।।দুই।।
বিপ্লবের জন্য বিদেশে হরদয়ালের নেতৃত্বে এক দল গঠিত হয়। এই দল বিদেশ থেকে ভারতে অস্ত্রশস্ত্ৰ পাঠাবার ব্যবস্থা করে। অস্ত্রশস্ত্র আসছে, এই খবর পেয়ে সেগলো কোন নিভৃত স্থানে নামাবার জন্য যাদুগোপাল মুখুজ্যে যান সুন্দরবনে ও যতীন মুখুজ্যে যান বালেশ্বরে। বালেশ্বরে যতীন মুখুজ্যের কাছে বাটাভিয়ায় অবস্থিত সহানুভূতিশীল জারমান সরকারের প্রতিভূরা বিপ্লবে সাহায্য করবার জন্য টাকা পাঠাতে থাকে। কিন্তু শেষ কিস্তির দশ হাজার টাকা ব্রিটিশ সরকারের হাতে গিয়ে পড়ে। সেই সূত্র ধরে পুলিস যতীন মুখুজ্যের তল্লাসে বেরিয়ে পড়ে। বুড়িবালামের তীরে যতীন মুখুজ্যে ও তার সহকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের এক ভীষণ যুদ্ধ হয়। পুলিশের সঙ্গে সর্ব শক্তি দিয়ে যতীন মুখুজ্যে লড়ে যান। তিনি আহত হন। আহত অবস্থায় হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়।
এদিকে রাসবিহারী বসু, ভারতীয় সৈন্যবাহিনীকে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে উদ্বুদ্ধ করে। বিদ্রোহের দিন নিদিষ্ট হয় ১৯১৫ খ্রীস্টাবেদার ১৯ ফেব্রুয়ারী তারিখে। কিন্তু রাসবিহারীর দলে কিরপাল সিং নামে পুলিশের একজন গুপ্তচর যোগদান করে। তার মারফত সরকার আগে থাকতেই খবর পেয়ে এ চেষ্টা বিফল করে দেয়।
।।তিন৷৷
রাউলাট আইন ও জালিওয়ানাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পদাঙ্কে ১৯২০ খ্রীস্টাব্দের পর থেকে গান্ধীজী হন ভারতীয় কংগ্রেসের অপ্রতিদ্বন্দী নেতা। গান্ধীজী অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভের পথ ঘোষণা করেন। কিন্তু বিধানসভার মাধ্যমে স্বরাজ লাভের আন্দোলন পরিচালনা করবার জন্য দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ গঠিত করলেন ‘স্বরাজ্য পার্টি’। তাঁরা বিধানসভার মধ্যে নানাভাবে সরকারকে বিপর্যস্ত করে তোলেন।
এর মধ্যে কংগ্রেসের মধ্যে বামপন্থী দলের প্রাদুর্ভাব ঘটল। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠিত হল। বিনয়, বাদল, দীনেশ রাইটাস বিলডিং-এর অভ্যন্তরে সিম্পসন সাহেবকে হত্যা করল। ঢাকায় পুলিশ সুপারিনটনডেণ্ট লোম্যান সাহেবও নিহত হল।
আইন অমান্য করে লবণ প্রস্তুতের উদ্দেশ্যে গান্ধীজী ১৯৩০ খ্রীস্টাব্দে ডাণ্ডি অভিমখে যাত্রা করলেন। ১৯৩২ খ্রীস্টাবেদের মধ্যে আইন অমান্য আন্দোলন দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। দলে দলে লোক কারারুদ্ধ হল।
।।চার।।
তারপর এল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। কংগ্রেস প্রথমে যুন্ধে সহযোগিতার প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু সরকার তাতে সাড়া না দেওয়ায় ১৯৪২ খ্রীস্টাব্দে আবার সত্যাগ্ৰহ আন্দোলন শহর হল। সেদিন সমস্ত দেশবাসী আত্মবলে বলীয়ান হয়ে উচ্চকণ্ঠে বলে উঠল-‘করেংগে ইয়া মরেংগে।’ সরকার নেতৃবন্দকে কারারদ্ধ করল। বিক্ষুব্ধ দেশবাসী সংগ্রাম শহর করল ইংরেজের বিরুদ্ধে। ‘আগস্ট বিপ্লব’ নামে আখ্যাত এই সংগ্রাম তীব্র আকার ধারণ করল মেদিনীপর জেলায়। সতীশচন্দ্র সামন্তের অধিনায়কত্বে বিপ্লবীরা সেখানে প্ৰতিষ্ঠিত করল এক স্বাধীন সরকার। প্রায় দেড় বৎসর ইংরেজ শাসন সেখানে বিলুপ্ত হল। ইংরেজ চালালো অমানুষিক অত্যাচার ও ব্যাপক নারীধর্ষণ, পুলিশের গুলি অগ্রাহ্য করে অপূর্ব দেশপ্রেম ও সাহস দেখাল মাতঙ্গিনী হাজরা। সত্তর বৎসর বয়স্কা এই বীরাঙ্গনা মহিলা ললাটে গলিবিদ্ধ অবস্থায় জাতীয় পতাকা দৃঢ়মুষ্টিতে ধরে মৃত্যুবরণ করল। বাঙলার সর্বত্রই চলল উত্তেজনা ও পুলিশের অকথ্য অত্যাচার।
