।। পাঁচ ।।
আদিবাসী সমাজেও অনেক রকম বিবাহ প্ৰথা আছে, যা হিন্দু সমাজের দৃষ্টিতে অজাচার বলে গণ্য হবে। দুটি বিশেষ ধরনের বিবাহ প্রথা উত্তর-পূর্ব সীমান্তের আদিবাসী সমাজে প্রচলিত আছে। আসামের গারো জাতির লোকেরা বিধবা শ্বাশুড়ীকে বিবাহ করে, আর লাখের, বাগনী ও ডাফল জাতির লোকেরা বিধবা বিমাতাকে বিবাহ করে । শ্বাশুড়ীকে কিংবা বিমাতাকে বিবাহ করা এদের কাছে অজাচার নয়। আগেই বলেছি যে সমাজই বিধান দেয়, কোনটা অজাচার, আর কোনটা অজাচার নয় । গারোদের কথাই ধরা যাক । গারোরা যখন শ্বাশুড়ীকে বিয়ে করে, তখন সেটা অজাচার নয় । কিন্তু গারোদের উপশাখা সাঙমারা যদি কোন সাঙমা উপশাখার মেয়েকে বিয়ে করে, তাহলে সেটা অজাচার । তখন তাকে মাডোঙ বলা হয় । ‘মাডোঙ’ মানে ‘যে লোক নিজের মাকে বিয়ে করে ।’ তবে শ্বাশুড়ীকে বিয়ে করা, মাত্র গারো সমাজেই প্রচলিত প্রথা নয় । অন্যত্রও এর প্ৰচলন আছে। মধ্য ব্ৰেজিলের টুপি-কোওয়াহিব জাতির লোকেরা একসঙ্গেই শ্বাশুড়ী ও তার মেয়েকে বিয়ে করে ।
আমরা আগেই বলেছি যে লাখের, বাগনী ও ডাফলাজাতির লোকেরা বিমাতাকে বিয়ে করে । এরূপ বিবাহের জন্য বাগনীজাতির বৃদ্ধ পিতারা যখন দ্বিতীয়বার বিবাহ করে তখন বিশেষভাবে অধিক যুবতী মেয়েদের নির্বাচন করে বিবাহ করে, যাতে তার মৃত্যুর পর তার পুত্র যুবতী বিমাতাকেই স্ত্রীরূপে লাভ করতে পারে ।
মা-মাসীকে বিয়ে করাটা যে একেবারে অজাচার এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই । অথচ, এর বিপরীত প্ৰথাটা তো দক্ষিণ ভারতের কিছু সমাজেই প্ৰচলিত আছে। মাতুলের কাছে ভাগ্নী তো কন্যাসম, এবং ভাগ্নীর কাছে মাতুল তো পিতাসম অথচ মামা-ভাগ্নীর মধ্যে বিবাহটািই হচ্ছে সেখানে বাঞ্ছনীয় বিবাহ। তবে একটা কথা এখানে বলা প্রয়োজন । গারোদের মধ্যে পিতার মৃত্যুর পর পুত্র যাতে যুবতী বিমাতাকে স্ত্রীরূপে পায়, তার জন্য গারো পিতার কমবয়সী মেয়েদেরই দ্বিতীয় স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করে। কিন্তু দক্ষিণ ভারতের হিন্দু সমাজে যেখানে বাঞ্ছনীয় বিবাহ প্রচলিত আছে, সেখানে অনেক সময়ই দেখা যায় যে বাঞ্ছনীয় কন্যা বরের মাতার বয়সী । সেজন্য এরূপ বিবাহে বর ও কনের বয়সের মধ্যে যত বছরের তফাৎ, বিবাহের সময় কনেকে ততগুলো নারিকেল কোমরে বেঁধে নিয়ে বিবাহ করতে হয় ।
।। ছয় ।।
পিতা-পুত্রীর বা মাতা-পুত্রের মধ্যে যৌনমিলনের কথা দেশবিদেশের পুরাণেও বিবৃত আছে। আমাদের পুরাণ অনুযায়ী ব্রহ্মা নিজ কন্যা শতরূপাকেই বিবাহ করেছিলেন । এদের সঙ্গমের ফলে মনুর জন্ম হয়। মনু থেকে পৃথিবীতে মানবজাতির সৃষ্টি হয় । সুতরাং মানুষের রক্তের মধ্যেই অজাচারের বীজ গোড়া থেকে আছে ।
মাতা-পুত্রের মধ্যে যৌনমিলনের ক্লাসিক দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় গ্ৰীক পুরাণে-জোকাষ্টা ও ইডিপাসের কাহিনীতে । এই কাহিনী অনুযায়ী থিবসের রাজা ইডিপাস। তাঁর নিজ গৰ্ভধারিনী মাতাকেই বিবাহ করেছিল, এদের দুজনের মধ্যে সঙ্গমের ফলে দুই পুত্র পলিওনিসেন ও ইটিওক্লিস ও তুই কন্যা অ্যানটিগনি ও ইসমিন জন্মগ্রহণ করে ।
