বাঙলার অষ্টাদশ শতাব্দীর সামাজিক ইতিহাস চিহ্নিত হয়ে আছে দুই বীভৎস ঘটনার দ্বারা । একটা হচ্ছে বগীর হাঙ্গামা ( ১৭৪২-৫১ ) ও আর একটা হচ্ছে ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ ( ১৭৬৯-৭০ ) ৷ প্ৰথমটার ভীতিপ্ৰদ চিত্র আমরা তিনখানা বই থেকে পাই, কিন্তু ছিয়াত্তরের মন্বন্তর আরও ভয়ঙ্কর ঘটনা হলেও সমসাময়িক কোন গ্রন্থে এর ভীতিপ্ৰদ চিত্রটা অঙ্কিত হয়নি। বাংলা সাহিত্যের এই শূন্যতা বিশেষভাবে দ্রষ্টব্য।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকটা ঝঙ্কৃত হয়েছিল রামপ্রসাদ, নিধুবাবু ও রামরাম বসুর গানে। নিধুবাবুর টপ্পা এক সময় বাঙালীর কানে সুধাবর্ষণ করত, এবং রামপ্রসাদের গান আজও বাঙালীর অন্তরকে মুগ্ধ করে। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে অষ্টাদশ শতাব্দীর বিশেষ অবদান বিষ্ণুপুর ঘরাণার উদ্ভব। এটা ধ্রুপদেরই একটা বিশেষ ঘরাণা। এই ঘরাণার বিশিষ্ট কলাবিদদের মধ্যে ছিলেন গদাধর চক্রবর্তী, কৃষ্ণমোহন গোস্বামী, নিতাই নাজীর ও বৃন্দাবন নাজীর। অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে রামশঙ্কর ভট্টাচাৰ্য কর্তৃক এই ঘরাণার সাংগীতিক খ্যাতি বিশেষভাবে বর্ধিত হয়। এখানে আরও উল্লেখযোগ্য যে অষ্টাদশ শতাব্দীতে প্ৰচলিত মধ্যযুগের সাহিত্যধারার পাশে আর একটা নূতন ( মৌখিক ) সাহিত্যধারার সৃষ্টি হয়েছিল। এটা হচ্ছে কবির গান। কবির গান এ সময় বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে সামন্তরাজগণ ও জমিদারগণের আমলে বাঙলায় নির্মিত হয়েছিল বাঙলার নিজস্ব স্থাপত্য রীতিতে ( চালা, রত্ন, শিখর, দালান ইত্যাদি ) বহু মন্দির। এই সকল মন্দিরের বৈশিষ্ট্য ছিল মন্দিরগুলির গায়ে পোড়ামাটির অলঙ্করণ। পোড়ামাটি অলঙ্করণের বিষয়বস্তু ছিল রামায়ণ, মহাভারত ও পৌরাণিক কাহিনী, কৃষ্ণলীলা বিষয়ক বৃত্তান্ত, সমকালীন সমাজচিত্র, বন্যপশুর অনায়াস বিচরণভঙ্গী ও সাবলীল গতিবেগ, এবং ফুল, লতাপাতা ও জ্যামিতিক নকশা প্ৰভৃতি। রামায়ণের কাহিনীর মধ্যে চিত্রিত হয়েছে হরধনুভঙ্গ, রামসীতার বনগমন, সুর্পনখার নাসিকাচ্ছেদন, মারীচবধ, রাবণ-জটায়ুর যুদ্ধ, জটায়ুবধ, অশোকবনে সীতা প্রভৃতি এবং মহাভারতের কাহিনীর মধ্যে অর্জুনের লক্ষ্যভেদ, শকুনীর পাশাখেলা, দ্ৰৌপদীর বস্ত্রহরণ, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধদৃশ্য, ভীষ্মের শরশয্যা, প্রভৃতি। পৌরাণিক বিষয়বস্তুর মধ্যে রূপায়িত হয়েছে বিষ্ণুর দশাবতার, দশদিকপাল, দশমহাবিদ্যা, ও অন্যান্য মাতৃকাদেবীসমূহ এবং অন্যান্য জনপ্রিয় পৌরাণিক উপাখ্যান যথা–শিববিবাহ, দক্ষযজ্ঞ, মহিষাসুরমর্দিনী ইত্যাদি। সামাজিক দৃশ্যসমূহের মধ্যে আছে বারাঙ্গনা বিলাস ও নানাবিধ আমোদ-প্ৰমোদ, বেদে-বেদেনীর কসরৎ, নানারূপ ঘরোয়া দৃশ্য ও বাঙালী রমণীর বিদেশীর নিকট প্রেম নিবেদন। এ ছাড়া, কয়েকটি মন্দিরে আছে যৌন-ক্রীড়ারত মিথুন মুর্তি।
