বৈষয়িক সম্পদ বৃদ্ধির অন্তরালে বামফ্ৰণ্ট সরকারের আমলে ঘটেছে শান্তিশৃঙ্খলার অবনতি, রাজনৈতিক দলাদলি, দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ, পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা ও নির্যাতন, মধ্যবিত্ত সমাজের অবলুপ্তি, শিক্ষার সংকট, বাঙলায় অবাঙালীর অবারিত আগমন ও কর্রসংস্থানের ওপর তার প্রতিঘাত, বেকারের সংখ্যাবৃদ্ধি ও জীবনের সর্বক্ষেত্রে বিশঙ্খলতা ও নৈতিক শৈথিল্যে । তাছাড়া বাঙালীর মানবিক সত্তা ক্রমশই হ্রাস পাচ্ছে। নারীনিগ্রহ ও বাধা-নির্যাতনের ক্রমবৃদ্ধিতার দৃষ্টান্ত ।
বস্তুত, সমকালীন সামাজিক বিশৃঙ্খলতা, মানবিক সত্তার হ্রাস ও নৈতিক শৈথিল্যের প্রতি দুটি রেখে মনে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে যে বাঙালীর জীবনচর্যা ও সংস্কৃতির স্বকীয়তা অবক্ষয়ের পথে চলেছে কিনা ? অশন-বসনে, আচার-ব্যবহারে বাঙালী আজ যেমন নিজেকে বহুরূপী করে তুলেছে, তেমনই বর্ণচোরা করেছে তার সংস্কৃতিকে । অতীতের গৌরবময় সংস্কৃতির পরিবর্তে এক জারজ সংস্কৃতির প্রাবল্যই লক্ষিত হচ্ছে ।
।। সাত ।।
এরই মধ্যে ঘটে গিয়েছে বিজ্ঞানের অত্যাশ্চর্য অগ্রগতি । আগের শতকে আমরা পেয়েছিলাম টেলিগ্রাফ, টেলিফোন, বৈদ্যুতিক আলো, পাখা ইত্যাদি । বিংশ শতাব্দীতে আমরা পেয়েছি বেতার, বিমান, খনিজতৈল, মোটরগাড়ি, পরমাণুর ব্যবহার, ইলেকট্রনিকস্, টেলিভিসন, প্লাস্টিকস্ ইত্যাদি। বস্তুত বিজ্ঞান ও প্রযক্তি বিদ্যার সাহায্যে আমরা এমনভাবে এগিয়ে গেছি যে মনে হবে বিজ্ঞানই বঝি বা স্বয়ং ভগবান। ভগবানের দুই সত্ত্বা আছে–তিনি যােগপৎ স্রষ্টা ও সংহারকর্তা। বিজ্ঞােনও তাই। বিজ্ঞান যেমন একদিকে মানুষের কল্যাণ সাধন করছে, অপরদিকে মানুষেকে ধবংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে। জানিনা আগামীকালে মানুষের কপালে কি আছে। কেননা এখন চলেছে প্রকৃতির ওপর আধিপত্যের জন্য বিজ্ঞানের লড়াই। এই বিজ্ঞান বনাম প্রকৃতির লড়াইয়ের ফলাফলের ওপর নির্ভর করছে, হয় মানবসভ্যতার আরও অগ্রগতি, আর তা নয়তো মানুষের সম্পূর্ণ বিলুপ্তি। ( অতুল সুর, ‘মানব সভ্যতার নৃতাত্ত্বিক ভাষ্য’ দ্রঃ)
বিপ্লববাদী সমাজের অভ্যুত্থান
বিগত শতকের সবচেয়ে বড় ঘটনা হচ্ছে ১৯৪৭ খ্রীস্টাব্দে ভারত থেকে ইংরেজের মহাপ্রস্থান ও ভারতের স্বাধীনতা লাভ। সেটা কি করে ঘটেছিল, সেটাই এখানে বলছি।
যদিও স্বাধীনতা লাভের উদ্দেশ্যে জনমত গঠনের জন্য ১৮৮৫ খ্রীস্টাব্দেই ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’ স্থাপিত হয়ে গিয়েছিল, তা হলেও ওটা বিপ্লববাদী সংস্থা ছিল না। জাতীয় কংগ্রেস সহাপনের পাবে। সংঘটিত যে সব ঘটনাকে আমরা স্বাধীনতা লাভের পদক্ষেপ বলে চিহ্নিত করি সেগলো বিপ্লব নয়, বিদ্রোহ মাত্র। প্রকৃত বিপ্লববাদের আগুন জ্বলে ওঠে। বঙ্গভঙ্গকে উপলক্ষ করে। বঙ্গদেশের আয়তন এককালে অনেক বড় ছিল। কিন্তু তাকে ছোট করে আনা হয়েছিল বঙ্গ, আসাম, বিহার, ওড়িষা ও ছোটনাগপুরে। তারপর আসাম প্রদেশকে পথিক করে একজন চীফ কমিশনারের শাসনাধীনে ন্যস্ত করা হয়। মোট কথা নানারকম রাজনৈতিক