।। সাত ।।
সমুদ্রমন্থনের পর দেবাসুরে যখন আবার যুদ্ধ হয়, বিপ্ৰচিত্তী তখন অসুরগণের, সেনাপতি ছিলেন । বিপ্ৰচিত্তী কশ্যপের স্ত্রী দনুর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন । তিনি নিজের বৈমাত্রেয় ভগিনী সিংহিকাকে বিয়ে করেছিলেন ।
দেবদেবীর অজাচার
আগের অধ্যায়ে আমরা দেবালোকের অজাচার ও ব্যভিচার সম্বন্ধে আলোচনা করেছি । দেবতাদের বিশেষ যৌনাচারকে আমরা অজাচার ও ব্যভিচার বলে বর্ণনা করেছি। এই কারণে যে, যে সমাজের প্রতিরূপে দেবীসমাজ কল্পিত হয়েছিল, সে সমাজে আজ এরূপ আচরণ অজাচার ও ব্যভিচার বলে পরিগণিত হয়। কিন্তু নৃতত্ত্ববিদগণ বলেন যে এসব মানুষের মনগড়া। এ সম্বন্ধে Havelock Ellis তাঁর Psychology of Sex বইয়ে বলেছেন–“Freud holds that there is from infancy a strong natural instinct to incest; Mallinowski does not accept the aversion to incest as natural but as introduced by culture, a complex scheme of cultural reactions’. . . . . . .There is a sexual attraction towards persons with whom there is close contact, such persons being often relations, and the attraction being therefore termed incestuous.” Vestermarck তাঁর History of Human Marriage বইয়ের প্রথম সংস্করণে অজাচারকে মানুষের সহজাত প্ৰবৃত্তি বলতে চান নি, কিন্তু পরবর্তী সংস্করণে অজাচার মানুষের স্বভাবজাত প্ৰবৃত্তি বলে মত প্ৰকাশ করেন । এ সম্পর্কে Crawley, Heape প্ৰভৃতি মনীষীগণও ওই মত পোষণ করেছেন । সামাজিক রীতিনীতির প্রতিক্রিয়াতেই মানুষের মনে অজাচার সম্বন্ধে ধারণা গড়ে উঠেছে বলেই এ সম্বন্ধে এক সমাজের রীতিনীতি অপর সমাজের কাছে সম্পূর্ণ দুষ্ট । বর্তমান শতাব্দীর গোড়াতেই একজন বিখ্যাত সমাজতত্ত্ববিদ উইলিয়াম গ্রাহাম সামনার বলেছিলেন যে লোকাচারই স্থির করে দেয় কোনটা দুষ্ট, আর কোনটা দুষ্ট নয় ! আমার নানা লেখার মধ্যে আমি বার বার একথা বলেছি যে আচার ব্যবহার, রীতিনীতি ইত্যাদি সম্বন্ধে সামাজিক স্বীকৃতিই হচ্ছে আসল জিনিষ । এক সমাজ যেটা অনুমোদন করবে, আর এক সমাজ সেটা অনুমোদন না-ও করতে পারে । আবার যে কোন সমাজে এককালে যে আচরণ স্বীকৃত হত, পরবর্তীকালে সেই সমাজ কর্তৃকই সেটা স্বীকৃত না-ও হতে পারে । আমাদের বাঙালী সমাজেই এ-রকম ঘটনা বার বার ঘটেছে । ১৯১৮ খ্ৰীষ্টাব্দে “ম্যান ইন ইণ্ডিয়া’ পত্রিকায় আমি দেখিয়েছিলাম যে এক সময় বাঙালী সমাজে শালীবরণ ও দেবরবরণ এই দুই প্ৰথাই প্ৰচলিত ছিল । বর্তমানকালে কন্যার বিবাহের সময় অনুসৃত জামাইবরণ প্রথা শালীবরণ প্রথার অন্তিম নিদর্শন ।
।। দুই ।।
