এবার শুনুন শরৎচন্দ্র তাঁর ‘বামনের মেয়ে’ উপন্যাসে কি বলেছেন। ‘পরম কুলীনের পরমা কুলীন কন্যা হিসাবে সন্ধ্যা বলল-আমি বামুনের মেয়ে নই।…আমার মা আমাকে সম্প্রদান করতে বসেছিলেন। এমন সময় মৃত্যুঞ্জয় ঘটক দু’জন লোক সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হল। বলল, তোমরা শোন, এই যাকে তোমরা পরম কুলীন প্রিয় মুখুজ্যে বলে জান সে বামন নয়, মিহির নাপিতের ছেলে। তারপর মৃত্যুঞ্জয় ঘটক গঙ্গাজলের ঘটটা ঠাকুরমার সামনে বসিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, বলুন সত্যি কিনা? বলুন ও কার ছেলে? মকুন্দ মুখুজ্যের না হীরা নাপিতের? আমার সন্ন্যাসিনী ঠাকুরমা মাথা হেঁট করে রইলেন। কিছুতেই মিথ্যা কথা বলতে পারলেন না। একজন তখন সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। সে তাদের গ্রামের লোক। বলল, আট বছর বয়সে ঠাকুরমার বিয়ে হয়, তারপর দশ-পনের বছর পরে একজন এসে জামাই মুকুন্দ মুখুজ্যে বলে পরিচয় দিয়ে বাড়ি ঢোকে। পাঁচ টাকা আর একখানা কাপড় নিয়ে সে দুদিন বাস করে চলে যায়। তারপর থেকে লোকটা প্রায়ই আসত। ঠাকুরমা খুব সুন্দরী ছিলেন–আর সে টাকা নিত না। তারপর যখন সে একদিন হঠাৎ ধরা পড়ে গেল, তখন বাবা জন্মেছেন। তারপর লোকটা বলল, ও কুকাজ সে নিজের ইচ্ছায় করেনি, তার মনিব মুকুন্দ মুখুজ্যের আদেশেই করেছে। একে বুড়ো মানুষ, তারপর পাঁচ-সাত বছর বাতে পঙ্গু, তাই অপরিচিত স্ত্রীদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের ভার তার ওপর দিয়েছিল। হিরু নাপিত ঐ বামনের পরিচয় মুখস্থ করে, একটা উপায় তৈরি করে রাখে। তখন থেকে যা কিছ রোজগার করে অর্ধেক ভাগ পায়। আরো দশ-বারো জায়গা থেকে সে এমনি করে প্রভুর জন্য রোজগার করে নিয়ে যেত।’
রামনারায়ণ তর্করত্ন, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগর ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখদের রচনা থেকে আমরা বাঙলার কুলীন ব্রাহ্মণদের পরিচয় পাই। তারাই কুলীনের মেয়েদের পিতা, এবং তাদের মেয়েরাই কুলীন ব্রাহ্মণ ছাড়া বিবাহ করতে পারত না। এই প্রথা নিবর্তনের জন্য বিদ্যাসাগর মশাই যথেষ্ট আন্দোলন করেছিলেন, কিন্তু সরকারী সমৰ্থন পাননি। তবে তা সত্ত্বেও তাঁর আন্দোলনের ফলেই এই কুপ্রথা বাঙালী সমাজ থেকে গত শতাব্দীতে বিলপ্ত হয়। তার ফলে কুলীনের মেয়েরা বিবাহিত জীবনে আজ সম্মান ও শুচিতা লাভ করেছে।
হিন্দু বিবাহ-বিধান
গত শতাব্দীতে হিন্দু মেয়েরা পেয়েছে বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার। আর পুরুষ বঞ্চিত হয়েছে তার একাধিক বিবাহ করবার অধিকার। এছাড়া বিবাহের ন্যূনতম বয়স এখন বর্ধিত করা হয়েছে। এ সবই বিবাহের ওপর গণতান্ত্ৰিক চিন্তাধারার ফসল। এ সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে দেখা যাক বিবাহ সম্বন্ধে আমাদের আগে কি প্রথা ও নিয়মকানুন ছিল।