কারণে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গদেশকে খর্ব করবার অপচেষ্টায় ব্যস্ত ছিল। ১৯০৩ খ্রীস্টাব্দে মধ্যপ্রদেশের চীফ কমিশনার স্যার অ্যানড্রু ফ্লেজার প্রস্তাব করেন যে বঙ্গদেশকে দু’খণ্ডে বিভক্ত করা হউক। প্রস্তাবটা বঙ্গদেশের সবার গভীর অসন্তোষ সৃষ্টি করে। এমন কি ইংরেজ মালিকানাবিশিষ্ট ও ইংরেজ কর্তৃক সম্পাদিত ‘ইংলিশম্যান’ পত্রিকাতেও বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে লেখা হয়। কিন্তু এসব সত্বেও ১৯o৫ খ্রীস্টাব্দের ১৭ অক্টোবর তারিখে বঙ্গদেশকে দ্বিখণ্ডিত করে দেওয়া হয়। পূর্বদিকে সৃষ্টি হল আসাম ও পূর্ব বঙ্গ প্রদেশ ও পশ্চিমে বাকি অংশ। চতুর্দিকে বিদ্বেষের বহ্নি জ্বলে উঠল। বিলাতী পণ্য বর্জন করা হল। যারা বিলাতী জিনিষের দোকানে পিকেটিং করল, তাদের ওপর পুলিশ নিষ্ঠুর অত্যাচার করল। এর প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষিত সমাজের মধ্যে ভীষণ অসন্তোষ প্রকাশ পেল।
আন্দোলন থেকে উদ্ভূত হল জাতীয়তাবাদ, আর জাতীয়তাবাদ এক শ্রেণীর মধ্যে বীজ বপন করল বিপ্লববাদের। বিপ্লববাদ প্রসারের জন্য প্রথম যে সমিতি গঠিত হল, তা হচ্ছে অনুশীলন সমিতি। এর শাখা প্রশাখা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল। এদিকে শ্রীঅরবিন্দের ছোট ভাই বারীন্দ্রের নেতৃত্বে গঠিত হল এক সশস্ত্র বিপ্লবীদল। তারা তাদের গোপন কেন্দ্র করল মানিকতলার খালের ওপারে মুরারীপুকুরে এক নিভৃত বাগানবাড়িতে। বারীন্দ্রের নেতৃত্বে যে দল গঠিত হল, তারা দ’জন সদস্যকে বিদেশে পাঠাল বোমা তৈরী করবার প্রণালী শিখে আসবার জন্য। তারপর মুরারীপুকুরের বাগানবাড়িতে বোমা তৈরির আয়োজন চলতে লাগল। বারীন্দ্রের দলের দজন প্রফাল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম বসু মজাফরপরের দিকে রওনা হল কলকাতার প্রাক্তন প্রেসিডেন্সী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যা করবার জন্য। ভুল করে তারা কিংসফোর্ডের গাড়ির মত দেখতে অন্য একখানা গাড়ির ওপর বোমা নিক্ষেপ করে। নিহত হয় মিস্টার কেনেডি নামে এক আইনবিদের স্ত্রী ও কন্যা। প্রফুল্ল ঘৃত হয় বটে কিন্তু সে আত্মঘাতী হয়। ক্ষুদিরামের বিচার হয় এবং তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
এরপর আসে বিশ্বাসঘাতকের পালা। নরেন্দ্ৰ গোস্বামী নামে দলের একজন সদস্য পুলিসের কাছে গোপন তথ্য সরবরাহ করে বারীন্দ্রের দলকে ধরিয়ে দিয়েছিল। কানাইলাল দত্ত ও সত্যেন বসু নামে দলের দু’জন বন্দী জেলখানার মধ্যেই নরেন্দ্রকে হত্যা করে। বিচারে বারীন্দ্র সমেত ১৪ জন অপরাধী সাব্যস্ত হয়। তাদের যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়। কিন্তু এই সঙ্গে বিপ্লববাদের পরিসমাপ্তি ঘটে না। ১৯০৭ থেকে ১৯১৭ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে ন্যুনাধিক ৬৩ জন নিহত হয়। সংগ্রামের জন্য অর্থসংগ্রহের প্রয়াসে বিপ্লবীদল রাজনৈতিক ডাকাতি শুরু করে। ১৯০৭ থেকে ১৯১৭ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে ১১২টা ডাকাতি হয় এবং ডাকাতরা এভাবে সাত লক্ষ টাকা সংগ্রহ করে।