।। তিন ।।
শতাব্দীর প্রথমার্ধটা ছিল অত্যন্ত সুখস্বাচ্ছন্দ্যের যােগ । জিনিসপত্তরের দাম ছিল খুবই সস্তা । শতাব্দীর সূচনায় চালের দাম ছিল এক টাকা মন । তবে বঙ্গাব্দ প্রথম দশকের গোড়ার দিকে বুয়ার যুদ্ধের জন্য দাম বেড়ে দেড় টাকা থেকে দু’টাকা হয়েছিল । চল্লিশের দশকে (দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের গোড়ার দিকে গুণাগুণ অনুযায়ী) চালের দাম ছিল আড়াই টাকা থেকে সাড়ে তিন টাকা মন । অধিকাংশ ডালের দাম ছিল ছ’ পয়সা সের। আটা দু’ পয়সা সের, ময়দা চার পয়সা সের, সর্ষের তেল দশ পয়সা সের, চিনি দু’ আনা সের, আর ভাল ভয়সা ঘি দশ আনা সের । মাখন আট আনা সের, মাংস ছ’ আনা সের । বাগদা, ট্যাংরা, পারসে ইত্যাদি মাছ চার আনা সের। কাটা রুই মাছ ছ’ আনা সের। দশ হাতি লাট্টূ মার্কা ভাল বিলিতি কাপড় দেড় টাকা থেকে সাত সিকা জোড়া। এখনকার এক টাকা দামের রসগোল্লার নাম ছিল ‘রসমুণ্ডি’। এক পয়সায় চারটে রসমুণ্ডি পাওয়া যেত। ফাউ চাইলে দোকানদার আরও একটা ফাউ দিত । আর বাকি সব রকম খাবার ছিল ছ’ আনা সের। এসব দাম ১৯৪২ খ্রীস্টােব্দ পর্যন্ত ( বঙ্গাব্দ শতকের প্রথমার্ধ পযন্ত) চাল ছিল । তখনও কলকাতা শহরে ‘পাইস হোটেল’- এর অস্তিত্ব ছিল । এসব হোটেলে এক পয়সার বিনিময়ে ভাত, ডাল, তারকারী, চাটনি পাওয়া যেত। কাপড়চোপড়ও ১৯৪২ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত আগেকার মতই ছিল । তবে তখন বিলিতি কাপড়ের পরিবর্তে এখানকার মিলের কাপড় পরার রীতি হয়েছিল । ১২০-কাউণ্ট সুতোর মিহি ধুতির দাম ছিল সাত সিকে ও শাড়ীর দাম দু’টাকা চার আনা জোড়া। আর ধনেখালির উৎকৃষ্ট শাড়ী তিন টাকা থেকে সাড়ে তিন টাকায় পাওয়া যেত ।
ছেলেদের লেখাপড়ার খরচও ছিল খুব কম। স্কুলের মাইনে ছিল। মাসিক এক আনা থেকে শুরু করে ম্যাট্রিকুলেশন (সকল ফাইনাল ) ক্লাসে দু’টাকা । কলেজের মাইনে এক টাকা (ক্ষুদিরাম বাবুর সেনট্রাল কলেজে ) থেকে শুরু করে পাঁচ টাকা ( স্কটিশ চার্চ কলেজে ) । বিশ্ববিদ্যালয়ের এম. এ ক্লাসের মাইনে ছিল আট টাকা। পরীক্ষার ফি ছিল পনের থেকে পঁচিশ টাকা । আমার প্রথম বছরে লেখাপড়া করতে মোট খরচ হয়েছিল চোদ্দ আনা পয়সা–মাসিক এক আনা হিসাবে এক বৎসরের মাইনে বারো আনা, একখানা বর্ণপরিচয় দু’পয়সা, একখানা ধারাপাত দু’ পয়সা, একখানা শ্লেট তিন পয়সা ও শ্লেট-পেনসিল এক পয়সা । আজকালকার মত বছরে বছরে পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তিত হত না । একবার পাটিগণিত, বীজগণিত ও জ্যামিতির বই কিনলে দু-চার পুরুষ তা পড়ত।
ডাক মাসুলের খরচও খুব কম ছিল । পোস্টকার্ড এক পয়সা, খাম দ’ পয়সা, রেজিস্ট্রেশন খরচ দু’ আনা ও বিলেতে চিঠি পাঠাতে খরচ হত দশ পয়সা । পোস্ট আপিসের কর্মকুশলতা ছিল অদ্ভূত। আজ সকালে আটটার মধ্যে কলকাতা থেকে ব্যারাকপরের ঠিকানায় চিঠি পোস্ট করলে, তা বেলা তিনটার সময় সেখানে বিলি হত, এবং সেখান থেকে তার জবাব পাঁচটার মধ্যে পোস্ট করলে কাল সকালে আটটার মধ্যে তা কলকাতায় বিলি হত । আর আজকের একটা নমুনা দিচ্ছি। একখানা চিঠি আমার নামে এবছর ২ ফেব্রুয়ারি তারিখে লেনিন সরণী থেকে পোস্ট করা হয়েছে। ষোল আনা শুদ্ধ ঠিকানা থাকা সত্ত্বেও চিঠিখানা পেলাম ১০ এপ্রিল তারিখে ।