ইতিমধ্যে লড়াইয়ের মধ্যেই ঘটে গেল এক চমকপ্রদ ঘটনা। ‘আগস্ট বিপ্লব’-এর সময় সুভাষ চন্দ্র বসকে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু অসুস্থতার কারণে তাঁকে জেলখানা থেকে এনে নিজগহে অন্তরীণ করা হল। কিন্ত ইংরেজের চোখে ধুলো দিয়ে তিনি অন্তর্হিত হলেন ১৯৪১ খ্রীস্টাব্দের ১৮ জানুয়ারী তারিখে। আফগানিস্তানের ভিতর দিয়ে তিনি গিয়ে পৌঁছালেন জারমানীতে। সেখান থেকে জাপানে গিয়ে তিনি গঠন করলেন আজাদ হিন্দ ফৌজ। জাপানী সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে আজাদ হিন্দ ফৌজ আক্ৰমণ হানল ব্ৰহ্মদেশের ওপর। তাসের বাড়ির মত টলমল করে পড়ে যেতে লাগল শহরের পর শহর ও গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিসমূহ। নেতাজী এসে উপনীত হলেন আসাম সীমান্তে। ধ্বনি তুললেন–‘দিল্লী চল’, ‘লালকেল্লায় গিয়ে স্বাধীন ভারতের পতাকা তোল।’ কিন্তু যুদ্ধের পর নেতাজী আবার হলেন অদৃশ্য।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অবসান ঘটে ১৯৪৫ খ্রীস্টাব্দের মে মাসে। যুদ্ধে জয়লাভ করলে ভারতকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেবে, এ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ইংরেজ। কিন্ত স্বাধীনতার ব্যাপার নিয়ে বিবাদ বাঁধল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগে। ১৯৪৬ সালের মাৰ্চ মাসে এল ক্যাবিনেট মিশন, হিন্দু মুসলমানের মধ্যে মীমাংসা করবার জন্য। কিন্ত মীমাংসার সব চেস্টাই ব্যর্থ হল। ওরই পদাঙ্কে লাগল হিন্দ-মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গা। নোয়াখালি ও পূর্ব বঙ্গের অন্যত্র দাঙ্গা চরম আকার ধারণ করল। কলকাতাতে দাঙ্গার হাঙ্গামা তরঙ্গে উঠল। ওই দাঙ্গার পদাঙ্কেই দেশ-বিভাগ ও স্বাধীনতা লাভ ঘটল।
হিন্দু সভ্যতার শিকর আবিষ্কার
হিন্দু সভ্যতার ক্ষেত্রে বিগত শতাব্দী চিহ্নিত হয়ে আছে এক অত্যাশচর্য আবিষ্কারের জন্য। সেটা হচ্ছে ১৯২২ খ্রীস্টাব্দে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক সিন্ধু সভ্যতার আবিষ্কার। এই আবিষ্কারের পূর্বে পন্ডিতমহলের বিশ্ববাস ছিল যে আগন্তুক আর্যরাই ভারতীয় সভ্যতার স্রষ্টা। তাঁরা মনে করতেন যে খ্রীস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে আর্যরা পঞ্চনদের উপত্যকায় আসবার পূর্বে, ভারতের লোকরা ছিল অসভ্য ও বর্বর এবং আর্যরাই তাদের সভ্য করে তুলেছিল। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতার আবিষ্কার এক লহমায় প্রমাণ করে দিয়েছিল যে ওই ধারণা একেবারেই ভুল। আর্যরা এদেশে আসবার হাজার বৎসর পূর্বেই এদেশে প্রাদর্ভূত হয়েছিল এক শিক্ষিত নগর সভ্যতা, যার বাহকরা আর্যদের চেয়ে অনেক বেশি সভ্য ছিল। বরং বলা যেতে পারে যে সিন্ধু সভ্যতার বাহকদের তুলনায়, আর্যরাই ছিল এক বর্বর জাতি।