।। দুই।।
অনেকেই বলেন যে সিন্ধুসভ্যতা ও আর্যসভ্যতা অভিন্ন। কিন্তু এটা যে ভ্ৰান্ত মত সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। দুই সভ্যতার মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করলেই এটা বুঝতে পারা যাবে। দুই সভ্যতার মূলগত পার্থক্যগুলি আমি নীচে দিচ্ছি–
(১) সিন্ধু সভ্যতার বাহকরা শিশ্ন-উপাসক ছিল মাতৃকাদেবীর আরাধনা করত। আর্যরা শিশ্ন-উপাসক ছিল না ও শিশ্ন-উপাসকদের ঘৃণা ও নিন্দা করত। আর্যরা পুরুষ দেবতার উপাসক ছিল। মাতৃকাদেবীর পূজার কোন আভাসই আমরা ঋগ্বেদে পাই না!
(২) আর্যরাই প্রথম ঘোড়াকে পোষ মানিয়েছিল। ঘোড়াই ছিল তাদের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ জন্তু। এখানে বলা দরকার যে ঘোড়ার কোন অশ্মীভূত (f০ssilized) অস্থি আমরা সিন্ধুসভ্যতার কোন কেন্দ্রে পাইনি। সিন্ধুসভ্যতার বাহকদের কাছে বলীবর্দই প্রধান জন্তু ছিল। এটা শীলমোহরসমূহের ওপর পুনঃ পুনঃ বলীবর্দের প্রতিকৃতি খোদন থেকে বঝতে পারা যায়। পশুপতি শিব আরাধনার প্রমাণও মহেঞ্জোদারো থেকে পাওয়া গিয়েছে। বলীবর্দ শিবেরই বাহন। সুতরাং সিন্ধুসভ্যতার কেন্দ্রসমূহে বলীবর্দের প্রাধান্য সহজেই অনুমেয়।
(৩) সিন্ধুসভ্যতার বাহকরা নগরবাসী ছিল। আর্যরা নগর নির্মাণ করত না। তারা নগর ধবংস করত। সেজন্য তারা তাদের দেবতা ইন্দ্রর নাম পুরন্দর রেখেছিল।।
(৪) আর্যরা মৃত ব্যক্তিকে দাহ করত। সিন্ধু সভ্যতার ধারকরা মৃতকে সমাধিস্থ করত।
(৫) আর্যদের মধ্যে লিখন প্রণালীর প্রচলন ছিল না। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতার ধারকদের মধ্যে লিখন প্রণালী সুপ্রচলিত ছিল।
(৬) সিন্ধুসভ্যতা যে আর্যসভ্যতা নয়, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে মৃৎপাত্র। কুরু-পঞ্চাল দেশ, তার মানে যেখানে আর্যসভ্যতা বিস্তার লাভ করেছিল, সেখানকার বৈশিষ্ট্যমূলক মৃৎপাত্রের রঙ ছিল ধূসর বর্ণ। সিন্ধুসভ্যতার কেন্দ্র সমূহ থেকে যে সব মৃৎপাত্র পাওয়া গিয়েছে সেগুলির রঙ হচ্ছে ‘কালো-লাল’।
(৭) সিন্ধু সভ্যতা ছিল কৃষিভিত্তিক সভ্যতা। আর্যরা প্রথমে কৃষিকাষ জানত না। এটা আমরা শতপথব্রাহ্মণের এক উক্তি থেকে জানতে পারি। (এ সম্বন্ধে বিশদ বিবরণের জন্য আমার ‘হিন্দু সভ্যতার নৃতাত্ত্বিক ভাষ্য’ দ্রষ্টব্য।)
(৮) সিন্ধুসভ্যতার লোকেরা হাতির সঙ্গে বেশ সপরিচিত ছিল। আর্যদের কাছে হাতি এক নতুন জীববিশেষ ছিল। সেজন্য তারা হাতিকে ‘হস্তবিশিষ্ট মৃগ’ বলে অভিহিত করত। বস্তুতঃ হাতিকে প্রাচ্য ভারতের পালকপ্য নামে এক ঋষিই প্রথম পোষ মানিয়েছিল।
এসব প্রমাণ থেকে সহজেই বঝা যাবে যে আর্যসভ্যতা ও সিন্ধুসভ্যতা এক নয়।