এরূপ সঙ্গম যে দেবসমাজে অনিন্দনীয় ছিল, তা অর্জুনের প্রতি উর্বশীর উক্তি থেকে প্রকাশ পায় ।
।। সাত ।।
উপরি-উক্ত কাহিনীসমূহ থেকে বোঝা যায় যে মনুষ্যসমাজে অজাচারের অন্ত নেই। এবার আমি অজাচারের একটা সংজ্ঞা দিতে চাই। পাত্র-পাত্রী এই উভয়ের মধ্যে যেখানে রক্তের সম্পর্ক আছে, সেখানে যদি যৌনমিলন ঘটে, তাহলে সেটাই অজাচার । কিন্তু যেখানে রক্তের সম্পর্ক আছে, সেখানে গোপন যৌনমিলন তো আখচারই ঘটে ।
এক কথায়, যেখানে রক্তের সম্পর্ক আছে, সেখানে ওটা অজাচার । আর যেখানে রক্তের সম্পর্ক নেই, সেখানে ওটা ব্যভিচার । কিন্তু এরূপ সম্পর্ক যদি সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত হয়, তাহলে এটা অজাচার নয়। উত্তর ভারতে হিন্দুদের মধ্যে অজাচার পরিহার করবার জন্য যে সকল সামাজিক বিধি নিষেধ আছে, সেগুলো হচ্ছে- গোত্রভেদ, প্রবরভেদ ও সপিণ্ডবিধান। শেষোক্ত বিধান অনুযায়ী পিতৃকুলে ও মাতৃকুলে চার পুরুষ পরিহার করতে হয়। দক্ষিণ ভারতের হিন্দুদের মধ্যেও গোত্ৰ-প্রবর বিধিনিষেধ আছে, কিন্তু সপিণ্ডবিধান যথেষ্ট শিথিল । এ রকম শিথিলতা আমরা আদিবাসী সমাজেও লক্ষ্য করি । যেমন গারোদের মধ্যে আমরা দেখেছি যে বিমাতাকে বিয়ে করা অজাচার নয়, কিন্তু নিজ গভর্ধারিণী মাতা বা একই উপশাখার মধ্যে অন্য মেয়েকে বিয়ে করা অজাচার। অজাচার সম্বন্ধে এসব বিচিত্র রীতি যে মাত্র হিন্দু বা আদিবাসী সমাজেই প্ৰচলিত, তা নয়। প্ৰাচীন মিশর ও ইনকা রাজপরিবারসমূহে এর প্রচলন ছিল । পৃথিবীর অন্যান্য দেশসমূহেও তাই । ইংলেণ্ডের কথাই ধরুন । ইংলেণ্ডে অজাচার বলে কিছু ছিল না, যতক্ষণ না, তা যাজকীয় আদালতসমূহের দৃষ্টির মধ্যে আসত। কিন্তু ১৯০৮ খ্ৰীষ্টাব্দে ‘ইনসেষ্ট অ্যাক্ট ১৯০৮’ প্ৰণীত হবার পর থেকে, অপরাধ হিসাবে অজাচার সাধারণ আদালতের বিচারাধীন হয়েছে । ১৯০৮ খ্ৰীষ্টাব্দের এই আইন অনুযায়ী যদি কোন পুরুষ তার নাতনী, মেয়ে, বোন বা মায়ের সঙ্গে যৌন সংসৰ্গ করে, তবে তা অজাচার বলে গণ্য হয় ও তার জন্য তাকে দণ্ড পেতে হয় । যে মেয়ের সঙ্গে সে যৌন সংসর্গে লিপ্ত হয়েছে তার সম্মতি থাকলেও সেটা অজাচার এবং ওই মেয়েকেও অনুরূপ দণ্ড পেতে হয় । এই আইন অনুযায়ী ভাই-বোন বলতে যে নিজের সহোদর-সহোদরাকে বুঝায় তা নয়। যে কোন রকমের ভাই-বোন হলেই, সেটা অজাচার । এই আইন অনুযায়ী পিতার পূর্ববর্তী স্ত্রীর পুত্র ও কন্যা, বা মাতার পূর্ববর্তী স্বামীর পুত্র ও কন্যাও দণ্ডনীয় অজাচারের অন্তভূক্ত ভাই-বোন । এই আইনের দিক থেকে যেটা লক্ষণীয়, তা হচ্ছে এখানে বিবাহের কথা বলা হয় নি, যৌন সংসর্গের কথাই বলা হয়েছে । এ সম্বন্ধে বিলাতের আইনের মধ্যে এক সূক্ষ্মতা আছে । যেমন শ্যালিকাকে বিবাহ করা যায়, কিন্তু শ্যালিকার সঙ্গে ‘যৌন সংসৰ্গ’ স্থাপন করা অজাচার। স্যার জেমস ফ্রেজারের আমল থেকে আজ পর্যন্ত নৃতত্ত্ববিদ ও সমাজতত্ত্ববিদগণ ‘অজাচার’ সম্বন্ধে ধ্যান-ধারণার নানা কারণ নির্দেশ করেছেন । কিন্তু আজ পর্যন্ত এর কোন সর্ববাদী-সম্মত মতবাদ উদ্ভূত হয় নি। মোট কথা, সমাজ যেটাকে অজাচার মনে করে, সেটাই অজাচার, আর যেটাকে অজাচার বলে গণ্য করে না, সেটা অজাচার নয় ।