অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে তন্তুবায়দের ওপর ইংরেজ বণিকদের উৎপীড়নের বিরুদ্ধে তন্তুবায়রা বিদ্রোহ করে । ইতিহাসে একে তন্তুবায় আন্দোলন বলা হয়। শান্তিপুরে এই আন্দোলনের প্রধান নায়ক ছিল বিজয়রাম ও ঢাকায় দুনিরাম পাল । এদের পর এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয় লোচন দালাল, কৃষ্ণচন্দ্ৰ বড়াল, রামরাম দাস, বোষ্টম দাস প্রমুখ। ইংরেজ বণিকদের শর্ত মেনে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর না করায় ইংরেজরা বোষ্টম দাসকে তাদের কুঠিতে আটক করে তার ওপর অত্যাচার করে। সেই অত্যাচারের ফলে বোষ্টম দাস মারা যায়।
১৭৬০ খ্রীস্টাব্দে ত্রিপুরা জেলার রোশনাবাদ পরগণায় কৃষকরা সমশের গাজী নামক এক ব্যক্তির নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘোষণা করে । সমশের কৃষকদের সঙ্ঘবদ্ধ করে ত্রিপুরার প্রাচীন রাজধানী উদয়পুর দখল করে ও সেখানে স্বাধীন রাজ্য প্ৰতিষ্ঠা করে কৃষকদের মধ্যে জমিবণ্টন ও কর মকুব, জলাশয় খনন প্ৰভৃতি জনহিতকর কাজ করে। নবাব মীরকাশিম ইংরেজ সৈন্যেরা সহায়তায় সমশের বাহিনীকে পরাজিত করে। সমশেরকে বন্দী করে মুরশিদাবাদে নিয়ে আসা হয়। পরে নবাবের হুকুমে তাকে তোপের মুখে ফেলে হত্যা করা হয়।
এই সময়ে মেদিনীপুরের ঘরুই উপজাতিরা বিদ্রোহ করে। দুবার বিদ্রোহ হয়। প্ৰথমবার জমিদার শত্ৰুঘ্ন চৌধুরীর পুত্র নরহর চৌধুরী রাত্ৰিতে নিরস্ত ঘরুইদের এক সমাবেশের ওপর আক্রমণ চালিয়ে ৭০০ ঘরুইকে হত্যা করে । দ্বিতীয়বার বিদ্রোহ হয় ১৭৭৩ খ্ৰীস্টাব্দে। এবারও ঠিক আগের মতই রাত্রিকালে আক্রমণ চালিয়ে বহু ঘরুইকে হত্যা করা হয়।
চাকমা উপজাতির মধ্যেও একাধিকবার বিদ্রোহ হয়। প্ৰথম চাকমা বিদ্রোহের (১৭৭৬-৭৭) নায়ক ছিল রামু খাঁ । সে চাকমা জাতিকে একত্রিত করে প্ৰথম কার্পাস কর দেওয়া বন্ধ করে ও তার সঙ্গে ইংরেজদের বড় বড় ঘাঁটিসমূহ ধ্বংস করে দেয় । ইংরেজ বাহিনী এসে এই বিদ্রোহ দমন করে। এই বিদ্রোহে চাকমা দলপতি শের দৌলত অসাধাবণ বীরত্ব দেখিয়েছিল। পিতার পর শের দৌলতের ছেলে জানবক্স খাঁ দ্বিতীয় চাকমা বিদ্রোহের নেতৃত্ব করে। তার সময় ( ১৭৮৩-৮৫ খ্রীস্টাব্দে ) কোন ইজারাদারই চাকমা অঞ্চলে প্ৰবেশ করতে পারেনি। বহুদিন সে স্বাধীনভাবে শাসন করেছিল ।