বল-বাহুল্য যে মন্দিরগাত্রের এই সব অলঙ্করণ আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরে অষ্টাদশ শতাব্দীর বাঙালীর ধর্মীয় সচেতনতা ও জীবনচৰ্যার সজীব চিত্র।
।। ছয় ।।
১৭০৭ খ্ৰীস্টাব্দে মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারিগণের পঙ্গুতা ও সেই অবসরে বাঙলার নবাবদের স্বাধীন শাসক হিসাবে আচরণ, ও এই বিশৃঙ্খলতার সুযোগে ইংরেজদের চক্রান্ত ও পরে আধিপত্য স্থাপন-এই নিয়েই বাঙলার অষ্টাদশ শতাব্দীর রাষ্ট্ৰীয় ইতিহাস। প্ৰথম যিনি নবাবী আমলের উদ্বোধন করেন, তিনি হচ্ছেন মুরশিদকুলি খান । ঔরঙ্গজেব জীবিত থাকাকালীন মুরশিদকুলি খান বাঙলায় যথেষ্ট শক্তিমান হয়ে উঠেছিল। কথিত আছে মুরশিদকুলি খান দাক্ষিণাত্যের এক ব্ৰাহ্মণ পরিবারের সন্তান। শৈশবকালে দস্যুরা তাকে হরণ করে নিয়ে গিয়ে পারস্যদেশীয় এক বণিকের কাছে বেচে দেয়। পারস্যদেশীয় এই বণিক তাকে মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত করে নানারূপ বৈষয়িক বিষয়ে তাকে শিক্ষা দেন। ঔরঙ্গজেব যখন তার পিতা শাহজাহানের আমলে দীক্ষিণাত্যের সুবাদার ছিলেন, মুরশিদকুলি খান তখন তাঁর অধীনে দাক্ষিণাত্যের রাজস্ববিভাগে কর্ম গ্ৰহণ করে। ঔরঙ্গজেব যখন দিল্লীর সম্রাট হন, তখন তিনি মুরশিদকুলি খানকে কর্মপটু দেখে তাকে ঢাকায় সুবে বাঙলার দেওয়ান করে পাঠান। কিন্তু সুবাদার আজিম-উস-শানের সঙ্গে তার বনিবনা না হওয়ায় মুরশিদকুলি খান ১৭০১ খ্রীস্টাব্দে ঢাকা থেকে মুকসুদাবাদে তার দপ্তর উঠিয়ে নিয়ে আসেন। ১৭১৩ খ্রীস্টাব্দে সম্রাট ফারুকশিয়ারের আমলে মুরশিদকুলি খান বাঙলা, বিহার ও ওড়িশার সুবাদার নিযুক্ত হন। তখন থেকে তিনি মুকসুদাবাদের নাম বদল করে নিজ নাম অনুসারে মুরশিদাবাদ রাখেন। সে সময় থেকেই মুরশিদাবাদ বাঙলার রাজধানী হয়, এবং বাঙলার সুবাদাররা দিল্লীর সম্রাটের সঙ্গে নামমাত্র সম্পর্ক রেখে স্বাধীন নবাব হিসাবে শাসন করতে থাকেন। ১৭২৭ খ্রীস্টাব্দে তার মৃত্যুর পর তার জামাতা সুজাউদ্দিন খান বাঙলা, বিহার ও ওড়িশার সুবাদার হন। সুজার মৃত্যুর পর তার পুত্র সরফরাজ খান বাঙলার নবাব হয়। কিন্তু এক বছরের মধ্যে বিহারের শাসনকর্তা আলিবর্দী খান সরফরাজের কর্মচারীদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে তঁকে গিরিয়ার যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করে মুরশিদাবাদের মসনদ দখল করে নেন। আলিবর্দীর মৃত্যুর পর তার দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলা নবাব হন। ইংরেজদের তিনি বিরোধী থাকায়, ইংরেজরা তার সেনাপতি মীরজাফরের সঙ্গে চক্রান্ত করে তাকে পলাশীর যুদ্ধে হারিয়ে দেয়। তাঁকে নিহত করে মীরজাফরকে মুরশিদাবাদের মসনদে বসানো হয়। পরে মীরকাশিম এবং তারও পরে পুনরায় মীরজাফর নবাব হয়। মীরজাফরের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্ৰ নজামউদ্দৌলার সময় ১৭৬৫ খ্ৰীস্টাব্দে ক্লাইভ সম্রাট শাহ আলমের কাছ থেকে বাঙলা, বিহার ও ওড়িশার দেওয়ানী লাভ করেন। তখন থেকে ইংরেজরাই প্ৰকৃতপক্ষে বাঙলা, বিহার ও ওড়িশার হর্তাকর্তা বিধাতা হয়ে দাড়ায়।