ইংরেজরা প্ৰথম বাঙলায় আসে ১৬৫১ খ্ৰীস্টাব্দে। তারা সম্রাট শাহজাহানের কাছ থেকে একটা ফরমান পায় । কিন্তু ১৬৫৮ খ্রীস্টাব্দে সম্রাট ঔরঙ্গজেব সম্রাট হবার পর হুগলির ফৌজদার সম্রাট শাহজাহান কর্তৃক প্রদত্ত ফারমান বাতিল করে দেয়। এর ফলে ইংরেজদের বাণিজ্য ব্যাহত হয়। নবাবের সঙ্গে তাদের ঝগড়া চলতে থাকে। শীঘ্রই তা সংঘর্ষ ও যুদ্ধে পরিণত হয়। ইংরেজরা নবাবের ফৌজকে পরাজিত করে হুগলি তছনছ করে দেয়। ১৬৮৬ খ্রীস্টাব্দে ইংরেজরা হুগলিতে থাকা আর যুক্তিযুক্ত নয় মনে করে, জোব চার্নকের নেতৃত্বে হুগলি পরিত্যাগ করে সুতানটিতে এসে ঘাঁটি স্থাপন করে। তারপর ১৬৯৮ খ্রীস্টাব্দের জুলাই মাসে ইংরেজরা মাত্র ১৬ হাজার টাকায় কলকাতা, সুতানটি ও গোবিন্দপুর এই তিন গ্রামের জমিদারী স্বত্ব কিনে নেয়। এখানেই তার তাদের প্রথম দুর্গ ফোর্ট উইলিয়াম নির্মাণ করে। এইভাবে ভাবীকালের রাজধানী কলকাতা শহর প্রতিষ্ঠিত হয়।
কলকাতায় শক্তিকেন্দ্ৰ স্থাপনের পর ইংরেজরা ব্যস্ত হয়। ভারতে শাসন বিস্তারে । সমসাময়িক রাজনৈতিক চক্রান্ত ইংরেজদের সহায় হয়। বাঙলার নবাব সিরাজকে তারা অপসারণ করে। তার পরিণতিতে ১৭৬৫ খ্রীস্টাব্দে তারা, দেওয়ানী লাভ করে ভারতের প্রকৃত শাসক হয়ে দাড়ায়। সদর দেওয়ানী ও নিজামত আদালত মুরশিদাবাদ থেকে কলকাতায় স্থানান্তরিত করা হয়। ১৭৭৩ খ্রীস্টাব্দের রেগুলেটিং অ্যাকটি অনুযায়ী কলকাতায় সুপ্রিম কোর্ট স্থাপিত হয়। ওই সালেই ওয়ারেন হেষ্টিংস গভর্নর-জেনারেল নিযুক্ত হন। আবার চক্রান্ত চলে। সুপ্রিম কোটের বলি হন এক ব্রাহ্মণ সন্তান—মহারাজ নন্দকুমার। এই ব্ৰহ্মহত্যা করে ইংরেজ তার প্রবল প্ৰতাপান্বিত শাসনশক্তির পরিচয় দেয়। এর কোন সক্রিয় প্ৰতিবাদ দেশের মধ্যে হল না । অনুগ্রহ দান করে ইংরেজ নাগরিক সমাজকে পঙ্গু করে রেখেছিল। সামন্তরাজগণ ও জমিদারদের ইংরেজ ভীতিগ্ৰস্ত করে তুলল। রণী ভবানীর জমিদারীর এক অংশ কেড়ে নিয়ে কান্তবাবুকে দিল । আর এক অংশ গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ দখল করে নিল । তারপর জমিদারদের সম্পূর্ণ নির্জীবি করে দিল ১৭৯৩ খ্রীস্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দ্বারা। তার উদ্ভবের কথা নীচের অনুচ্ছেদে বলছি।
।। সাত ।।
১৭৬৫ খ্ৰীস্টাব্দে দেওয়ানী পাবার পরের সাত বৎসর ইংরেজ পূর্বতন ভূমিরাজস্ব প্ৰশাসন বলবৎ রাখে। মহম্মদ রেজা খানকে নায়েব-দেওয়ানরূপে ভূমিরাজস্ব পরিচালন ভার দেওয়া হয়। এর ফলে দ্বৈতশাসনের উদ্ভব হয়। দ্বৈতশাসনের ফলে অরাজকতা ও স্বৈরতন্ত্রের আবির্ভাব ঘটে । কৃষি-ব্যবস্থা বিশেষভাবে বিপৰ্যন্ত হয়। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পর কৃষকদের মধ্যে অর্ধেক মারা যাওয়ার ফলে, আবাদী জমির অর্ধাংশ অনাবাদী হয়ে পড়ে। দেয় রাজস্বের অর্ধাংশও আদায় হয় না। ১৭৭২ খ্রীস্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংস জমিদারী মহালগুলিকে নিলামে চড়িয়ে দিয়ে ইজারাদারদের সঙ্গে পাঁচশালা বন্দোবন্ত করে । কিন্তু পাঁচশালা বন্দোবন্ত ব্যর্থ হয়। পরিস্থিতি গুরুতর দেখে ১৭৭৬ খ্রীস্টাব্দে ইংরেজ দ্বৈতশাসনের অবসান