।। পাঁচ ।।
সবচেয়ে বড় দুর্গতি যা আজ মানুষেকে অভিভূত করেছে তা হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। যারা মূল্যস্ফীতি ঘটাচ্ছে, নেহেরু তাদের ল্যাম্প-পোস্টে ঝলিয়ে মারতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষমতায় আসবার পর দেখা গিয়েছিল যে তাদের সঙ্গেই তিনি হাত মিলিয়ে ফেলেছেন । তাঁর উত্তরাধিকারীরা সেই একই নীতি অনসরণ করে এসেছেন, কেননা সেই ব্যবসায়ীদের বদন্যতার ওপরেই দলের পুষ্টি ও নির্বাচনের সাফল্য নির্ভর করে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের দোষ দিলে হবে না। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সরকার নিজেও মূল্যস্ফীতি ঘটাচ্ছেন। প্রত্যক্ষভাবে সরকার মূল্যস্ফীতি ঘটাচ্ছেন পণ্যদ্রব্যের ওপর কর বসিয়ে, রেলের মাসুল বাড়িয়ে ও পণ্যদ্রব্যের ঊর্ধ্বমূল্য নির্ধারণ করে দিয়ে । আর পরোক্ষভাবে মূল্যস্ফীতি ঘটাচ্ছেন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা সমূহের রূপায়নের জন্য ঘাটতি ব্যয়নীতি অনসরণ করে। এ সবের ফলে বর্তমানে পণ্যদ্রব্যমূল্য এমন স্তরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে তুলনা করলে শতাব্দীর প্রথমার্ধের পণ্যদ্রব্যের মূল্যসমূহ রূপকথার কাহিনী বলে মনে হবে। নেহেরু পণ্যমূল্যের উর্দ্ধগতি দমন করে সাধারণ লোকের জীবন সুখময় করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে পণ্যমূল্য গগনস্পর্শী হয়ে সাধারণ লোকের জীবন কিরকম ক্লেশকর করেছে তা নীচে শতকের দুই অংশের পণ্যমূল্যের তালিকা থেকে প্রতীয়মান হবে ।
পণ্যদ্রব্য | শতকের প্রথমার্ধের মূল্য | শতকের শেষের মূল্য |
চাল (প্রতি মন) | দু’ টাকা ৫০ পয়সা | ৩২০ টাকা |
ডাল (প্রতি সের) | ছ’ পয়সা | ২০ টাকা |
সরষের তেল (প্ৰতি সের) | দশ পয়সা | ৩০ টাকা |
চিনি (প্ৰতি সের) | আট পয়সা | ১৫ টাকা |
ঘি (প্ৰতি সের) | দশ আনা | ২০০ টাকা |
মাংস (প্রতি সের) | ছ’ অনা | ৭২ টাকা |
মাছ (কাটা রই প্রতি সের) | ছ’ আনা | ৭০ টাকা |
ধুতি (মিহি কাপড়) | দু’ টাকা | ৮০ টাকা |
ধনেখালির শাড়ি | তিন টাকা | ২৫০ টাকা |
গত দশ বছরেই দ্রব্যমূল্য দ্বিগুন হয়ে গিয়েছে। এটা সরকারী ‘কনস্যুমার প্রাইস ইনডেকস’ থেকে বুঝতে পারা যাবে । ১৯৮২ সালে সূচকসংখ্যা ছিল ১০০, আর ১৯৯২-তে ২১৯ । মূল্যস্ফীতি দেশের মধ্যে ধনবৈষম্য ঘটিয়েছে । ষাটের দশকে মহলানবীশ কমিটি এই প্রবণতা লক্ষ্য করেছিলেন এবং এ সম্বন্ধে আমাদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন । সে সতর্ক বাণীতে আমরা কর্ণপাত করিনি। ফলে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সঙ্গে ধনবৈষম্য বিরাট আকারে প্রকট হয়েছে ।
।। ছয় ।।
