।। এগার ।।
হিন্দুসমাজে ধর্মানুষ্ঠানের অঙ্গস্বরূপ পরস্ত্রীর সঙ্গে যৌন মিলনের অনুমোদন আছে। তান্ত্রিক সাধনার মূলকথা হচ্ছে প্ৰকৃতি ও পুরুষের মিলন । এই প্ৰকৃতি ও পুরুষের মিলনকে তন্ত্রশাস্ত্রে গুহ্যরূপ দেওয়া হয়েছে। তন্ত্রশাস্ত্ৰে পঞ্চ ‘ম’-কার সহকারে চক্ৰপূজার ব্যবস্থা আছে। পঞ্চ ‘ম’-কার হচ্ছে মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুন। তন্ত্রপূজার এগুলি হচ্ছে অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গ। তন্ত্রে শক্তিসাধনা বা কুলপূজার ওপর বিশেষ করে জোর দেওয়া হয়েছে। কোন স্ত্রীলোককে শক্তির প্রতীক ধরে নিয়ে তার সঙ্গে যৌন মিলনে রত থাকাই তান্ত্রিক সাধনার মূলতত্ত্ব। গুপ্তসংহিতায় বলা হয়েছে যে সে ব্যক্তি পামর যে ব্যক্তি শক্তিসাধনার সময় কোন স্ত্রীলোকের সঙ্গে মৈথুন ক্রিয়ায় নিজেকে না নিযুক্ত রাখে । নিরুক্ততন্ত্র এবং অন্যান্য অনেক তন্ত্রে বলা হয়েছে যে শক্তিসাধক কুলপূজা হতে কোনরূপ পুণ্যফল পায় না, যদি না সে কোন বিবাহিত নারীর সহিত যৌনমিলনে প্ৰবৃত্ত হয় । এ কথাও বলা হয়েছে যে, কুলপূজার জন্য কোন নারী যদি সাময়িকভাবে স্বামীকে পরিহার করে তবে তার কোন পাপ হয় না । সমাজের দৃষ্টিতে যাকে অজাচার বলা হয়, অনেক সময় এটা সে রূপও ধারণ করত। কেননা কুলচুড়মণিতন্ত্রে বলা হয়েছে যে, অন্য রমনী যদি না আসে তা হলো নিজের কন্যা বা কনিষ্ঠ বা জ্যেষ্ঠ ভগিনী, মাতুলানী মাতা বা বিমাতাকে নিয়েও কুলপূজা করবে। ( “অন্যা যদি ন গচ্ছেতু নিজকন্যা নিজানুজা । অগ্রজা মাতুলানী বা মাতা বা তসপত্নীকা। পূর্বাভাবে পরা পূজ্যা মদংশা যোষিতো মতাঃ।। একা চেৎ কুলশাস্ত্ৰজ্ঞ পুজাের্হা তত্র ভৈরব ।।” ) .
অনেক সময় ধর্মের রূপ দিয়ে কামাচারী ব্ৰাহ্মণ পুরোহিতরা বিবাহিতা নারীকে প্ৰলুব্ধ করত, তাদের সতীত্ত্ব বিসর্জন দিত । এরূপভাবে প্ৰলুব্ধ হয়ে সতীত্ব বিসর্জন দেবার এক কাহিনী অষ্টাদশ শতাব্দীর পর্যটক আবে দুবোয়া তার গ্রন্থে বিবৃত করে গেছেন । তিনি বলেছেন যে দক্ষিণ ভারতে এমন কতকগুলি মন্দির আছে যেখানকার পুরোহিতগণ প্রচার করে যে আরাধ্য দেবতার অত্যাশ্চর্য শক্তি আছে স্ত্রীলোকের বন্ধ্যতা দূর করবার। এরূপ মন্দিরের মধ্যে কর্নাটক দেশের তিরুপতির মন্দির বিশেষভাবে প্ৰসিদ্ধ । এখানকার দেবতা ভেন কাটেশ্বরের কাছে অসংখ্য স্ত্রীলোক আসে সন্তান কামনায় । পুরোহিতগণ কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে তারা মন্দিরে রাত্রি যাপন করে। পুরোহিতগণ তাদের বলে যে তাদের ভক্তিদ্বারা গ্ৰীত হয়ে ভেনকাটেশ্বর রাত্রিকালে তাদের কাছে আসবে এবং তাদের গর্ভবতী করে দিয়ে যাবে। তারপর যা ঘটতে, তা না বলাই ভাল। পাঠক তা সহজেই অনুমান করে নিতে পারেন । পরদিন প্ৰভাতে এই সকল জঘন্য চরিত্রের ভণ্ড তপস্বীরা কিছুই জানে না। এরূপ ভান করে ওই সকল স্ত্রীলোকের কাছে এসে দেবতার করুণা লাভ করেছে বলে তাদের পুন্যবতী আখ্যা দিয়ে তাদের কাছ থেকে দান গ্ৰহণ করত । দেবতার সঙ্গে তাদের যৌন মিলন ঘটেছে, এই আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে এই সকল হতভাগিনী নারীরা নিজ নিজ গৃহে ফিরে যেত ।