ঘটায় ও নিজেরাই দেওয়ানরূপে রাজস্ব আদায়ের ভার নেয়। ১৭৮৯-৯০ খ্রীস্টাব্দে বাঙলা, বিহার ও ওড়িশার জমিদারদের সঙ্গে দশশালা বন্দোবস্ত করা হয় । ১৭৯৩ খ্রীস্টাব্দে লর্ড কর্নওয়ালিশের আমলে এটাই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু রাজস্ব আদায় সম্বন্ধে কোম্পানির প্ৰত্যাশা সিদ্ধিলাভ করে না। ‘সূর্যাস্ত আইন’ অনুযায়ী অনাদায়ী মহালগুলিকে নিলামে চড়ানো হয় । কলকাতার নব্য-ধনিকেরা নিলাম থেকে সে সব মহাল কিনে নিয়ে নিজেরা জমিদার হয়ে বসে। কৃষিকলাবিদ, উদ্যোগী, ও সাহিত্যসংস্কৃতি অনুরাগী জমিদারদের পরিবর্তে সৃষ্ট হয় এক প্রবাসী, আধা-সামন্ততান্ত্রিক ও রায়তদের ওপর অত্যাচারী জমিদার শ্রেণী। দেশের সামাজিক বিন্যাস এতে বিপৰ্যস্ত হয়। বাঙলার সামন্তরাজগণ ও জমিদারবৃন্দের প্রতাপ, প্ৰতিপত্তি ও গৌরবের এখানেই ছেদ ঘটে। সাহিত্য, সংস্কৃতি, স্থাপত্য, ভাস্কৰ্য তার এ বলিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষকতা হারায় ।
।। আট ।।
ইংরেজ দেশের শাসনভার নেবার পর থেকেই, রাজস্ব আদায়ের ব্যাপার নিয়ে বাঙলার বহু জায়গায় কৃষক ও আদিবাসীদের মধ্যে অসন্তোষ প্ৰকাশ পায়। এর ফলে ঘটে সংঘর্ষ ও বিদ্ৰোহ । ১৭৬০ থেকে ১৮০০ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে মোট আটটা বিদ্রোহ ঘটে, যথা ১৭৬০ খ্ৰীস্টাব্দের প্রথম চুয়াড় বিদ্রোহ, ১৭৬৭ খ্রীস্টাব্দের সন্দীপের বিদ্রোহ, ১৭৬৯-৭০ খ্রীস্টাব্দের সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, ১৭৭০ খ্রীস্টাব্দের ত্ৰিপুরার বিদ্রোহ, ১৭৭৩ খ্রীস্টাব্দের ঘরুই বিদ্রোহ, ১৭৭৬ খ্ৰীস্টাব্দের চাকমা বিদ্রোহ ও ১৭৯৮-৯৯ খ্রীস্টাব্দের দ্বিতীয় চুয়াড় বিদ্রোহ। মেদিনীপুরের জঙ্গলমহল ও তার সংলগ্ন পশ্চিম ও উত্তরের অরণ্যভূমি অঞ্চলের আদিবাসীদের চুয়াড় বলা হত। তারা কৃষিকৰ্ম করত না এবং পশুপক্ষী শিকার ও বনজঙ্গলে উৎপন্ন দ্রব্যাদি বিক্রয় করে জীবিকা-নির্বাহ করত। স্থানীয় জমিদাররা তাদের পাইকবরকন্দাজের কাজে নিযুক্ত করত এবং বেতনের পরিবর্তে নিষ্কর ভূমির উপস্বত্ব ভোগ করতে দিত। এরূপ নিষ্কর জমিকে ‘পাইকান’ বলা হত। ১৭৬০ খ্রীস্টাব্দে মেদিনীপুর জেলায় ইংরেজ শাসন প্রবর্তিত হলে, ইংরেজরা নিয়মিত রাজস্ব আদায়ের উদ্দেশ্যে জমিদার ও তৎসঙ্গে চুয়াড়দের দমন করবার চেষ্টা করে। এর ফলেই বিদ্রোহ হয় এবং একেই চুয়াড় বিদ্রোহ বলা হয়। চুয়াড় বিদ্রোহের নায়ক ছিল গোবর্ধন দিকপতি। জঙ্গলের চুয়াড়গণ গোবর্ধনের নেতৃত্বে কর্ণগড় রাজ্য আক্রমণ করে ( ১৭৬০ ) । কর্ণগড়ের রাণী শিরোমণি ভীত হয়ে নাড়াজোলের রাজা ত্ৰিলোচন খানের আশ্ৰয় নেন। ত্ৰিলোচনী খান চুয়াড়দের পরাস্ত করেন। কিন্তু ১৭৯৮ খ্ৰীস্টাব্দে আবার দ্বিতীয় চুয়াড় বিদ্রোহ হয়। দিকপতির নেতৃত্বে প্ৰায় ৪০০ বিদ্রোহীর বাহিনী চন্দ্ৰকোেনা পরগনা ও মেদিনীপুর জেলার বৃহত্তম গ্ৰাম আনন্দপুর আক্রমণ ও লুণ্ঠন করে। ইংরেজরা চুয়াড়দের দমন করে, কিন্তু রাণী শিরোমণিকে এই বিদ্রোহের নেত্রী ভেবে, তাঁকে কলকাতায় এনে বন্দী করে রাখে। পরে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।