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধের সবচেয়ে বড় বিদ্রোহ হচ্ছে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ । এই বিদ্রোহেই আমরা প্ৰথম এক মহিলাকে নেতৃত্ব করতে দেখি । সেই মহিলা হচ্ছে দেবী চৌধুরানী। বিদ্রোহের অন্যতম নেতা হচ্ছে ভবানী পাঠক। ইংরেজরা তাদের গ্রেপ্তার করবার জন্য সৈন্যসামন্ত পাঠিয়ে দেয়। ভবানী পাঠক ইংরেজদের দেশের শাসক বলে মানতে অস্বীকার করে। দেবী চৌধুরানীর সহায়তায় সে ইংরেজদের ওপর হামলা চালায়। তার ফলে ময়মনসিংহ ও বগুড়া জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে শাসন ব্যবস্থা আচল হয়ে পড়ে। লেফটানেণ্ট ব্রেনোর নেতৃত্বে পরিচালিত ইংরেজ বাহিনী তাকে এক ভীষণ জলযুদ্ধে পরাজিত করে, ও ভবানী পাঠক নিহত হয়। সন্ন্যাসী বিদ্রোহের অপর এক নেতা ছিল কৃপানাথ। কৃপানাথ এক বিরাট বাহিনী নিয়ে রংপুরের বিশাল বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গল অধিকার করে। তার ২২ জন সহকারী সেনাপতি ছিল। রংপুরের কালেকটর ম্যাকডোয়াল পরিচালিত বিরাট সৈন্যবাহিনী দ্বারা জঙ্গল ঘেরাও হলে ইংরেজবাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের খণ্ডযুদ্ধ হয়। বিদ্রোহীগণ বিপদ বুঝে নেপাল ও ভুটানের দিকে পালিয়ে যায়। উত্তরবঙ্গে এই বিদ্রোহের অন্যতম নেতা ছিল ফকির সম্প্রদায়ের মজনু শাহ। মজনুর কার্যকলাপে উত্তরবঙ্গ, ময়মনসিংহ ও ঢাকা জেলায় ইংরেজরা নাস্তানাবুদ হয়। সশস্ত্র বাহিনীর সাহায্যে তাকে দমন করা সম্ভবপর হয় না। ভবানী পাঠকের সন্ন্যাসীর দলের সঙ্গে মজনুর ফকির দলের একবার সংঘর্ষ হয়, কিন্তু পরে তারা পুনরায় সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে নিজেদের কার্যকলাপ চালায়। তাদের কার্যকলাপের অন্তর্ভুক্ত ছিল। জমিদারদের কাছ থেকে কর আদায় করা, ইংরেজ সরকারের কোষাগার লুণ্ঠন করা ইত্যাদি । তবে সাধারণ জনসাধারণের ওপর তারা অত্যাচার বা বলপ্ৰয়োগ করত না । ১৭৮৬ খ্ৰীস্টাব্দের ২৯ ডিসেম্বর তারিখে মজনু পাঁচশত সৈন্যসহ বগুড়া জেলা থেকে পূর্বদিকে যাত্রা করার পথে কালেশ্বর নামক জায়গায় ইংরেজ, বাহিনী কর্তৃক মারাত্মকভাবে আহত হয়। মজনুর দল বিহারের সীমান্তে পালিয়ে যায়। মাখনপুর নামক স্থানে মজনুর মৃত্যু হয়।
ফকির সম্প্রদায়ের অপর এক প্রধান নেতা ছিল সোভান আলি । সোভান আলি বাঙলা, বিহার ও নেপালের সীমান্ত অঞ্চলে ইংরেজ সরকার ও জমিদারদের অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। দিনাজপুর, মালদহ ও পূর্ণিয়া জেলায় ইংরেজী বাণিজ্যকুঠি ও মহাজনদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাবার সময় তার সহকারী জহুরী শাহ ও মতিউল্লা ইংরেজদের