বৰ্গীর হাঙ্গামা ঘটেছিল পলাশীর যুদ্ধ ও ইংরেজদের দেওয়ানী পাবার আগে । ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ঘটে দেওয়ানী পাবার চার-পাঁচ বছর পরে। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময়ই ইংরেজ শাসনের শোষক রূপটা ফুটে ওঠে। এরকম ভয়াবহ ও মর্মান্তিক দুর্ভিক্ষ বাঙলা দেশের ইতিহাসে আর কখনও ঘটেনি। ১৭৬৮ খ্রীস্টাব্দে অনাবৃষ্টির জন্য চালের ফলন কম হয় । তার ফলে ১৭৬৯ খ্রীস্টাব্দের গোড়া থেকেই চালের মূল্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। দুর্ভিক্ষের আশঙ্কায় ইংরেজ সরকার সৈন্যবাহিনীর জন্য ৬০ হাজার মণ চাল বাজার থেকে কিনে নেয়। সঙ্গে সঙ্গে কোম্পানির কর্মচারীরাও ফটিকাজনিত মুনাফা লোভের আশায় বাজার থেকে চাল সংগ্রহ করতে থাকে। এর ফলেই ১৭৭০ খ্রীস্টাব্দে এক ভয়াবহ দুর্তিক্ষের আবির্ভাব হয়, যার বৰ্ণনা হাণ্টারের ‘অ্যানালস্ অভ্ রুরাল বেঙ্গল’ ও বঙ্কিমের ‘আনন্দমঠ’-এ পাওয়া যায়। মন্বন্তরের পরের দু’বছর বাঙলা আবার শস্য-শ্যামলা হয়ে উঠেছিল। লোক পেট ভরে খেতে পেল বটে, কিন্তু লোকের আর্থিক দুৰ্গতি চরমে গিয়ে পৌঁছাল । অত্যধিক শস্যফলনের ফলে কৃষিপণ্যের দাম এমন নিম্নস্তরে গিয়ে পৌঁছােল যে হাণ্টার বলেছেন যে হাটে শস্য নিয়ে গিয়ে বেচে গাড়ী ভাড়া তোলাই দায় হল। এদিকে ইংরেজ তার শোষণ নীতি পূর্ণোদ্যমে চালাতে লাগল, এবং তার জন্য নির্যাতনও বাড়তে লাগল। শুধু তাই নয় খাজনার পরিমাণও বাড়িয়ে দিল। কিন্তু বাড়ালে কি হবে ? আধা রাজস্ব আদায় হল না। কৃষকের দুৰ্গতির পূরিসীমা রইল না। জমিদাররা খাজনা দিতে না পারায়, তাদের জমিদারীসমূহ নিলামে উঠল।
।। দশ ।।
এবার গ্রামীন জীবনচৰ্যা সম্বন্ধে কিছু বলব। বিভিন্ন জাতির এক একটা কৌলিক বৃত্তি ছিল। কৌলিক বৃত্তিধারী এই সকল জাতিরাই ছিল সমাজের ‘টেকনোলজিস্টস্’ বা মেরুদণ্ড। তবে ধনগরিমায় সমাজের শীর্ষে ছিল বণিক সম্প্রদায়। সাধারণ লোক ধন-দৌলতের মধ্যে অবগাহন না করলেও সুখস্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে বাস করত। সকল জাতির লোকেরাই চাষবাস করত। সুফলার বছরে কারুরই অন্নকষ্ট হত না । পুকুর থেকে পেত প্রয়োজনীয় মাছ, গোয়াল থেকে দুধ ও নিজ বাগিচা থেকে শাক-সবজী। সকলেই সূতা কাটত ও তা দিয়ে কাপড় বুনিয়ে নিত। সাধারণ লোকের ছিল ধুতি ও চাদর বা গামছা । মেয়েরা পরত শাড়ী । তাদের কোন রকম অন্তর্বাস বা উত্তরবাস ছিল না | শাড়ীখানাই ওপরের অঙ্গে জড়িয়ে ঘোমটা দিত। অন্তর্বাস ছিল না বলে শাড়ীর মধ্যভাগে পাছার কাছে আর একটা পাড় থাকত। এরূপ শাড়ীকে পাছাপাড় শাড়ী বলা হত ।
তবে বিত্তশালী সমাজের পোশাক-আশাক অন্য রকমের হত। তারা প্রায়ই রেশমের কাপড়, পায়ে ভেলভেটের ওপর রূপার কাজ করা জুতা, কানে কুণ্ডল, দেহের ওপর অংশে আঙরাখা, মাথায় পাগড়ি ও কোমরের নীচে কোমরবন্ধ পরত। পুরুষরা দেহ চন্দনচর্চিত করত, আর মেয়েরা স্নানের সময় হলুদ ও চূর্ণ চুৰ্ণ দিয়ে দেহমার্জিত করত। মাথার কেশপাশ আমলকীর জলে ধৌত করত। অভ্রের চিরুনি দিয়ে মাথা আঁচরাত ও নানারকম খোঁপা বাঁধত ।
সধবা মেয়েরা সকলেই হাতে নোয়া ও শাঁখা পরত। তাছাড়া থাকত হাতে কঙ্কণ, পায়ে মল, কোমরে গোট, গলায় হার, কানে মাকড়ি, নাকে নোলক ও নথ।
মেয়ে পুরুষ নির্বিশেষে দিনের বেলা সকলেই কাজকর্মে ব্যস্ত থাকত। রাত্ৰিবেলা মঙ্গলকাব্য বা পৌরাণিক উপাখ্যান অবলম্বনে রচিত পাঁচালী গান শুনত। এ ছাড়া ছিল নানারকম বারব্রত ও পালপার্বণ। দোল দুর্গোৎসবের সময় মহাঘাটা হত। দুটা লৌকিক পাৰ্বণও ছিল। একটা অরন্ধন ও আর একটা পৌষপার্বণ। এছাড়া ছিল অনেক সামাজিক অনুষ্ঠান যথা বিবাহ, শ্ৰাদ্ধ, মেয়েদের সাধ, রজঃদর্শন, অন্নপ্রাশন, উপনয়ন, নামকরণ, বিদ্যারম্ভ, আটকৌড়ে, চারকৌড়ে ইত্যাদি। বিবাহে কন্যাপণ দেওয়াই রীতি ছিল, তবে কুলীন ব্ৰাহ্মণরা বরপণ পেতেন। কৌলীন্য প্ৰথা দ্বারা সমাজ ভীষণভাবে কলুষিত ছিল। কুলরক্ষার জন্য কুলীন পাত্রের সঙ্গে মেয়ের বিবাহ দিয়ে নিজের কুলরক্ষা করতে হত । প্ৰায়ই কুলীন ব্ৰাহ্মণগণ অগণিত বিবাহ করত ও স্ত্রীকে তার পিত্ৰালয়েই রেখে দিত। ভারতচন্দ্ৰ তার ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্যে লিখেছেন–“আর রামা বলে আমি কুলীনের মেয়ে। যৌবন বহিয়া গেল বর চেয়ে চেয়ে ।। যদি বা হইল বিয়া কতদিন বই। বয়স বুঝিলে তার বড় দিদি হই ।। বিয়াকালে পণ্ডিতে পণ্ডিতে বাদ লাগে। পুনর্বিয়া হবে কিনা বিয়া হবে আগে ।। বিবাহ করেছে সেটা কিছু ঘাটিষাটি। জাতির যেমন হৌক কুলে বড় আঁটি ।। দু’চারি বৎসরে যদি আসে একবার। শয়ন করিয়া বলে কি দিবি ব্যাভার ।। সুতা বেচা কড়ি যদি দিতে পারি তায়। তবে মিষ্ট মুখ নহে রুষ্ট হয়ে যায় ॥” এছাড়া আঠারো শতকের সমাজে ছিল বাল্যবিবাহ, শিশুহত্যা, সতীদাহ, দেবদাসী প্রথা ও দাসদাসীর কেনাবেচা ।
।। এগার ।।
এই গ্রামীণ সমাজের কাছে তাদের ধনাগরিমার ডাঁট দেখাবার জন্যই অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে কলকাতায় গঠিত হয়েছিল এক নাগরিক সমাজ। এই সমাজের সমাজপতিরা বাঙলার প্রাচীন বনিয়াদী পরিবারের লোক ছিলেন না । এঁৱা সামান্য অবস্থা থেকে দেওয়ানী, বেনিয়ানী, খোসামুদী, দালালী, নারী সংঘটন ও নানারকম চক্রান্তে যোগ দিয়ে, ইংরেজদের অনুগ্রহ লাভ করে কলকাতার অভিজাত পরিবারসমূহের প্রতিষ্ঠাতা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। এই অভিজাত পরিবারের লোকদের ‘বাবু’ বলা হত। রাত্রে বাড়ীতে থাকা তারা অভিজাত্যের হানিকর মনে করতেন। বারবনিতার গৃহেই তারা রাত্রিটা কাটাতেন। শহরে বারবনিতার প্রসারে তারাই ছিলেন সহায়ক। পরবর্তী শতাব্দীর নবজাগরণ এঁদের দ্বারা সংঘঠিত হয়নি। নবজাগরণ সংঘটিত হয়েছিল এক শিক্ষিত সমাজের প্রয়াসে। এই শিক্ষিত সমাজের অভ্যুত্থান ঘটে মুদ্রণের প্ৰবৰ্তন ও তার পরিণতিতে স্কুল, কলেজ ইত্যাদি স্থাপনের ফলে। মুদ্রণের প্রবর্তন হয় অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে ওয়ারেন হেষ্টিংস-এর আমলে। মাত্র মুদ্রণ নয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর অনেক বৈশিষ্ট্যের আবির্ভাব ঘটেছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে। বানিজ্যের প্রসার, ডাকের প্রবর্তন, ব্যাঙ্ক ও ইনসিওরেন্স্ কোম্পানীর প্রতিষ্ঠা, সংবাদপত্র প্রকাশ, জ্ঞানানুশীলনের জন্যে এসিয়াটিক সোসাইটি স্থাপন, নাট্যাভিনয়, ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন ইত্যাদি অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকেই ঘটেছিল। এক কথায়, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকটাই ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণের প্রস্তুতিপর্ব।
মুঘল সাম্রাজ্যের পতন
অষ্টাদশ শতাব্দীর ইতিহাস রচিত হয়েছিল মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ও পদুতার পরিপ্রেক্ষিতে। শতাব্দীর সুচনায় ঔরঙ্গজেবই দিল্লীর বাদশাহ ছিলেন। ১৭০৭ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর পর থেকেই মুঘল সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়। এই পতন ত্বরান্বিত হয় ১৭১২ খ্ৰীস্টাব্দে বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পর। এই পতনের অন্তরালেই বাঙলায় নবাবী আমলের সুত্রপাত হয়। তারপর চলে ইংরেজের চক্রান্ত। ইংরেজই দেশের প্রভু হয়ে দাঁড়ায়। তারই পরিণামে ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দে ইংরেজরা শেষ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে গদিচ্যুত করে। ১৭০৭ থেকে ১৮৫৭ পর্যন্ত এই ১৫০ বৎসর সময়কালের মধ্যে বারো জন মুঘল সম্রাট দিল্লীর সিংহাসনে উপবিষ্ট ছিলেন। যথাক্রমে তারা হচ্ছেন–