।। আট ।।
অজাচারেরই সহােদর ভাই হচ্ছে ব্যভিচার । তবে ব্যভিচারের অর্থ অজাচারের চেয়ে অনেক ব্যাপক। ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মধ্যে সমাজের বিধান-বহির্ভুত যৌন-সংসর্গ ঘটলেই সেটাকে অজাচার বলা হয়। এরূপ আত্মীয়ের মধ্যে যৌন মিলন স্থাপনের পক্ষে সমাজের যদি কোন বিধান না থাকে, তা হলে সেটা ব্যভিচারও বটে। নিজ স্বামী বা স্ত্রী ব্যতীত অপরের সঙ্গে যৌন সংসৰ্গ ঘটলেই সাধারণত তাকে ব্যভিচার বলা হয়। সে পুরুষ বা নারী নিজ ঘনিষ্ঠ, আত্মীয়ও হতে পারে, বা অপর কেউও হতে পারে। তবে অপর পুরুষের সঙ্গে যৌন-সংসর্গ সমাজ অনেক সময় ব্যভিচার বলে গণ্য করে না । যেমন প্ৰাচীন কালের নিয়োগ প্ৰথা, অতিথি সৎকারের জন্য স্ত্রীকে সমৰ্পণ করা, ধমীয় সংস্কার ও ধর্মীয় লাম্পট্য, বা বর্তমানকালে ওড়িষ্যায় জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মৃত্যুর পর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার স্ত্রীকে যৌন-সংসর্গের জন্য গ্ৰহণ করা ।
নিয়োগ প্ৰথা সুবিদিত। তবে নিয়োগ প্ৰথা সম্বন্ধে এখানে দুএকটা কথা বলা প্ৰয়োজন । নিয়োগ প্ৰথায় যে যৌন অধিকার থাকত তা সাধারণ রমণের অধিকার নয় । মাত্র সন্তান উৎপাদনের অধিকার । সন্তান উৎপন্ন হবার পর এ অধিকার আর থাকত না | শাস্ত্র অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির ভ্ৰাতা বা কোন নিকট আত্মীয়, বিশেষ করে সপিণ্ড বা সগোত্রকেই এই উদ্দেশ্যে নিযুক্ত করা হত। নিয়োগ প্ৰথা অনুযায়ী মাত্র এক বা দুটি সন্তান উৎপন্ন করা হোত, তার অধিক নয়। শাস্ত্ৰে বলা হয়েছে যে সন্তান প্রজননের সময় উভয়ে নিজ নিজ চিত্তবৃত্তিকে এমনভাবে উন্নীত করবে যে পরস্পর পরস্পরকে শ্বশুর ও পুত্রবধু বিবেচনা করবে। ( উপমাটা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়) । সমাজের দৃষ্টিতে কোনটা অজাচার, আর কোনটা অজাচার নয়। সে সম্পর্কে এখানে স্মরণ রাখতে হবে যে এই উদ্দেশ্যে কেবলমাত্র কোন আত্মীয়কেই আহবান করা যেত, অপরকে নয়। স্মৃতিযুগের শেষের দিকে কিন্তু নিয়োগ প্রথা পরিত্যক্ত হয়েছিল। বৃহস্পতি বলেছেন কলিযুগে ‘নিয়োগ’ প্ৰথা যুক্তিযুক্ত নয়। মনু যদিও তার ধর্মশাস্ত্রের এক অংশে এর অনুমোদন করেছেন, অপর অংশে তিনি এই প্ৰথাকে সম্পূর্ণভাবে গৰ্হিত ঘোষণা করেছেন ।
।। নয় ।।
পরবর্তীকালের সমাজে পতিব্ৰতা স্ত্রীর যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল, সে সংজ্ঞা অনুযায়ী আগেকার যুগের সমাজের যৌনপ্ৰথাগুলি যে অজাচার বা ব্যভিচার ছিল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু প্ৰাচীনকালের সমাজে এগুলি অজাচার বা ব্যভিচার বলে গণ্য হত না । সেজন্যই অতিথির সঙ্গে সঙ্গমে রত হওয়া, সে যুগে ব্যভিচার বলে গণ্য হত না। মহাভারতের অনুশাসন পর্বে বর্ণিত সুদৰ্শন ও ওঘাবতী