বৌদ্ধ সাহিত্যের আর এক কাহিনীতে (অশ্বতথ সুত্ত ১৷১৬ ; কুনাল জাতিক ৫৩৬) শাক্যরা ছিল পাঁচ বােন ও চার ভাই। এই কাহিনী অনুযায়ী জ্যেষ্ঠ ভগিনীকে তারা মাতৃরূপে বরণ করে, আর চার ভাই চার বোনকে বিবাহ করে ।
বৌদ্ধ সাহিত্যের আর এক কাহিনী পড়ুন। বুদ্ধঘোষের ‘পরমথজ্যোতিকা,’ ( ক্ষুদ্দকপথ পৃঃ ১৫৮-৬০ ) কাহিনী অনুযায়ী বারানসীর রাজার প্রধান মহিষী একখণ্ড মাংসপিণ্ড প্রসব করেন । তিনি ওই মাংসপিণ্ডটিকে একটি পেটিকায় করে নদীতে ভাসিয়ে দেন । ওটা যখন ভেসে যাচ্ছিল, তখন একজন মুনি ওটাকে তুলে সংরক্ষণ করেন। পরে ওই মাংসপিণ্ড থেকে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে উৎপন্ন হয়। তাদের নাম লিচ্ছবী দেওয়া হয় । এদের দুজনের মধ্যে বিবাহ হয়, এবং এরা বৈশালী রাজ্য স্থাপন করে ।
আবার দশরথজাতক অনুযায়ী পূর্বকালে বারানসীর রাজা দশরথের প্রধান মহিষীর গর্ভে তিন সন্তান জন্মায়–রামপণ্ডিত, লক্ষণকুমার ও সীতাদেবী। ওই মহিষীর মৃত্যুর পর দশরথ অপর একজনকে প্রধান মহিষী করেন । তার গর্ভে ভরত নামে এক সন্তানের জন্ম হয় । দশরথ একবার ভারতের মাকে একটা বর দিয়েছিলেন । সেই বরের জোরে ভরতের মা ভরতকে রাজা করতে হবে বলে দাবী করেন । তখন দশরথ রাম ও লক্ষণকে দুরান্তরে গিয়ে থাকতে বলেন, এবং বলেন যে বারো বছর পরে তাঁর মৃত্যু ঘটলে রাম যেন ফিরে এসে রাজ্যভার গ্ৰহণ করে । রাজার এই কথায় রাম ও লক্ষণ সীতাকে নিয়ে হিমালয় প্রদেশে চলে যান । এর নয় বৎসর পরে দশরথের মৃত্যু ঘটে । তখন ভরত রামকে ফিরিয়ে আনতে যায় । কিন্তু বারো বৎসর পূর্ণ হবার আগে রাম ফিরতে চাইলেন না । বারো বৎসর উত্তীর্ণ হলে, রাম বারানসীতে ফিরে এসে রাজা হন ও সীতাকে বিবাহ করে তাঁর মহিষী করেন ।
সহোদরাকে বিবাহ করার কাহিনীসমূহ যে মাত্র বৌদ্ধ সাহিত্যে আছে, তা নয়। অন্যান্য সাহিত্যেও আছে। অন্যান্য সাহিত্যে যে সব প্ৰমাণ আছে, তা থেকে মনে হয় যে প্ৰাচ্যভারতে সহোদরার অভাবে অন্য বোনকেও বিবাহ করা যেত । অৰ্দ্ধমাগধী ভাষায় রচিত জৈন্য সাহিত্যে এরূপ বিবাহের উল্লেখ আছে যেমন নন্দিতা বিবাহ করেছিল, তার মাতুলকন্যা রেবতীকে ।
আমি আমার ‘ভারতের বিবাহের ইতিহাস’ গ্রন্থে দেখিয়েছি যে ( দশরথজাতকে বিবৃত ) মাত্র রামই নিজ ভগিনীকে বিবাহ করেন নি, রামের পিতা দশরথও তাই করেছিলেন । দশরথের সঙ্গে কৌশল্যার বিবাহই তার দৃষ্টান্ত । দশরথ কৌশল বংশের নৃপতি ছিলেন । কৌশল্যাও যে সেই বংশেরই মেয়ে ছিলেন, তা তার নাম থেকেই প্ৰকাশ পাচ্ছে । ( তুলনা করুন গান্ধারী, মাদ্রী, কৈকেয়ী, বৈদেহী, কুন্তী, দ্ৰৌপদী ইত্যাদি ) । সুতরাং নিজ বংশেই যে রাজা দশরথ বিবাহ করেছিলেন, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই । আজকালিকার দৃষ্টিভঙ্গীতে ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহ, অজাচার বলে গণ্য হবে । কিন্তু উত্তর ভারতের পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলে ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহ যে এক সময় প্ৰচলিত প্ৰথা ছিল এবং তার সামাজিক স্বীকৃতিও ছিল, তা উপরের কাহিনীসমূহ থেকে প্ৰকাশ পায় ।
।। চার ।।