হাতে ধরা পড়ে কারারুদ্ধ হয়। সোভান পরে আমুদী শাহ নামে এক ফকির নায়কের দলে যোগ দেয়। এ দলও ইংরেজদের হাতে পরাজিত হয়। এর পরেও সোভানা ৩০০ অনুচর নিয়ে ১৭৯৭-৯৯ খ্রীস্টাব্দঃ পর্যন্ত উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ছোট ছোট আক্ৰমণ চালায়। লর্ড ওয়েলেসলী তাকে গ্রেপ্তারের জন্য চার হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে।
।। নয় ।।
আগেই বলেছি যে বাঙলার অষ্টাদশ শতাব্দীর সামাজিক ইতিহাস চিহ্নিত হয়ে আছে দুই বীভৎস ঘটনার দ্বারা । একটা হচ্ছে বর্গীর হাঙ্গামা ও আরেকটা হচ্ছে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। ১৭৪২ খ্রীস্টাব্দে আলিবর্দী খানের শাসনকালে নাগপুরের রঘুজী ভেঁসলের দেওয়ান ভাস্কররাম কোলাহাতকারের (ওরফে ভাস্কর পণ্ডিত ) নেতৃত্বে একদল মারাঠা অশ্বারোহী সৈন্য বাঙলাদেশে এসে উৎপাত শুরু, করে । এটাই বৰ্গীর হাঙ্গামা নামে পরিচিত । এই হাঙ্গামা স্থায়ী ছিল ১৭৪২ থেকে ১৭৫১ পৰ্যন্ত । প্ৰথম বছর যখন তারা আসে, আলীবর্দী খান তখন বাঙলায় ছিলেন না, ওড়িশায় গিয়েছিলেন। কিন্তু ফেরবার পথে যখন তিনি বর্ধমান শহরে রাণী দীঘির কাছে আসেন, মারাঠা অশ্বারোহীরা তাঁর শিবির অবরোধ করে। নবাব অতি কষ্টে সেখান থেকে কাটোয়ায় পালিয়ে যান । মারাঠারা সংখ্যায় পঁচিশ হাজার ছিল। তারা ভাগীরথী অতিক্রম করে। মুরশিদাবাদে এসে লুটপাট করে। জগৎশেঠের বাড়ি থেকে তারা অনেক ধনদৌলত সংগ্ৰহ করে। ইতিমধ্যে আলিবর্দী খান মুরশিদাবাদে এলে বর্গীরা কাটোয়ায় পালিয়ে যায়। পূজার সময় বর্গীরা কাটোয়ার কাছে দাঁইহাটায় দুর্গাপূজা করে। নবমীর দিন আলিবর্দী অতর্কিতে তাদের আক্রমণ করে তাড়িয়ে দেয়। তারপর বালেশ্বর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মারাঠারা চিলাকা হ্রদের দক্ষিণে পালিয়ে যায়। কিন্তু বৰ্গীদের হাঙ্গামা এক বছরের ব্যাপার নয়। নয় বছর ধরে এটা বাৎসরিক অভিযানে দাড়ায় । এই নয় বছরের উৎপাতের ফলে ভাগীরথীর পশ্চিম তীরস্থ অঞ্চলসমূহ বিশেষ করে বর্ধমান ও মেদিনীপুর জেলা আতঙ্কে অভিভূত হয়ে পড়ে। লুটপাট ও গণহত্যা ছাড়া, তারা ব্যাপকভাবে নারীধর্ষণ করত। ভারতচন্দ্ৰ তাঁর ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে লিখেছেন– ‘লুঠি-বাঙলার -লোক করিল কাঙাল। গঙ্গাপার হইল বাঁধি নৌকার জাঙ্গাল।। কাটিল বিস্তর লোক গ্রাম গ্রাম পুড়ি । লুঠিয়া লইল ধন বিহুড়ী বহুড়ী ।।” অনুরূপ বর্ণনা মহারাষ্ট্রপুরাণ ও চিত্রচম্পূতেও আছে।