।। চার ।।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় আবির্ভূত হল মহামন্বন্তর। যুদ্ধ দেশের দোরগোড়া পর্যন্ত প্রসারিত হওয়ার ফলে, সৈন্যবাহিনীকে খাওয়ানোর জন্য সরকার চাল ‘কর্ণার’ করল । দেশে চাল দুষ্প্রাপ্য হওয়ায় অন্নাভাবে গ্রাম থেকে ভূমিহীন কৃষকের দল ছুটে এল রাজধানী শহরের দিকে । এখানে অনাহারে কলকাতার রাজপথে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করল হাজার হাজার নরনারী ও শিশু। তারই পদাঙ্কে রেশনিং প্রথা চাল করা হল । সঙ্গে সঙ্গে চোরাবাজারীদের আবির্ভাব ঘটল । ফলে জিনিসপত্তরের দামের সামান্য কিছ হেরফের হতে লাগল। পণ্ডিত নেহরু, তখন গদি পাননি। জিনিসপত্তরের মূল্যের উর্দ্ধগতি দেখে তিনি তো চটে লাল। উত্তেজিত হয়ে তিনি বললেন–‘আমি যদি কোনদিন ক্ষমতায় আসি, তাহলে চোরাবাজারীদের ল্যাম্প-পোস্টে ঝুলিয়ে তাদের গলা কেটে দেব ।’ ১৯৪৭ খ্রীস্টাব্দের পনের আগস্ট ভারত স্বাধীনতা পেল । পণ্ডিত নেহেরুই প্রধানমন্ত্রী হলেন । পনেরো আগস্টের মধ্যরাত্রে তিনি জাতির প্রতি ভাষণে বললেন, ‘আমাদের দীর্ঘদিনের অধীনতা, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ও তার অনবতী ঘটনাসমূহের ফলে, আমরা জীবনের অনেক পঞ্জীভূত গুরুতর সমস্যার উত্তরাধিকারী হয়েছি । আজ আমাদের দেশের লোকের খাদ্য, বসন, ও নিত্য আবশ্যকীয় দ্রব্যসামগ্রীর অভাব রয়েছে । আমরা মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যবৃদ্ধির নাগপাশে বদ্ধ হয়েছি। আমরা বিচক্ষণতার সঙ্গে এসব সমস্যার সমাধান করতে চাই, যাতে সাধারণ লোকের ক্লেশের বোঝা হ্রাস পায় ও তাদের জীবনযাত্রার মানবৃদ্ধি পায় ।’
নেহরুর এই প্রতিশ্রুতি সাফল্যমণ্ডিত করবার জন্য ১৯৫১ সাল থেকে শুরু করে আমরা সাতটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ও তিনটি বার্ষিক যোজনা ইতিমধ্যে রচিত ও রূপায়িত করেছি। বর্তমানে অষ্টম পরিকল্পনা রূপায়িত হচ্ছে। সপ্তম পরিকল্পনার শেষ পযন্ত আমরা খরচ করেছি ৫৪৪,২৭৬ কোটি টাকা । অষ্টম পরিকল্পনার জন্য বরাদ্দ হয়েছে ৮,৭২,১০০ কোটি টাকা । কিন্তু এই বিপুল অর্থব্যয় করেও আমরা দরিদ্র দেশবাসীর অদৃষ্ট ফেরাতে পারিনি। বরং পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে আমরা আরও দরিদ্র হয়ে পড়েছি । মূল্যস্ফীতি সাধারণ লোকের জীবনকে অতিষ্ট করে তুলেছে। সরকার অবশ্য বলবেন যে আমরা অনেক বিষয়ে এগিয়ে গেছি। কিন্তু সাধারণ লোকের জীবন যে আগেকার তুলনায় সুখময় হয়নি, সে সম্বন্ধে কোন বিতর্কই নেই। দেশের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত একই রব অনুরাণিত হচ্ছে–‘ম্যায়। ভুখা হুঁ।’ ধনী আরও বেশি ধনী হয়েছে, দরিদ্র হয়েছে দরিদ্রতর। মধ্যবিত্ত সমাজের অবলুপ্তি ঘটেছে ।