কাহিনী এ সম্বন্ধে বিশেষ আলোকপাত করে। এই কাহিনী অনুযায়ী সুদৰ্শন অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ ছিলেন। তিনি গৃহস্থাশ্রম পালন করেই মৃত্যুকে জয় করবেন। সংকল্প করেছিলেন । স্ত্রী ওঘাবতীকে অতিথি সৎকার কাজে নিয়োজিত করে তিনি তাকে আদেশ দেন যে প্ৰয়োজন হলে ওঘাবতী যেন নির্বিচারে নিজেকেও অতিথির কাছে সমৰ্পণ করে । কেননা, অতিথি অপেক্ষা শ্ৰেষ্ঠ ব্যক্তি আর কেউ নেই। একদিন তার আদেশের সততা পরীক্ষা করবার জন্য তাঁর অনুপস্থিতকালে যমরাজ স্বয়ং ব্ৰাহ্মণবেশে সেখানে উপস্থিত হয়ে ওঘাবতীর সঙ্গে সঙ্গম প্রার্থনা করেন। ওঘাবতী তার সঙ্গে যৌন মিলনে প্ৰবৃত্ত হয়। এই সময় সুদৰ্শন ঘরে ফিরে এসে। স্ত্রীকে সামনে দেখতে না পেয়ে তাকে বারবার ডাকতে থাকেন । কিন্তু কোন উত্তর পেলেন না । কেননা ওঘাবতী তখন ব্ৰাহ্মণের সঙ্গে যৌনমিলনে নিযুক্ত থাকায় নিজেকে অশুচি জ্ঞান করে স্বামীর আহবানে সাড়া দেন নি । এমন সময় অতিথি ব্ৰাহ্মণ ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে সুদৰ্শনকে বলেন যে ওঘাবতী তার কামনা পূর্ণ করেছে। ওঘাবতীর অতিথিপরায়ণতা দেখে সুদৰ্শন অত্যন্ত প্ৰীত হন । ধর্ম তখন আত্মপ্ৰকাশ করে বলে –‘সুদৰ্শন তুমি তোমার সততার জন্য এখন থেকে মৃত্যুকে জয় করলে ।’
মহাভারতের আদিপর্বে বর্ণিত উদ্দালক-শ্বেতকেতু কাহিনী থেকেও আমরা প্ৰাচীন ভারতে অতিথির সঙ্গে যৌন মিলনের নিদর্শন পাই। ওই কাহিনীর মধ্যে উদ্দালক বলেছিলেন–‘স্ত্রীলোক গাভীদের মত স্বাধীন। সহস্র পুরুষে আসক্ত হলেও তাদের অধৰ্ম হয় না–এটাই সনাতন ধর্ম ।’
।। দশ ।।
স্ত্রীকে অপরের হাতে সমর্পণ করা যে প্রাচীনকালে হিন্দু সমাজেই প্ৰচলিত ছিল, তা নয় । বর্তমানকালে আদিবাসী সমাজেও কোথাও কোথাও এ প্ৰথা প্ৰচলিত আছে । যেমন মধ্যপ্রদেশের সাথিয়া উপজাতির মধ্যে কোনও চুক্তির শর্ত হিসাবে বা ঋণের জামিন স্বরূপ উত্তমর্ণের কাছে নিজের স্ত্রী, কন্যা বা অপর কোন আত্মীয়াকে বন্ধক, রাখা যায়। ঋণ পরিশোধ বা চুক্তির শর্ত প্ৰতিপালন না হওয়া পর্যন্ত ওই স্ত্রী বা কন্যা পাওনাদারের গৃহে থাকে । বন্ধকী অস্থাবর সম্পত্তি ভোগদখল করবার যেমন উত্তমর্ণের অধিকার থাকে, এক্ষেত্রে ওই বন্ধকী স্ত্রী বা কন্যাকে উপভোগ করবার সম্পূর্ণ অধিকারও পাওনাদারের থাকে । এই অবস্থায় ওই পাওনাদারের স্ত্রী বা কন্যাকে উপভোগ করবার সম্পূর্ণ অধিকারও পাওনাদারদের থাকে । এই অবস্থায় ওই পাওনাদারের গৃহে স্ত্রী বা কন্যা যদি সন্তানবতী হয়, তা হলে সে নিজগৃহে পুনরায় ফিরে আসবার সময় ওই সন্তানকে পাওনাদারের গৃহে রেখে আসে। (তুলনা করুন তারা বৃহস্পতির গৃহে ফিরে অন্যাসবার আগে চন্দ্রের ঔরসে জাত সন্তানকে চন্দ্রের গৃহে রেখে এসেছিল ) । সাথিয়ারা স্ত্রী বা কন্যাকে বন্ধক রাখা মোটেই লজ্জাজনক বা নীতিবিগহিত ব্যাপার বলে মনে করে না।