ফসল তোলার পর যে প্ৰথম নবান্ন উৎসব হল সেই উৎসবেই জন্ম নিল লিঙ্গ ও ভূমিরূপী পৃথিবীর পূজা । এই আদিম ধারনা হতেই উদ্ভূত হয়েছিল শিব ও শক্তির কল্পনা । শিব ও শক্তির আরাধনা মোটেই বৈদিক উপাসনা পদ্ধতির অন্তভূক্ত ছিল না। আর্যরা এদেশে আসবার পরে শিব ও শিবানীর অনুপ্ৰবেশ ঘটেছিল আৰ্যদেবতামণ্ডলীতে। তবে শিবানীর অনুপ্রবেশের পূর্বেই শিবের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। তখন আৰ্যর শিবকে রুদ্রের সঙ্গে সমীকরণ করে নিয়েছিল ; মনে হয় অনার্য শিব থেকেই আর্যরা রুদ্রের কল্পনা করেছিল । কেননা সংস্কৃতে ‘রুদ্র’ শব্দের অর্থ হচ্ছে রক্তবর্ণ, এবং দ্রাবিড় ভাষাতেও ‘শিব’ শব্দের মানে হচ্ছে রক্তবর্ণ। বৈদিক রুদ্র যে আর্যদের একজন অর্বাচীন দেবতা ছিলেন, তা বুঝতে পারা যায় এই থেকে যে সমগ্র ঋগ্বেদে তঁর উদ্দেশ্যে মাত্র তিনটি স্তোত্র রচিত হয়েছিল। তাছাড়া, বৈদিক অন্যান্য দেবতাদের অসুরদের সঙ্গে বিরোধিতা করতে দেখা যায় । কিন্তু রুদ্রকে কখনও বিরোধিতা করতে দেখা যায় না । এটা থেকেই প্ৰমাণ হয় যে রুদ্র বা শিব প্ৰথমে অসুরদেরই দেবতা ছিলেন । শতপথব্ৰাহ্মণ ( ১।৭।৩।১১ ) থেকেও আমরা জানতে পারি যে দেবতারা যখন স্বৰ্গে যান, তখন তাদের সঙ্গে শিব ছিলেন না। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে
সমুদ্রমন্থনের যে কাহিনী আছে, সে কাহিনী অনুযায়ীও রুদ্র-শিব অন্য দেবতাদের দলে ছিলেন না ।
।। দুই ।।
রুদ্র-শিব গোড়াতে বৈদিক দেবতামণ্ডলীতে ছিলেন না বলেই, তিনি অন্যান্য বৈদিক দেবতাদের মত কামাসক্ত নন। শিব মহাযোগী। তার মনে কামের ভাব জাগাবার জন্য কামদেবকে পাঠাতে হয়েছিল, কিন্তু মহাদেব কর্তৃক কামদেব ভস্মীভূত হয়েছিল ( মৎস্যপুরাণ অনুযায়ী কামদেব ব্ৰহ্মার হৃদয় হতে উৎপন্ন । কিন্তু ব্ৰহ্মা নিজে তার শরে জর্জরিত হয়ে নিজ কন্যা শতরূপাতে উপগত হওয়ার দরুণ, ব্ৰহ্মা কামদেবের ওপর ক্রুদ্ধ হয়ে অভিশাপ দেন যে, তিনি মহাদেব কর্তৃক ভস্মীভূত হবেন। এখানে আরও উল্লেখনীয় যে বিষ্ণু আৰ্য দেবতা । সেই কারণে আমরা ব্ৰহ্মা ও বিষ্ণু উভয়কেই ব্যভিচারে লিপ্ত হতে দেখি । শিবকে নয় । কোন নারীরই ক্ষমতা ছিল না শিবের রেতঃ ধারণ করবার । এটা আমরা স্কন্দের ( কার্তিকের ) জন্ম বিবরণ থেকে জানতে পারি। শিব লিঙ্গরূপে পূজিত হলেও (শিবের লিঙ্গচ্ছেদের বিবরণ ‘ব্ৰহ্মাণ্ডপুরাণ’-এ আছে) এটাই হচ্ছে শিবের বৈশিষ্ট্য। সেজন্যই যারা শিবের গাজন উৎসবের ব্ৰত পালন করে, তারা সারা চৈত্র মাস সন্ন্যাস গ্ৰহণ করে ও ব্ৰহ্মচৰ্য পালন করে ।
।। তিন ।।
শিবের মত জনপ্রিয় দেবতা বাঙলায় আর দ্বিতীয় নেই। সে জন্যই বাঙালী ধান ভানতেও শিবের গীত গায়। বাঙলায় শিবমন্দিরের যত ছড়াছড়ি এ রকম ভারতের আর কোথাও নেই । আর শিবজায়া শিবানীর উৎসবই হচ্ছে বাঙলার শ্রেষ্ঠ উৎসব।
পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে পর্যন্ত ছোট ছোট বাঙালী মেয়েরা যখন বোশেখ মাসে শিবপূজা করত তখন ওই পূজার ছড়া-মন্ত্রে স্বগতোক্তি করত-‘গৌরী কি ব্ৰত করে ?’ ব্ৰতের শেষে প্রার্থনা করত–’যেন শিবের মত বর পাই ।’ তখন বাঙলার প্রতি মেয়েই কল্পিত হত গৌরী হিসাবে । আর শিব ছিল বাঙালীর কাছে জামাই বিশেষ ।