কুলীনের মেয়ের ছিল অভিশপ্ত ও কলঙ্কিত জীবন। ‘কুলীনের মেয়ে’ বলতে বোঝাত কুলীন ব্রাহ্মণকন্যা। যে সকল ব্রাহ্মণ ‘কুলীন’ নামে আখ্যাত হতেন, তাঁদের পদবী ছিল বন্দ্যোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায়, গঙ্গোপাধ্যায় ও মখোপাধ্যায়। সামাজিক মর্যাদায় তাঁরা ছিলেন অন্যান্য ব্ৰাহ্মণের তলনায় উচ্চ ও শ্রেষ্ঠ। বিবাহ সম্বন্ধে তাঁদের মধ্যে যে বিধান প্রচলিত ছিল সেই বিধান অনযায়ী কুলীন ব্রাহ্মণসন্তান কুলীন বা অকুলীন ব্রাহ্মণ বংশে বিবাহ করতে পারত, কিন্তু কুলীন ব্রাহ্মণকন্যারা তা পারত না। যদি সেরূপ মেয়ের বিবাহ অকুলীনের সঙ্গে হতো, তাহলে তার বাবার কৌলীন্য ভঙ্গ হতো। সামাজিক মর্যাদায় সেরূপ বংশ হীন বলে পরিগণিত হতো। সেজন্য কুলীন ব্রাহ্মণরা কন্যাদান কুলীন পাত্রেই করত। এছাড়া আরও বিধিনিষেধ ছিল। ফলে কুলীন কন্যার বিবাহ সম্বন্ধে সমাজে এক জটিল অবস্হার সৃষ্টি হয়েছিল।
বস্তুত মধ্যযুগের বাঙালী ব্রাহ্মণ সমাজে কৌলীন্য প্রথা যে জটিল অবস্হার সৃষ্টি করেছিল, তাতে কুলীন কন্যাদের বিবাহ যে মাত্ৰ দণ্ডকর হয়ে উঠেছিল তা নয়; বিভ্রাটে ও সামাজিক অশুচিতায় পরিণত হয়েছিল। অর্থগৃধ্নতা একশ্রেণীর কুলীন ব্রাহ্মণকে প্রলুব্ধ করেছিল বিবাহকে একটা বাণিজ্যিক পেশায় পরিণত করতে। রামনারায়ণ তর্করত্ন তাঁর ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ নাটকে তাদের ‘বিবাহ বণিক’ বলে বর্ণনা করেছেন। গ্রামে গ্রামে ঘরে অর্থের বিনিময়ে তারা কুলীন কন্যার পিতাদের কন্যাদায় হতে মুক্ত করত। তারপর বিবাহান্তে ওই সকল বিবাহবণিক নিজেদের খাতায় কন্যার ও তার পিতার নামধাম লিখে নিয়ে অন্তর্হিত হতো। ফলে সেরূপ ‘বিবাহিতা’ কুলীন কন্যাকে পিতৃগহেই থাকতে হতো। অনেক সময় কুলীন পিতা কুলরক্ষার জন্য শ্মশানঘাটে ‘গঙ্গাজলী’র জন্য আনীত কুলীন ব্রাহ্মণের সঙ্গেই কন্যার বিবাহ দিতেন। অচিরেই সেই কন্যা বিধবা হতো। এরূপ বিধবা কুলীন কন্যারাও পিতৃগহেই থেকে যেত। আবার গরীব কুলীন কন্যাদের অনেক সময় বিবাহই হতো না। সারা জীবন তাদের অনূঢ়া হয়েই পিতৃগহে থেকে যেতে হতো।
যারা কুলীন কন্যাদের বিবাহ করা পেশা রূপে গ্রহণ করেছিল, সে-সব কুলীন ব্রাহ্মণ খাতা দেখে নামধাম সংগ্রহ করে মাঝে মাঝে শ্বশুরবাড়িতে পদার্পণ করত এবং এক রাত্রি জামাই আদরে থেকে সালিয়ানা দক্ষিণা আদায় করে, কুলীন কন্যার পিতার বংশকে কৃতাৰ্থ করে, সত্বর অপর গ্রামে অপর শ্বশুরবাড়িতে পদার্পণ করবার জন্য যাত্রা করত। অনেকে আবার রাত্রিকালে নিদ্রিতা স্ত্রীর অলঙ্কার অপহরণ করে ও সরে পড়ত।
