বেদোত্তর যুগে নিষ্ঠাবান হিন্দুসমাজে বিবাহ নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল স্মৃতিশাস্ত্রসমূহ দ্বারা। তাদের মধ্যে প্রাধান্য লাভ করে মনুর মানবধর্মশাস্ত্র। মনুর বিধানসমূহের ভিত্তিতে যে আদর্শ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল, সে আদর্শ গঠিত হয়েছিল নিম্নলিখিত বিধানসমহ নিয়ে।
(১) বিবাহ নিম্পন্ন হবে মন্ত্রপাঠ, যজ্ঞ সম্পাদন ও সপ্তপদীগমন দ্বারা।
(২) জাতি নির্বিশেষে সকলকেই পুত্র উৎপাদনের জন্য বিবাহ অবশ্যই করতে হবে।
(৩) কন্যার বিবাহ দিতে হবে সে ঋতুমতী হবার পূর্বে।
(৪) বিবাহ সংঘটিত হবে জাতির মধ্যে।
(৫) বিবাহ সগোত্রে, সপ্রবরে ও সপিণ্ডদের মধ্যে হতে পারবে না।
(৬) বিবাহিতা নারীকে সতীত্বের সমস্ত বিধান অনসরণ করে পতিব্ৰতা হয়ে থাকতে হবে।
(৭) স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবাকে সধবার ভূষণ পরিহার করে ব্রহ্মচর্য পালন করতে হবে (পরে সহমরণ অনুসৃত হত)।
(৮) পরাস্ত্রীগমন ব্যাভিচার বলে গণ্য হবে এবং তার জন্য ব্যভিচারীকে গুরুদন্ড পেতে হবে।
।।দুই।।
সাম্প্রতিককালে, গণতন্ত্রের প্রভাবে হিন্দুরর বিবাহ জীবনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে। এর সূচনা করেছিলেন রাজা রামমোহন রায়। সনাতনী হিন্দু সমাজের ঘোর বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি সক্ষম হয়েছিলেন সতীদাহ প্রথা নিবারণ করতে। তিনি বড়লাট লর্ড উইলিয়াম বেনটিঙ্ককে সম্মত করেন ১৮২৯ সালে ২৭ নং আইন বিধিবদ্ধ করতে। এই আইন দ্বারা সতীদাহ চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। তারপর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আন্দোলনের ফলে ১৮৫৬ সালে ১৫ নং আইন বিধিবদ্ধ হয়। এই আইন দ্বারা বিধবার বিবাহ বৈধ করা হয়। তারপর ১৮৭২ সালের ৩ নং আইন দ্বারা অসবৰ্ণ বিবাহের বাধাও দূর করা হয়। তবে এই আইন অনযায়ী বিবাহ করতে হলে বিবাহ ইচ্ছুক উভয় পক্ষকেই শপথ করতে হত যে তারা হিন্দু নন। কিন্তু ১৯২৩ সালের ৩০ নং আইন দ্বারা বিধান দেওয়া হয় যে অহিন্দু বলে ঘোষণা না করেও অসবৰ্ণ বিবাহ করা যাবে। ১৮৯১ সালের ‘এজ অফ কনসেন্ট অ্যাক্ট’ দ্বারা বিবাহে সঙ্গমের ন্যুনতম বয়স নিদর্ধারিত হয়। এরপর বর্তমান শতাব্দীর বিশের দশকে রায় বাহাদুর হরবিলাস সরদা বদ্ধপরিকর হন হিন্দু সমাজে বাল্যবিবাহ রোধ করবার জন্য। ১৯২৯ সালের ১৯ নং আইনে নিদেশ দেওয়া হয় যে হিন্দু বিবাহে ছেলের উপযুক্ত বয়স ন্যূনপক্ষে ১৮ ও মেয়ের বয়স ১৫ হওয়া চাই। (বর্তমানে ইহা বৃদ্ধি করে ২১ ও ১৮ করা হয়েছে)।