গোড়ার দিকে আর্যরা সিন্ধুসভ্যতার বাহকদের সঙ্গে তুমুল, সংগ্রাম চালিয়েছিল। কিন্তু তাদের এই গোড়ার দিকের বৈরিতা পরবর্তীকালে আর স্থায়ী হয়নি। পঞ্চনদ থেকে তারা যতই পূর্বদিকে অগ্রসর হল, ততই তারা এদেশের লোকের সংস্পর্শে এল। তারা এদেশের মেয়েদেরও বিয়ে করল। যখন অনার্য রমণী গৃহিণী হল, তখন আর্যদের ধর্মকর্মের ওপর তার প্রতিঘাত পড়ল। ক্ৰমশঃ তারা বৈদিক যজ্ঞাদি ও বৈদিক দেবতাগণকে পশ্চাদভূমিতে অপসারণ করল। আর্য ও অন্যান্য সংস্কৃতির সংশ্লেষণে পৌরাণিক দেবতামণ্ডলীর সৃষ্টি হল।
আর্য ও অনার্য সভ্যতার সংশ্লেষ ঘটেছিল সেখানে, যেটাকে আগে আমরা ‘কুরু-পাঞ্চাল’ দেশ বলতাম বা গঙ্গা ও যমুনার অন্তবর্তী অঞ্চল। সেখানে আর্যদের আপোষ করতে হয়েছিল অনার্যদের ভাষা, সভ্যতা ও লোকযাত্রার সঙ্গে। এটা বিবর্তনের ক্ৰমিক ধারাবাহিকতার ভিতর দিয়ে সম্পূর্ণতা লাভ করেছিল পৌরাণিক যুগে। এই সংশ্লেষণের পর আমরা ভারতীয় সভ্যতার সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ দেখি, যেটা বৈদিক সভ্যতা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। লোকে আর ইন্দ্র, বরুণ প্রভৃতি বৈদিক দেবতার স্তুতিগান করে না। বৈদিক যজ্ঞ সম্পাদন করে না। নতুন দেবতামণ্ডলীর পত্তন ঘটে। যজ্ঞের পরিবর্তে আসে পূজা ও উপাসনা। বৈদিক আত্মকেন্দ্রিক স্তুতিগানের পরিবর্তে আসে ভক্তি। এর ওপর প্রাগার্য, তান্ত্ৰিক ধর্মেরও প্রভাব পড়ে। বৈদিক যুগের আর্যরা যাদের ঘৃণার চক্ষে দেখতেন ও যাদের সঙ্গে অবিরাম সংগ্রাম করতেন, শেষ পর্যন্ত সেই অনার্য নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীসমূহেরই জয় হল। বেদ সংকলন ও মহাভারত পুরাণ ইত্যাদি রচনার ভার ন্যস্ত হল এক অনার্য রমণীর জারজ সন্তানের ওপর। এ সবই আমরা বঙ্গাব্দ চতুর্দশ শতকের আবিষ্কার ও অনুশীলনের ফলে জানতে পেরেছি।
কুলীনের মেয়ের মুক্তি
বঙ্গাব্দ চতুর্দশ শতাব্দী স্মরণীয় হয়ে আছে কুলীন ব্রাহ্মণ সমাজে বহুবিবাহ নিরোধের জন্য। মধ্যযুগের বাঙালী সমাজ কলঙ্কিত হয়েছিল এই অপপ্রথার জন্য।
আগের শতাব্দীতে কৌলীন্য প্রথা নিরোধের জন্য নিরলস প্রয়াস চালিয়েছিলেন রামনারায়ণ তর্করত্ন ও পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। যদিও বিধবা বিবাহ বৈধ করবার জন্য বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রচেষ্টা সফল হয়েছিল (১৮৫৬ সালের ১৫ নম্বর আইন দ্বারা), কিন্তু কৌলীন্য প্রথা নিরোধের জন্য তাঁর নিরলস প্রচেষ্টা ফলবতীর্ণ হয়নি। সরকার এ সম্বন্ধে কোন আইন প্রণয়ন করেন নি। সরকার কর্তৃক প্রণীত না হলেও বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রচেস্টার ফলে যে জনমত গড়ে ওঠে তারই প্রভাবে বঙ্গাবাদ চতুর্দশ শতাব্দীতে কৌলীন্য প্রথার অবলুপ্তি ঘটে।