অনেক সময়ই এরূপ বিবাহ-পেশাদারী কুলীন ব্রাহ্মণরা শ্বশুরবাড়ির পথঘাটের সঙ্গে সম্যক পরিচিত থাকত না। কথিত আছে এরূপ এক কুলীন ব্রাহ্মণ এক গ্রামে গিয়ে শ্বশুরবাড়ি চিনতে না পেরে, পথে পুঙ্করিণী থেকে স্নানান্তে প্রত্যাগতা এক যুবতীকে দেখে তাকে সম্বোধন করে জিজ্ঞাসা করে–মা, অমকের বাড়ি এ গ্রামের কোথায় বলতে পার? তিনি কেন সন্ধান করছেন জানতে চাইলে ব্রাহ্মণ বলে-‘আমি তাঁর জামাই।’ সে কথা শুনে সেই কন্যা বুক পর্যন্ত অবগুণ্ঠিত হয়ে, তাকে নিজ গৃহে নিয়ে যায়।
আগেই বলেছি যে এ-সমাজের মেয়েরা বিয়ের পর বাপের বাড়িতেই থেকে যেত। স্বামী ক্বচিৎ কদাচিৎ শ্বশুরবাড়ি আসত। কিন্তু শ্বশুরবাড়ি এলে কি হবে! বিনা দক্ষিণায় তারা কখনও স্ত্রীর সহিত মিলিত হতো না। ভারতচন্দ্র তাঁর ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে এর এক সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন। সেখানে এক কুলীনের মেয়ের মুখ দিয়ে তিনি বলিয়েছেন–
আর রামা বলে আমি কুলীনের মেয়ে
যৌবন বহিয়া গেল বর চেয়ে চেয়ে।।
যদি বা হইল বিয়া কত দিন বই।
বয়স বুঝিলে তার বড় দিদি হই।।
বিয়াকালে পণ্ডিতে পণ্ডিতে বাদ লাগে।
পুনর্বিয়া হবে কিনা বিয়া হবে আগে।।
দু-চারি বৎসরে যদি আসে একবার।
শয়ন করিয়া বলে কি দিবি ব্যাভার।।
সুতা বেচা কড়ি যদি দিতে পারি তায়।
তবে মিষ্টি মুখ নতুবা রুষ্ট হয়ে যায়।।
সুতরাং এরূপ সমাজে যে-সব মেয়ের যৌনক্ষুধা প্রবল, তাদের ক্ষেত্রে যা ঘটত তা সহজেই অনুমেয়। গোপন অভিসার কুলীন কন্যাদের সবভাবে দাঁড়িয়েছিল। আদিম যৌনক্ষুধাকে তারা অস্বীকার করতে পারত না। অবৈধ সহবাসে তারা লিপ্ত হতো। বস্তুতঃ খ্রীস্টীয় উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে রামনারায়ণ তর্করত্ন ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সেটা খোলাখুলিই বলেছিলেন। রামনারায়ণ তাঁর ‘কুলীনকলসর্বস্ব’ নাটকের চতুথ অঙ্কে পিতা-পুত্রের সংলাপের ভিতর দিয়ে সেটা বলেছেন। পুত্র তিন বৎসর শ্বশুরবাড়ি যায়নি। হঠাৎ খবর এল তার একটি কন্যাসন্তান হয়েছে। পুত্র আশ্চর্য হয়ে পিতাকে যখন এ কথা বলছে, তখন পিতা বলছেন–বাপু হে, তাতে ক্ষতি কি? আমি বিবাহ করবার পর একবারও শ্বশুর বাড়ি যাইনি। শুভদৃষ্টির পর একেবারে তোমার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়।’
