সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে আমার পরিচয় প্রত্যক্ষ। ১৯২৮ খ্রীস্টাব্দে ভারতের প্রত্নতত্ত্ব সমীক্ষা অধিকরণের সর্বময় কর্তা স্যার জন মারশাল আমাকে নিয়োজিত করেন ‘হিন্দু-সভ্যতার গঠনে সিন্ধু সভ্যতার অবদান’ সম্বন্ধে গবেষণা করবার জন্য। এই গবেষণার কাজটা দু পর্যায়ে সমাপ্ত হয়েছিল। প্রথম পর্যায়ে মহেঞ্জোদারোয় ও দ্বিতীয় পর্যায়ে কলকাতায়। প্রথম পর্যায়ে আমি যখন মহেঞ্জোদারোতে সরেজমিনে গবেষণা চালাচ্ছি, তখন এক বাঙালী-বিদ্বেষী অফিসারের হাতে নিপীড়িত হবার ভয়ে আমাকে কলকাতাতে পালিয়ে আসতে হয়েছিল। সে কথাটা যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট-গ্রাজুয়েট ডিপার্টমেন্টের প্রেসিডেন্ট ডঃ সর্ব পল্লী রাধাকৃষ্ণন ও সেনেটের সবচেয়ে প্রভাবশালী সদস্য শ্যামাপ্রসাদ মখোপাধ্যায়ের কানে গেল, তখন তাঁরা আমাকে বৈতনিক গবেষক নিযুক্ত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুশীলন চালিয়ে যেতে বললেন। দু’ বৎসর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুশীলন চালিয়ে এই তথ্য উত্থাপন করলাম যে হিন্দু সভ্যতার গঠনের মূলে বারো-আনা ভাগ আছে সিন্ধু উপত্যকার প্রাক-আর্য সভ্যতা; আর মাত্র চার-আনা ভাগ মণ্ডিত আর্য সভ্যতার আবরণে। আমার গবেষণা-লব্ধ তথ্যসমূহ আমি স্যার জন মারশালের কাছে পাঠাতাম। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে বিশদ প্রতিবেদন পেশ করতাম। আমার সতীৰ্থ ডঃ নীহাররঞ্জন রায় ১৯৩১ খ্রীস্টাব্দে যখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত ‘ক্যালকাটা রিভিউ’ পত্রিকার সম্পাদনার ভার গ্রহণ করেন, তখন তিনি আমার গবেষণা সম্পর্কিত প্রতিবেদনের অংশবিশেষ ওই পত্রিকায় প্রকাশ করেন। কিছু অংশ ‘ইণ্ডিয়ান হিসটরিক্যাল কোয়াটারলি’ পত্রিকাতেও প্রকাশিত হয়েছিল। পরে এগুলি পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। ১৯৩৬ খ্রীস্টাব্দে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রধান ডঃ দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকার ইণ্ডিয়ান কালচারেল কনফারেনসে প্রদত্ত তাঁর সভাপতির ভাষণে বললেন—‘হিন্দু সভ্যতা যে আর্য ও অন্যান্য সভ্যতার মিশ্রণে উদ্ভুত এটা যে চারজন বিশিষ্ট প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ করেছেন তাঁরা হচ্ছেন স্যার জন মারশাল, রায়বাহাদুর রমাপ্রসাদ চন্দ, ডঃ স্টেলা ক্রামরিশ ও শ্ৰীঅতুলকৃষ্ণ সুর।’
তারপর অনেক বছর কেটে গেল; ভারতের ইতিহাসের ওপর প্রাকবৈদিক সভ্যতার প্রভাব যে কতখানি, তা আমাদের ঐতিহাসিকরা বুঝলেন না। গতানুগতিক ভাবে ভারতের ইতিহাস রচিত হতে লাগল, মাত্র বৈদিক যুগের আগে সিন্ধু সভ্যতা সম্বন্ধে একটা অধ্যায় যোগ করে দিয়ে।
