দেবলোকের খুব চাঞ্চল্যকর ব্যভিচার হচ্ছে দেবগুরু বৃহস্পতির স্ত্রী তারার সঙ্গে চন্দ্রের ব্যভিচার । তারার রূপলাবণ্যে মুগ্ধ হয়ে চন্দ্র একবার তারাকে হরণ করে। এই ঘটনায় বৃহস্পতি ক্রুদ্ধ হয়ে চন্দ্ৰকে শাস্তি দেবার জন্য দেবতাদের সাহায্য প্রার্থনা করে । তারাকে ফেরত দেবার জন্য দেবতা ও ঋষিগণ চন্দ্ৰকে অনুরোধ করে । চন্দ্ৰ তারাকে ফেরত দিতে অরাজী হয়, এবং দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের সাহায্য প্রার্থনা করে। রুদ্রদেব বৃহস্পতির পক্ষ নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন । দেবাসুরের মধ্যে এক ভীষণ যুদ্ধের আশঙ্কায় ব্ৰহ্মা মধ্যস্থ হয়ে বিবাদ মিটিয়ে দেন। চন্দ্র তারাকে বৃহস্পতির হাতে প্রত্যপণ করে। কিন্তু তারা ইতিমধ্যে চন্দ্র কর্তৃক অন্তসত্বা হওয়ায়, বৃহস্পতি তাকে গৰ্ভত্যাগ করে তার কাছে আসতে বলে । তারা গৰ্ভত্যাগ করার পর এক পুত্রের জন্ম হয় । এর নাম দস্যু সুন্তম্ । ব্ৰহ্মা তারাকে জিজ্ঞাসা করেন এই পুত্র চন্দ্রের ঔরসজাত কিনা ? তারা ইতিবাচক উত্তর দিলে চন্দ্ৰ সেই পুত্ৰকে গ্ৰহণ করে, ও তার নাম রাখে বুধ ।
আর্যদেবতামণ্ডলীর দেবতাগণের ব্যভিচারের আরও দৃষ্টান্ত আছে। এখানে আরও একটা উদাহরণ দিচ্ছি । বরুণ ঋগ্বেদের একজন প্ৰধান দেবতা। ঋগ্বেদের ঋষিরা আকাশকে সমুদ্রের সঙ্গে কল্পনা করে আকাশের দেবতা বরুণকে জলময় মনে করতেন ! মহাভারতে আছে যে বরুণ চন্দ্রের কন্যা উতথ্যের স্ত্রী ভদ্রার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে হরণ করে নিয়ে যায়। অনেক পীড়াপীড়ি সত্বেও বরুণ যখন ভদ্রাকে ফিরিয়ে দিল না, উতথ্য তখন সমস্ত জলরাশি পান করতে উদ্যত হলেন । তখন বরুণ ভয় পেয়ে ভদ্রাকে ফিরিয়ে দিল ।
আমরা আবার পড়ি একবার অশ্বিনীকুমারদ্বয় শর্যাতি রাজার মেয়ে যৌবনদীপ্ত সুকন্যাকে স্নানের পর নগ্নাবস্থায় দেখে তার রূপে মুগ্ধ হয়ে জরাগ্রস্ত বৃদ্ধ স্বামী চ্যবনকে ত্যাগ করে তাদের গ্ৰহণ করতে প্ৰলুব্ধ করেছিল। আৰ্যদেবতামণ্ডলীর যৌন-জীবনে পরস্ত্রীকে এভাবে ফুসলে নিয়ে যাওয়া-আদৰ্শ নীতির পরিচায়ক নয়।
আবার রামায়ণের আদিকাণ্ডে আমরা পড়ি যে একবার পবনদেব রাজৰ্ষি কুশনাভের একশত পরম রূপবতী কন্যাদের ধর্ষণ করতে অভিলাষ করেছিলেন । মেয়েগুলি অস্বীকৃত হলে, পবনদেব তাদের শরীরে প্রবিষ্ট হয়ে, তাদের শরীর ভগ্ন করে দেন | পবনদেব কেশরীরাজ অঞ্জনার গর্ভে হনুমানকে উৎপাদন করেছিলেন ।