কুলীন কন্যাদের যখন স্বামী ব্যতীতই গর্ভ হতো, তখন মেয়ের মায়েরা কি কৌশল অবলম্বন করে সেই সন্তানের বৈধতা পাড়াপাড়শীদের কাছে জানাতো, তা বিদ্যাসাগর মশাই তাঁর ‘বহুবিবাহ নিবন্ধে বিবৃত করেছেন। বিদ্যাসাগর মশাই লিখেছেন–
‘কোনও কারণে কুলীন মহিলার গর্ভসঞ্চার হইলে, তাহার পরিপাকাথে কন্যাপক্ষীয়দিগকে বিবিধ উপায় অবলম্বন করিতে হয়। প্রথম সবিশেষ চেষ্টা ও যত্ন করিয়া জামাতাকে আনয়ন। তিনি আসিয়া শ্বশুরালয়ে দু-একদিন অবস্থিতি করিয়া, প্রস্থান করেন। ঐ গর্ভ তৎ সহযোগে সম্ভুত বলিয়া পরিগণিত হয়। দ্বিতীয়, জামাতার আনয়নে কৃতকার্য হইতে না পারিলে, ব্যভিচার সহচরী ভ্রূণহত্যাদেবীর আরাধনা। এ অবস্হায় এতদ্ব্যাতিরিক্ত নিস্তারের আর পথ নাই। তৃতীয় উপায় অতি সহজ, অতি নির্দোষ ও সাতিশয় কৌতুকজনক। তাহাতে অর্থব্যয়ও নাই এবং ভ্রূণহত্যাদেবীর উপাসনাও করিতে হয় না। কন্যার জননী বা বাটির অপর কোন গৃহিণী একটি ছেলে কোলে করিয়া, পাড়ায় বেড়াইতে যান, এবং একে একে প্রতিবেশীদিগের বাটি গিয়া, দেখ মা, দেখ বোন অথবা দেখ বাছা, এইরূপ সম্ভাষণ করিয়া, কথা প্রসঙ্গে বলিতে আরম্ভ করেন, অনেক দিনের পর কাল রাত্ৰিতে জামাই আসিয়াছিলেন, হঠাৎ আসিলেন, রাত্রিকাল কোথায় কি পাব, ভাল করিয়া খাওয়াতে পারি নাই। অনেক বলিলাম একবেলা থাকিয়া, খাওয়া দাওয়া করিয়া যাও। তিনি কিছুতেই রহিলেন না, বলিলেন, আজ কোন মতে থাকিতে পারিব না; সন্ধ্যার পরই অমুক গ্রামের জমিদারের বাটিতে একটা বিবাহ করিতে হইবেক; পরে অমুক দিন, অমুক গ্রামের হালদারের বাটীতেও বিবাহের কথা আছে; সেখানেও যাইতে হইবেক। যদি সুবিধা হয়, আসিবার সময় এই দিক দিয়া যাইব। এই বলিয়া ভোর ভোর চলিয়া গেলেন। স্বর্ণকে বলিয়াছিলাম, ত্রিপুরা ও কামিনীকে ডাকিয়া আন, তারা জামাইয়ের সঙ্গে খানিক আমোদ আহ্লাদ করিবে। একলা যেতে পারব না, বলিয়া ছুঁড়ী কোন মতেই এল না। এই বলিয়া সে ঐ দুই কন্যার দিকে চাহিয়া বলিলেন, এবার জামাই এলে মা তোরা যাস ইত্যাদি। এইরূপে পাড়ায় বাড়ি বাড়ি বেড়াইয়া জামাতার আগমনবার্তা কীর্তন করেন। পরে স্বর্ণমঞ্জরীর গর্রসঞ্চার প্রচার হইলে, ঐ গর্ভ জামাতাকৃত বলিয়া পরিপাক পায়।’