আর্যরা এদেশে আসবার আগে যে সব বর্গের বিবাহপ্রথা প্রচলিত ছিল তা হল যথাক্রমে রাক্ষস, গন্ধব ও অসুর বিবাহ। কেননা এই সব বর্গের বিবাহের কোন উল্লেখ ঋগ্বেদে নেই, অথচ এগুলি বর্তমানের আদিবাসী সমাজে প্রচলিত আছে। বৈদিক যুগে মাত্ৰ এক রকম বর্গের বিবাহই (ব্রাহ্ম বিবাহ) প্রচলিত ছিল, এবং তারপ্রাপ্তবয়স্ক যুবক যুবতীদের মধ্যেই হত। এছাড়া তাদের অধিকাংশই নিজের পতি নিজেই নিবাচন করতে পারত। এটা আমরা জানতে পারি ঋগ্বেদের সপ্তম মণ্ডলে বর্ণিতে ‘সমন’ উৎসব থেকে। এই উৎসবে যুবতীরা মনোমত পতি লাভের আশায় সুসজ্জিত হয়ে যোগদান করত। পরে দিদিষুর (মধ্যগ বা ঘটকের) আবির্ভাব ঘটে। তখন থেকেই ‘সমন’ উৎসবে পতিনির্বাচনের প্রচলন কমে যায়।
বৈদিক যুগে বিবাহ কোন বিশেষ ব্যক্তির সঙ্গে হত না, হত তার সমস্ত ভ্ৰাতাদের সঙ্গে। অন্তত আপস্তম্ভধমসূত্রে পরিষ্কার বলা হয়েছে যে, কন্যাকে দান করা হয় কোন এক বিশেষ ভ্রাতাকে নয়, বংশের সমস্ত ভ্ৰাতাকে। এজন্য পরবর্তীকালে মনু বিধান দিয়েছিলেন যে, কলিযুগে কন্যার বিবাহ যেন সমগ্র পরিবারের সঙ্গে যৌথভাবে দেওয়া না হয়। ঋগ্বেদ এবং অথবা বেদে কয়েকটি স্তোত্ৰ আছে যা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, যদিও বধুকে জ্যেষ্ঠভ্ৰাতাই বিবাহ করত, তা হলেও তার কনিষ্ঠ সহোদরদের তার ওপর যৌনমিলন বা রমণের অধিকার থাকত। এই দুই গ্রন্থেই স্বামীর কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে ‘দেবৃ’ বা দেবর বলা হয়েছে। কেননা, ‘দেবর’ মানে ‘দ্বিবর’ বা দ্বিতীয় বর। ঋগ্বেদের এক সাহানে বর্ণিত হয়েছে যে বিধবা বৌদি দেবৃকে তার দাম্পপত্য শয্যায় নিয়ে যাচ্ছে।
ঋগ্বেদে যম-যমীর কথোপকথনে দেখা যায় যে যমের যমজ-ভগনী যমী। যমের সঙ্গে যৌনমিলন প্ৰার্থনা করছে। বৌদ্ধ জাতক গ্রন্থেও সহোদরসহোদরা বিবাহের বহু দৃষ্টান্ত আছে। পরবর্তী কালে যখন গোত্র-প্রবর-সপিণ্ড বিধানের উদ্ভব হয়, তখন এটা বন্ধ হয়ে যায়। তবে দক্ষিণ ভারতে পিসততো বোন ও মামাতো বোনের সঙ্গে বিবাহ এখনও বাঞ্ছনীয়। বর্তমানে উত্তর ভারতে নিকট আত্মীয়ের সঙ্গে বিবাহ নিষিদ্ধ, যদিও আদিবাসী সমাজে এটার প্রচলন আছে। যেমন উত্তর-পূর্ব সীমান্তের আদিবাসী সমাজভুক্ত লাখের, বাগনী ও ডাফলা জাতির লোকরা বিধবা বিমাতাকে বিবাহ করে। আসামের গারো জাতির লোকেরা বিধবা শাশুড়িকে বিবাহ করে। ওড়িশার আদিবাসী সমাজে শবর জাতির লোকেরা বিধবা খুড়িকে বিবাহ করে।
মহাভারতীয় যুগে আমরা চার রকমের বিবাহের উল্লেখ পাই, যথা ব্রাহ্ম, গান্ধব, অসুর ও রাক্ষস। কিন্তু সূত্ৰগ্রন্থসমূহে আট রকম বিবাহের উল্লেখ আছে। উপরোক্ত চার রকম ছাড়া, আর্য, প্রাজাপত্য, দৈব ও পিশাচ। এই সকল বিবাহের বর্ণনা আমার ‘ভারতের বিবাহের ইতিহাস’ বইয়ে দেওয়া আছে। তবে এখানে মাত্র একথাই বলতে চাই যে মহাভারতীয় ও রামায়ণী যুগের স্বয়ম্বরা বিবাহ রাক্ষস বিবাহেরই একটা সুষ্ঠ সংস্করণ।