আমি যখন মহেঞ্জোদারোয় যাই, তখন নগরীর যে অঞ্চলে খননকার্য চলছিল, তার নামকরণ করা হয়েছিল : DK Area-Intermediate III period। মহেঞ্জোদারোর প্রশস্ত রাজপথ ও সমান্তরাল রাস্তাগলি সে বৎসরই আবিস্কৃত হয়েছিল। প্রশস্ত রাজপথটি উত্তর-দক্ষিণমুখী। রাজপথটি তখন মাত্র এক কিলোমিটার পর্যন্ত খুড়ে বের করা হয়েছে। রাজপথটি ৩১ থেকে ৩৬ ফুট প্রশস্ত, আর সমান্তরাল পথগালি ২০ থেকে ২৫ ফুট। সে বৎসর আরও আবিস্কৃত হয়েছিল নগরীর পয়ঃপ্ৰণালী। পোড়া ইট দিয়ে তৈরী এই পয়ঃপ্রণালী অনেকটা পথ রাস্তার পশ্চিম ধার দিয়ে এসে, এক জায়গায় রাস্তা অতিক্রম করে, রাস্তার পূর্ব পাশ ধরে চলে গিয়েছিল। বাড়ির দূষিত জল এই পয়ঃপ্রণালীতে এসে পড়ত, তবে অনেক বাড়িতে ‘সোক্পিট’ও ছিল। প্রতি বাড়ির প্রবেশ পথ দিয়ে ঢুকলেই সামনে পড়ত বাড়ির প্রাঙ্গণ। প্রবেশ পথের নিকট প্রাঙ্গণের এক পাশে থাকত বাড়ির কূপ। স্নানের সময় আবরু রক্ষার জন্য কূপগুলিকে দেওয়াল দ্বারা বেষ্টিত করা হত। রাজপথের দিকে বাড়ির যে দোকানঘরগুলি ছিল, তার অনেকগলির সামনে আমরা আবিষ্কার করেছিলাম ইটের গাঁথা পাটাতন। বোধহয় এই পাটাতনগলির ওপর বিক্ৰেতারা দিনের বেলা তাদের পণ্যসম্ভার সাজিয়ে রাখত, এবং রাত্রিকালে সেগালিকে দোকান-ঘরে তুলে রাখত। ছোট ছোট যে সব দ্রব্যসামগ্ৰী আমরা সে বৎসর পেয়েছিলাম, তার মধ্যে ছিল মেয়েদের মাথার কাঁটা। তা থেকে আমরা সহজেই অনুমান করেছিলাম যে, মেয়েরা খোঁপা বাঁধত ও খোঁপায় কাঁটা গুঁজত। তবে মেয়েরা যে বেণী ঝুলিয়েও ঘুরে বেড়াত, তার প্রমাণও আমরা পেয়েছিলাম।
ব্যাপকভাবে খননকার্যের ফলে এখন হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো ছাড়া তামাশ্ম যুগের সভ্যতার আরও অনেক কেন্দ্র খুঁজে বের করা হয়েছে। এর ফলে আমরা জানতে পেরেছি যে এই সভ্যতার বিকাশ পনেরো লক্ষ বর্গ মাইল ব্যাপী এক বিস্তৃত এলাকায় ঘটেছিল। ১৯৪৭ খ্রীস্টাব্দে দেশ-বিভাগের পর এই সকল কেন্দ্রের কিছু পাকিস্তানে ও কিছু ভারতের মধ্যে পড়েছে। সিন্ধু সভ্যতার যেসব কেন্দ্র ভারতের মধ্যে পড়েছে সেগালি হচ্ছে–কালিবঙ্গান, লোথাল, রূপার, চণ্ডীগড়, সুরকোটড়া, দেশলপুর, নবিনাল, রঙপুর, ভগৎরাও, মাণ্ড, বরা, বরগাওন, বাহাদারাবাদ, শিশওয়াল, মিটাথাল, আলমগিরপুর, কায়াথা, গিলাণ্ড, টড়িও, দ্বারকা, কিনডারখেদ, প্রভাস, মাটিয়ালা, মোটা, রোজড়ি, আমরাফলা, জেকডা, সুজনপুর, কানাসুতারিয়া, মেহগাওন, কাপড়খেদা ও সবলদা। এছাড়া তামাশ্ম যুগের সভ্যতার নিদর্শন আমরা পেয়েছি–লালকিলা, নোয়া, মানোটি, দৈমাবাদ, মহিষদল, বানেশবরডাঙ্গা, পাণ্ডুরাজার ঢিবি প্রভৃতি স্থান থেকেও। ১৯২৯-৩১ খ্রীস্টাব্দে আমি যখন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈতনিক গবেষক হিসাবে সিন্ধু সভ্যতা সম্বন্ধে অনুশীলন করেছিলাম, তখন আমার প্রতিবেদনের প্রথম অনুচ্ছেদেই বলেছিলাম—‘এ সম্পকে ঝুঁকি নিয়ে একথা বলা যেতে পারে যে পরবর্তীকালে অনুরূপ সভ্যতার নিদর্শন গঙ্গা উপত্যকাতেও পাওয়া যেতে পারে, যার দ্বারা প্রমাণিত হবে যে এ সভ্যতা উত্তর ও প্রাচ্য ভারতেও বিস্তার লাভ করেছিল।’ আজ খননকার্যের ফলে আমার সেই অনুমান বাস্তবে পরিণত হয়েছে।