ধর্মানুষ্ঠানের নামে বিবাহিতা মেয়ের সতীত্ব সর্বপ্রথম নাশ করবার অধিকার কুলগুরুদের বাঙলা দেশেও ছিল । একে ‘গুরুপ্রসাদী’ বলা হত। এ প্রথা ইংলণ্ড ও স্কটল্যাণ্ডেও ছিল । এ প্রথাকে বলা হত – ‘Jus prima noctis,’ উনবিংশ শতাব্দীতে বাঙলাদেশে এই প্রথার কি ভাবে অবলুপ্তি ঘটেছিল, তার একটা সজীব চিত্র হুতোম তাঁর নকশায় দিয়েছেন । তিনি লিখছেন — চক্রবর্তীদের জামাই হরহরি বাবু সেই যে বিয়ের সময় স্ত্রীকে দেখেছিলেন আর দেখেন নি। পাঁচ বৎসর পর তিনি শ্বশুরবাড়ী এসেছেন । এবার হুতোমের ভাষায় বর্ণনাটা শুনুন । এদিকে চক্রবর্তী বাড়ীর গিন্নীরা পরস্পর বলাবলি করতে লাগল যে, ‘তাই তো গা ! জামাই এসেছেন, মেয়েও ষেটের কোলে বছর পনেরো হল, এখন প্ৰভুকে খবর দেওয়া আবশ্যক’। সুতরাং চক্রবর্তী পাঁজি দেখে উত্তম দিন স্থির করে প্রভুর বাড়ি খবর দিলে, প্ৰভু তুরী, খন্তি ও খোল নিয়ে উপস্থিত হলেন। গুরুপ্ৰসাদীর আয়োজন হতে লাগল।…চক্রবর্তীর বাড়ীর ভিতর বড় ধুম । গোস্বামী বরের সজ্জা করে জামাইবাবুর শোবার ঘরে শুলেন । হরহরিবাবুর স্ত্রী নানালঙ্কার পরে ঘরে ঢুকলেন । মেয়েরা ঘরের কপাট ঠেলে দিয়ে ফাঁক থেকে আড়ি পেতে উঁকি মারতে লাগল।…হরহরিবাবু একগাছি রুল নিয়ে গোস্বামীর ঘরে শোবার পূর্বেই খাটের নীচে লুকিয়ে ছিলেন ; এক্ষণে দেখলেন যে স্ত্রী ঘরে ঢুকে গোস্বামীকে একটা প্ৰণাম করে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগল। প্ৰভু খাট থেকে উঠে স্ত্রীর হাত ধরে অনেক বুঝিয়ে শেষে বিছানায় নিয়ে গেলেন । কন্যাটি কি করে । বংশপরম্পরানুগত ধর্মের অন্যথা করলে মহাপাপ–এটি চিত্তগত আছে, সুতরাং আর কোন আপত্তি করল না–সুড়সুড়ি করে প্রভুর বিছানায় গিয়ে শুলে। প্ৰভু কন্যার গায়ে হাত দিয়ে বল্লেন, ‘ব’ল, আমি রাধা তুমি শ্যাম’ । কন্যাটিও অনুমতি মত ‘আমি রাধা, তুমি শ্যাম’, তিনবার বলেছে এমন সময় হরহরিবাবু আর থাকতে পারলেন না, খাটের নীচে থেকে বেরিয়ে এসে এই ‘কাঁধে বাড়ি বলরাম’ বলে গোস্বামীকে রুলসই করতে লাগলেন । এই ঘটনায় প্রভুরা ভীত হলে সমাজে গুরুপ্রসাদী উঠে গেল। খরতাল বাজাবে ; গোস্বামীর রুল সইয়ের চিৎকারে তার হরিধ্বনি ভেবে দেদার খোল বাজাতে লাগল, মেয়ের উলু দিতে লাগল, কাঁসির ঘণ্টা শাকের শব্দে হুলস্থল পড়ে গেল। হরহরিবাবু হঠাৎ দরজা খুলে ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়ে, একেবারে থানার দারোগার কাছে গিয়ে সমস্ত কথা ভেঙ্গে বলল। এদিকে সকলে ঘরে গিয়ে দ্যাখে যে গোস্বামীর দাঁতে কপাটি লেগে গ্যাছে, অজ্ঞান অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছেন, বিছানায় রক্তের নদী বইছে। সেই অবধি গুরুপ্ৰসাদী উঠে গ্যালো, লোকেরও চৈতন্য হলো ; প্রভুরাও ভয় পেলেন।