দেবতারা অনেক সময় অস্বাভাবিক মৈথুনেও রত হতেন । সংজ্ঞা বিশ্বকর্মার কন্যা ও সূর্যের স্ত্রী । সংজ্ঞা সূর্যের অসহ্য তেজ সহ্য করতে না পেরে, নিজের অনুরূপ ছায়া নামে এক নারীকে সূর্যের কাছে রেখে, উত্তরকুরুবর্ষে ঘোটকীর রূপ ধরে বিচরণ করতে থাকে। পরে সূর্য যখন এটা জানতে পারে, তখন তিনি বিশ্বকৰ্মার কাছে গিয়ে নিজের তেজ কর্তন করে অশ্বরূপ ধারণ করে ঘোটকীরূপিনী সংজ্ঞার কাছে এসে তার সঙ্গে সঙ্গমে রত হয় । এই মিলনের ফলে প্ৰথমে যুগলদেবতা অশ্বিনীকুমার ও পরে রেবন্তের জন্ম হয় । এরপর সূর্য নিজের তেজ কর্তন করায় সংজ্ঞা নিজের রূপ ধারণ করে স্বামীগৃহে ফিরে আসে।
প্ৰজাপতির কথা আগেই বলা হয়েছে। প্ৰজাপতির কন্যা ঊষা যখন মৃগীরূপ ধারণ করেছিল, প্ৰজাপতি তখন মৃগরূপ ধারণ করে কন্যায় উপগত হয়েছিলেন । শতপথ ব্ৰাহ্মণে বলা হয়েছে যে এই অপকর্মের জন্য রুদ্র প্রজাপতিকে এক তীক্ষ বানদ্বারা আঘাত করেছিলেন । কিন্তু ঋগ্বেদ (১০।৬১।৫-৭ ) অনুযায়ী রুদ্র নিজেও এই অপকৰ্ম করেছিলেন ।
।। পাঁচ ।।
দেবলোকে যে মাত্র পুরুষরাই ব্যভিচার করত, তা নয়। দেবালোকের মেয়েরাও ব্যভিচারে লিপ্ত থাকত। আগেই বলেছি যে দক্ষকন্যা স্বাহা অগ্নিকে কামনা করতেন । সপ্তর্ষিদের যজ্ঞে অগ্নি ( এ থেকে প্ৰকাশ পাচ্ছে যে অগ্নিও একজন কামুক দেবতা ) যখন সপ্তর্ষিদের স্ত্রীদের দেখে কামার্ত হয়ে ওঠে স্বাহা তখন এক এক ঋষিপত্নীর রূপ ধরে ছয়বার অগ্নির সঙ্গে সঙ্গম করে । ছয়বারই অগ্নির বীর্য কাঞ্চনকুম্ভে নিক্ষিপ্ত হয় । এই ঘটনার পর সপ্তর্ষিরা তাদের স্ত্রীদের সন্দেহ করে পরিত্যাগ করে । সপ্তর্ষিদের অন্যতম বশিষ্ঠের স্ত্রী অরুন্ধতীর তপোপ্রভাবে স্বাহা আর তার রূপ ধারণ করতে পারেনি। বিশ্বামিত্র প্ৰকৃত ব্যাপার জানতেন বলে তিনি ঋষি-স্ত্রীদের নির্দোষী বলেন । কিন্তু ঋষিরা তা বিশ্বাস করে না। পরে স্বাহা অগ্নির স্ত্রী হন। কিন্তু স্বৰ্গে গিয়েও স্বাহার স্বভাব পরিবর্তিত হয় না । তিনি নিজ স্বামীকে ছেড়ে, কৃষ্ণকে স্বামীরূপে পাবার জন্য তপস্যা করতে থাকেন । বিষ্ণুর বরে দ্বাপরে স্বাহা নগ্নজিৎ রাজার কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করে কৃষ্ণকে স্বামীরূপে পায় ।
।। ছয় ।।
আবার ইন্দ্রের কথাতেই ফিরে আসছি। একবার দেবতা ও মহৰ্ষিরা ইন্দ্ৰকে স্বৰ্গ থেকে বিতারিত করেছিল । তাঁরা নহুষকে ইন্দ্রের আসনে বসান । কিন্তু আসনের দোষ যাবে কোথায় ? কিছুকাল পরে নহুষ ইন্দ্রের স্ত্রী শচীকে হস্তগত করবার চেষ্টা করে । শচী বিপদাপন্ন হয়ে নিজেকে নহুষের কামলালসা থেকে রক্ষা করবার জন্য বৃহস্পতির পরামর্শে শচী নহুষকে বলে যে নহুষ যদি সপ্তর্ষি-বাহিত যানে তার কাছে আসে, তা হলে সে নহুষের সঙ্গে মিলিত হতে পারে। নহুষ সপ্তর্ষি বাহিত শিবিকায় যাবার সময় অগস্ত্যের মাথায় পা দিয়ে ফেলেন। এর ফলে, অগস্ত্যের শাপে নহুষ অজগর সর্পরূপে বিশাখাযুপ বনে পতিত হন । এভাবে শচীর সতীত্ব রক্ষা পায় ।