শতাব্দীর পূর্বার্ধের রাজনৈতিক পরিস্হিতি পরবর্তী প্রবন্ধে আলোচিত হয়েছে। এবার শতাব্দীর শেষাধের রাজনৈতিক পরিস্থিতিটার দিকে তােকানো যাক । ১৯৪৭ খ্রীস্টাব্দের স্বাধীনতা লাভের শোচনীয় শর্ত হিসাবে বঙ্গদেশ দ্বিখণ্ডিত হয়–পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্বপাকিস্তান। পশ্চিমবঙ্গ জন্মগ্রহণ করেছিল অনেক সমস্যা নিয়ে । যুক্তবাঙলার অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে ছিল একটা ভারসাম্য। পূর্ববাঙলা ছিল কৃষিপ্রধান, সেজন্য পূর্ববাঙলা ছিল খাদ্যশস্য ও কাঁচামালের আড়ত। আর পশ্চিমবঙ্গ ছিল শিল্প প্রধান । পশ্চিমবঙ্গকে খাদ্যশস্য ও কাঁচামালের জন্য পূর্ববাঙলার ওপর নির্ভর করতে হত । দ্বিখন্ডিত হবার পর এই আৰ্থিক ভারসাম্য ভেঙে পড়ে । তারপর পশ্চিমবঙ্গ ছিল ঘনবসতিবহুল অংশ । তার মানে, আগে থেকেই এখানে ছিল বাসস্থানের অভাব । সে অভাবকে ক্রমশই তীব্রতর করে তুলেছিল অন্য প্রদেশ থেকে আগত জনসমুদ্র । এই সমস্যাকে আরও উৎকট করে তুলল যখন নিরাপত্তার কারণে লক্ষ লক্ষ হিন্দু পূর্ববাঙলা থেকে পশ্চিমবাঙলায় এল।
যখন পশ্চিমবঙ্গ সৃষ্টি হল, তখন প্ৰফুল্ল চন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে এক ‘ছায়া মন্ত্রি পরিষদ’ রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করল। কিন্তু চার-পাঁচ মাসের মধ্যেই সেই মন্ত্রিসভা ভেঙে পড়ল। ১৯৪৮ খ্রীস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করলেন। স্বাভাবিক ভাবে পশ্চিমবঙ্গ যেসব উৎকট সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল, সেগুলির সমাধান এই নতুন মন্ত্রিসভার ঘাড়ে চেপে বসল। নিরবিচ্ছিন্নভাবে তাঁর মৃত্যুকাল পর্যন্ত আঠারো বছর মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন বিধানচন্দ্র পশ্চিমবঙ্গের সমস্যাগুলি একে একে সমাধান করে ফেললেন।
১৯৬২ খ্রীস্টাব্দের ১ জলাই বিধান রায়ের মাতুত্যুর পর কংগ্রেস নেতা প্রফুল্লচন্দ্র সেন নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করেন। কিন্তু তাঁর অনুসৃত খাদ্যনীতি জনমতের বিরুদ্ধে যাওয়ায়, ১৯৬৭ খ্রীস্টাব্দের নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন ও অজয় মুখার্জির নেতৃত্বে এক যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হয়। কিন্তু তা ক্ষণস্থায়ী হওয়ায় ড. প্রফাল্ল চন্দ্র ঘোষ এক নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করেন । তা-ও স্বল্পকালস্থায়ী হওয়ায় ১৯৬৮ খ্রীস্টাব্দের ২০ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতির শাসন জারি হয়। ১৯৬৯ খ্রীস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে অজয় মুখার্জির নেতৃত্বে বামফ্ৰণ্ট সরকার গঠিত হয়। মাত্র এক বছরের বেশি এ-সরকার স্থায়ী হয় না । ১৯৭০ খ্রীস্টাব্দের ১৯ মার্চ আবার রাষ্ট্রপতির শাসন প্রবর্তিত হয় । ১৯৭১ খ্রীস্টাব্দের এপ্রিল মাসে অজয় মুখার্জির নেতৃত্বে এক ডেমোক্ৰেটিক কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয় । কিন্ত দু’মাস পরে ( জুন ১৯৭১) তা ভেঙে পড়ে। তখন ( ৩০ জুন ১৯৭১) আবার রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করা হয় । ১৯৭২-এর মার্চ মাসে সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ে্র নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকার গঠিত হয়। ১৯৭৭ খ্রীস্টাব্দের নিবাচনে ‘বামফ্রন্ট’ দল সাফল্য অর্জন করাতে জ্যোতি বসু, ‘বামফ্রন্ট সরকার’ গঠন করেন । এই বামফ্রন্ট সরকারই এখনও পর্যন্ত ক্ষমতাসীন আছে ।