এবার শুনে চমকে উঠবেন না ষে সহোদরাকে বিবাহ করা যদিও আজকের হিন্দুর কাছে অজাচার বলে গণ্য হয় তা হলেও এরূপ বিবাহ এক সময়ে ভারতীয় সমাজে স্বীকৃত হত। বাঙালী সমাজেও হত । এর প্রমাণ আমরা পাই সিংহল দেশের ‘দীপবংশ’ ও ‘মহাবংশ’ নামে দুই প্ৰাচীন গ্ৰন্থ থেকে । সেখানে বিবৃত হয়েছে যে গৌতম বুদ্ধের অবিভাবের পূর্বে বঙ্গদেশের বঙ্গনগরে এক রাজা ছিলেন। তিনি কলিঙ্গদেশের রাজকন্যাকে বিবাহ করেছিলেন। তঁদের এক অতি সুন্দরী কন্যা হয় ; কিন্তু সে অত্যন্ত দুষ্টা ছিল । সে একবার পালিয়ে গিয়ে মগধ-যাত্রী এক বণিকের দলে ঢুকে যায়। তারা যখন বাঙলার সীমানায় উপস্থিত হয়, তখন এক সিংহ তাদের আক্রমণ করে। বণিকেরা ভয়ে পালিয়ে যায় । কিন্তু রাজকন্যা সিংহকে তুষ্ট করে তাকে বিবাহ করে । মনে হয় এখানে আক্ষরিক অর্থে ‘সিংহ’ না ধরে, সিংভূম জেলার ‘সিংহ’ উপাধিধারী কোন উপজাতীয়কে ধরে নিলে, এর অর্থ খুব সরল হয়ে যাবে। ওই সিংহের ঔরসে মেয়েটির গর্ভে সিংহবাহু নামে এক পুত্র এবং এক কন্যা জন্মে। সিংহবাহু বড় হয়ে সিংহকে হত্যা করে ও নিজ ভগ্নীকে বিবাহ করে । পরে রাঢ়দেশে সে এক রাজ্য প্ৰতিষ্ঠা করে । সহোদরার গর্ভে ও তার ঔরসে সিংহবাহুর অনেকগুলি পুত্ৰ সন্তান হয়। প্রথম দুটির নাম বিজয় ও সুমিত্র । বিজয় অত্যন্ত দুর্বিনীত ও অত্যাচারী ছিল । তার দুর্ব্যবহারে রাজ্যবাসীগণ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে । বাধ্য হয়ে রাজা সাতশত অনুচরের সঙ্গে বিজয়কে এক নৌকা বরে সমুদ্রে পাঠিয়ে দেন । বিজয় নৌকাযোগে লঙ্কাদ্বীপে এসে, কুবেনী নামে এক যক্ষিণীকে বিবাহ করে ও সিংহল রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে । বিজয় যেদিন লঙ্কাদ্বীপে গিয়ে পৌঁছেছিল, সেদিনই কুশীনগরে ভগবান বুদ্ধ মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন । এই কাহিনী থেকে দুটি তথ্য প্ৰকাশ পায়। প্ৰথম, বিজয়ের সময়কাল ভগবান বুদ্ধের সমকালীন ও দ্বিতীয় বিজয়ের পিতা সিংহবাহু নিজ সহোদরাকে বিবাহ করেছিলেন ।
।। তিন ।।
নিজ সহোদরা বা সমগোত্ৰীয়াকে বিবাহ করা প্ৰাচীনকালে প্ৰাচ্য ভারতে প্ৰচলিত ছিল। বৌদ্ধ জাতকগ্ৰন্থ সমূহে আমরা এর ভুরিভুরি প্ৰমাণ পাই । বৌদ্ধ সাহিত্যের এক জায়গায় আমরা পড়ি যে, রাজা ওঙ্ককের ( ইক্ষাকুর ) প্ৰধানা মহিষীর গর্ভে পাঁচ ছেলে ও চার মেয়ে জন্মগ্রহণ করে। ওই প্ৰধান মহিষীর মৃত্যুর পর রাজা এক যুবতীকে বিবাহ করেন । এই রাণীর যখন এক পুত্র হয়, তখন তিনি রাজাকে বলেন যে তাঁর ছেলেকেই রাজা করতে হবে । রাজা তার প্রথম মহিষীর পাঁচ পুত্র ও চার মেয়েকে হিমালয়ের পাদদেশে নির্বাসিত করেন। সেখানে কপিলমুনির সঙ্গে তাদের দেখা হয়। কপিলমুনি তাদের সেখানে একটি নগর স্থাপন করে বসবাস করতে বলেন । এই নগরের নামই কপিলাবস্তু হয় । ভ্রাতাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ অকৃতদার রইলেন। আর বাকী চার ভাই চার বোনকে বিবাহ করে । ‘মহাবস্তু’ নামে বৌদ্ধগ্রন্থে এই কাহিনীটা আছে ।