এইবার প্রাচীন কাল ছেড়ে দিয়ে, বর্তমান কালে আসুন । বর্তমানে উত্তর ভারতের বিবাহ গোত্ৰ-প্ৰবর ও সপিণ্ড বিধিদ্বারা নিয়ন্ত্রিত । তার মানে বিবাহে নিজ গোত্র-প্ৰবর ও সপিণ্ড পরিহার্য । কিন্তু এর শিথিলতা আমরা দক্ষিণ ভারতে লক্ষ্য করি । সেখানে মামা-ভগ্নীর মধ্যে বা মামাতো বোন কিংবা পিসতুতো বোনের সঙ্গে বিবাহই বাঞ্ছনীয় বিবাহ । তবে যেখানে মামা-ভাগ্নীর মধ্যে বিবাহ ( যেমন তামিলনাড়ুতে ) প্ৰচলিত আছে, সেখানে এরূপ বিবাহ সম্বন্ধে একটা বিশেষ বিধি নিষেধ লক্ষ্য করা যায়। সেখানে বিবাহ মাত্র বড় বোনের মেয়ের সঙ্গেই হয় । ছোট বোনের মেয়ের সঙ্গে হয় না । মারাঠা দেশে এরূপ বিবাহ মাত্র পিতৃকেন্দ্ৰিক জাতিসমূহের মধ্যেই দেখা যায়। মাতৃকেন্দ্ৰিক জাতিসমূহের মধ্যে এটা নিষিদ্ধ। সে যাই হোক, উত্তর ভারতের দৃষ্টিভঙ্গীতে এটা অজাচার, কেননা মাতুল পিতারই সমপর্যায়ের লোক ।
ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহ মাত্র পিসতুতো বোন ও মামাতো বোনের সঙ্গেই হয় । তার মানে এক ক্ষেত্রে বিবাহ হয় মামাতো ভায়ের সঙ্গে, আর অপর ক্ষেত্রে বিবাহ হয় মামাতো বোনের সঙ্গে । মাসতুতো বোনের সঙ্গে বিবাহ যদিও দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতে সাধারণভাবে নিষিদ্ধ, তথাপি এর প্রচলন দেখতে পাওয়া যায় অন্ধ্রপ্রদেশের কোমতি ও কুরুর জাতিদ্বয়ের মধ্যে । তার মানে এদের সমাজে মাসতুতো বোনকেও বিবাহ করা যায়। কর্ণাটকের কোন কোন জাতির মধ্যে এর প্রচলন আছে ; তবে কর্ণাটক দেশে দশস্থ ব্ৰাহ্মণরা ভাগ্নী ও মামাতো বোনকেই বিবাহ করে ।
যদিও উত্তর ভারতে ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহ সাধারণভাবে প্ৰচলিত নেই, তথাপি অনুমান করা যেতে পারে যে, এক সময় এর ব্যাপকতা ছিল । আমরা আগেই বলেছি যে বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্যে এর বহু উল্লেখ আছে। বর্তমানে ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহ রাজস্থান, মধ্যপ্ৰদেশ, গুজরাট, কাথিয়াবাড়, মহারাষ্ট্র ও ওড়িষার কোন কোন জাতির মধ্যে প্রচলিত থাকতে দেখা যায়। রাজপুতদের মধ্যে মামাতো বোনের সঙ্গে বিবাহ বাধ্যতামূলক না হলেও, এরূপ বিবাহ প্রায়ই সংঘটিত হতে দেখা যায়। রাজস্থান, কাথিয়াবাড়, ও গুজরাটের রাজন্যবর্গের মধ্যে এরূপ বিবাহের অনেক নিদর্শন আছে । যোধপুরের রাজপরিবারে পিসতুতো বোনের সঙ্গে বিবাহের দৃষ্টান্ত আছে, মামাতো বোনের সঙ্গে নেই । তার মানে, মামাতো বোনের সঙ্গে বিবাহ এক্ষেত্রে অনুমোদিত নয়। কিন্তু কাথি, আহির ও গাধব চারণদের মধ্যে মামাতো বোনের সঙ্গে বিবাহের কোন বাধা নেই । মহারাষ্ট্রের কুন্নবীদের মধ্যে কোন কোন শাখা ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহ অনুমোদন করে, কিন্তু অপর কতিপয় শাখা তা করে না । মধ্য মহারাষ্ট্রের মারাঠাদের মধ্যে কোন কোন সম্প্রদায়ের লোক মাত্র মামাতো বোনের সঙ্গে বিবাহ অনুমোদন করে, কিন্তু ওর দক্ষিণে অবস্থিত লোকেরা মামাতো ও পিসতুতো উভয়শ্রেণীর বোনের সঙ্গেই বিবাহ মঞ্জুর করে । প্রাচীন কালেও যে এর প্রচলন ছিল তার প্রমাণ রুক্মিণীর গর্ভজাত শ্ৰীকৃষ্ণের জ্যেষ্ঠ পুত্ৰ প্ৰদ্যুম্ন তার মাতুলকন্যা কুকুন্দমতীকে বিবাহ করেছিল।