হিন্দ বিবাহ সংস্কারের জন্য দুটি বড় রকমের আইন বিধিবদ্ধ হয় ১৯৪৬ সালে। ওই বৎসর ১৯ নং আইন দ্বারা, স্ত্রীকে অধিকার দেওয়া হয় অবস্থাবিশেষে স্বামী ত্যাগের জন্য। স্বামী যদি কুৎসিত ব্যাধিতে ভোগেন, বা স্বামী স্ত্রীর প্রতি এমন নিষ্ঠুর ব্যবহার করেন যাতে স্ত্রীর নিরাপত্তার অভাব ঘটে, বা স্ত্রীকে পরিত্যাগ করেন অথবা আবার বিবাহ করেন বা নিজ বাসগহে রক্ষিতা এনে রাখেন, বা ব্যভিচারে লিপ্ত হন কিংবা ধর্মান্তর গ্রহণ করেন, তাহলে ওই আইনের বলে স্ত্রী স্বচ্ছন্দে স্বামী ত্যাগ করে স্বতন্ত্র বসবাস করতে পারে। আর ২৮ নং আইনে নির্দেশ দেওয়া হয় যে সগোত্রে ও সমপ্রবারে বিবাহ বৈধ। স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৪৯ সালের ২১ নং আইন দ্বারা বিবাহ ক্ষেত্রে জাতিগত বর্ণগত, শ্রেণীগত ও সম্প্রদায়গত যত রকম বাধা-বৈষম্য ছিল, তা দূরীভূত করা হয়।
বিবাহ সম্পর্কে শেষ আইন বিধিবদ্ধ হয়েছে ১৯৫৫ সালে। এটাই হচ্ছে বিবাহ সম্বন্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপণ আইন। এই আইনটিকে হিন্দু বিবাহ বিধি বা ১৯৫৫ সালের ২৫ নং আইন বলা হয়। বৈধ বিবাহের যে সকল শর্ত এতে নির্দিষ্ট হয়েছে সেগুলি হচ্ছে—
(১) বিবাহকালে স্বামীর স্ত্রী বা স্ত্রীর অন্য স্বামী জীবিত থাকবে না।
(২) উভয়পক্ষের কেহই পাগল বা জড়বুদ্ধিসম্পন্ন হবে না।
(৩) ন্যূনপক্ষে বরের ১৮, (এখন ২১) ও কনের ১৫ (এখন ১৮) বৎসর বয়স হওয়া চাই।
(৪) উভয়পক্ষের কেহই নিষিদ্ধ নিকট আত্মীয়ের মধ্যে হবে না।
(৫) উভয়ের কেহই সপিণ্ড হবে না।
(৬) যেখানে কনের বয়স ১৫ (এখন ১৮) বছরের কম, সেখানে অভিভাবকের সন্মতির প্রয়োজন হবে।
এই আইনে আরও বলা হয়েছে যে সিদ্ধ বিবাহ অসিদ্ধ বলে সাব্যস্ত হবে–
(১) যদি স্বামী পুরুষত্বহীন হয়।
(২) যদি বিবাহের সময় কোন পক্ষ পাগল বা জড়বুদ্ধিসম্পন্ন হয়।
(৩) যদি প্রতারণা দ্বারা বা বলপূর্বক অভিভাবক দ্বারা দরখাস্তকারীর সম্মতি নেওয়া হয়ে থাকে।
(৪) যদি বিবাহের পূর্বে স্ত্রী স্বামী ব্যতীত অন্য কারোর দ্বারা গর্ভবতী হয়ে থাকে।
(৫) যদি অন্য স্ত্রী বা স্বামী বিদ্যমান থাকায় বিবাহ হয়ে থাকে।
(৬) যদি নিষিদ্ধ নিকট আত্মীয়ের মধ্যে বিবাহ হয়ে থাকে।
এছাড়া নিম্নলিখিত কারণগুলির মধ্যে যে কোন একটি কারণ দেখাতে পারলে আদালত বিবাহ বিচ্ছেদের আদেশ দিতে পারে–
(১) স্বামী বা স্ত্রী কেউ ব্যভিচারে লিপ্ত হয়।
(২) ধর্মান্তর গ্রহণের ফলে যদি আর হিন্দু না থাকে।
(৩) আদালতের কাছে বিবাহ ভঙ্গের জন্য দরখাস্ত করবার পূর্বে ক্ৰমান্বয়ে তিন বৎসর স্বামী বা স্ত্রী কেউ যদি বিকৃত মস্তিষ্ক হয়।
(৪) ওই রকম তিন বৎসর কাল যদি স্বামী বা স্ত্রী অনারোগ্য কুষ্ঠব্যাধিতে আক্ৰান্ত হয়ে থাকে।
(৫) ওই রকম তিন বৎসর কাল স্বামী বা স্ত্রী কেউ যদি কোন সংক্ৰামক যৌন ব্যাধিতে আক্ৰান্ত হয়।