৮ মে তারিখে নন্দকুমার প্রধান বিচারপতির কাছে এক আবেদন পত্রে বলেন যে, ‘তাঁকে যদি সাধারণ জেলখানায় রাখা হয়, তা হলে তাঁকে জাতিচু্যুত হবার আশঙ্কায় আহার-স্নান প্রভৃতি পরিহার করতে হবে। সেজন্য তাকে এমন কোন বাড়িতে বন্দী করে রাখা হোক যা কোনদিন ক্রীশ্চন বা মুসলমান কতৃক কলুষিত হয়নি, এবং তাকে প্ৰতিদিন একবার করে গঙ্গায় স্নান করতে যেতে দেওয়া হোক।’ কিন্তু বিচারকরা আবার একবাক্যে বললেন- ‘কয়েদীর এরকম আবদার কখনই মেনে নেওয়া যেতে পারে না।’
নন্দকুমার গোড়া থেকেই জেলখানায় আহার ত্যাগ করেছিলেন। সেজন্য ১০ মে তারিখে প্ৰধান বিচারপতি ইমপে (হেষ্টিংস-এর প্রাণের বন্ধু) নন্দকুমারের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করবার জন্য একজন চিকিৎসককে পাঠিয়ে দেন। চিকিৎসক মন্তব্য করেন, ‘অনশন হেতু নন্দকুমারের এরূপ শারীরিক অবনতি ঘটেছে যে পরদিন প্রাতের পূর্বেই নন্দকুমারকে খাওয়ানো দরকার।’ সেজন্য বিচারকরা অনুমতি দিলেন যে, প্রতিদিন প্রাতে একবার করে তাঁকে যেন জেলখানার বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু নন্দকুমার সে অনুমতি প্ৰত্যাখ্যান করেন। সেজন্য জেলখানার প্রাঙ্গণে একটা তাবু খাটিয়ে সেখানে নন্দকুমারের অবস্থানের ব্যবস্থা করা হয়। নন্দকুমার সেখানে মিষ্টান্ন ছাড়া আর কিছু গ্ৰহণ করতেন না।
বর্তমান রাইটার্স-বিল্ডিংস-এর পূবদিকে এখন যেখানে সেণ্ট এণ্ডজ গির্জা অবস্থিত, সেখানেই তখন সুপ্রীম কোর্ট ছিল। এখানেই ১৭৭৫ খ্রীস্টাব্দের ৮ জুন তারিখে নন্দকুমারের বিরুদ্ধে আনীত মামলার বিচার শুরু হয়। যে বিচারকমণ্ডলী নন্দকুমারের বিচার করেন, তাদের মধ্যে ছিলেন ইমপে, হাইড, চ্যাম্বারস ও লেমেস্টার। সরকারী পক্ষের উকিল ছিলেন ডারহাম, আর নন্দকুমারের পক্ষে ফারার। এই মামলায় দশজন ইওরোপীয় ও দুজন ইওরেশিয়ান জুরি নিযুক্ত হয়। দোভাষী ছিলেন হেষ্টিংস ও ইমপে-র বন্ধু আলেকজাণ্ডার ইলিয়ট। তার নাম প্ৰস্তাবিত হওয়া মাত্ৰই, ফারার আপত্তি তুলে বলেন যে, তাঁর মক্কেল একে শক্রিপক্ষের লোক বলে মনে করেন। কিন্তু ফারারের এ আপত্তি নাকচ হয়ে যায়। তারপর ফারার বলেন যে, তাঁর মক্কেলকে কাঠগড়ায় না পুরে যেন তাঁর উকিলের কাছে বসতে দেওয়া হয়, এবং তাকে যেন হাতজোড় করে দাঁড়ানো থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। কিন্তু আদালত ফারারের এসব আবেদনও নাকচ করে দেয়।
তারপর আইনের লড়াই চলে। বিচারক চ্যাম্বারস মত প্ৰকাশ করেন যে বিলাতের আইন কলকাতায় চলতে পারে না। সুতরাং এ মামলা বিচার করার ক্ষমতা আদালতের এলাকার বাইরে। কিন্তু প্ৰধান বিচারপতি (ইমপে) ও অন্য বিচারকরা এর বিপরীত মত প্ৰকাশ করেন। সুতরাং মামলা চলতে থাকে।
নন্দকুমারকে তখন সওয়াল করতে বলা হয়। নন্দকুমার আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেকে ‘নির্দোষ’ বলে ঘোষণা করেন। তাঁকে আবার জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘কার দ্বারা আপনি আপনার বিচার হওয়া উচিত মনে করেন?’ নন্দকুমার উত্তর দেন। -’ঈশ্বর ও তার সমতুল্য ব্যক্তি দ্বারা।’ বিচারকরা নন্দকুমারকে জিজ্ঞাসা করেন–‘কাকে আপনি সমতুল্য মনে করেন?’ ফারার উত্তরে বলেন—‘এটা তিনি আদালতের বিবেকের ওপর ছেড়ে দিতে চান।’
সমস্ত বিচারটাই হল একটা প্ৰহসন মাত্ৰ। মীর আসাদ আলি, শেখ ইয়ার মহম্মদ ও কৃষ্ণজীবন দাস প্রভৃতি অনেকে নন্দকুমারের পক্ষে সাক্ষ্য দিয়ে বলেন যে, তারা স্বচক্ষে বলাকীদাসের ওই দলিল সম্পাদন হতে দেখেছেন। কিন্তু তা সত্বেও ১৮ জুন তারিখে আদালত জুরিদের প্রতি তাঁদের অভিমত প্ৰকাশ করতে বলে। তঁরা সকলেই একবাক্যে বলেন- ‘নন্দকুমার দোষী, এবং তাঁর প্রতি কোনরূপ দিয়া প্ৰদৰ্শন করবার সুপারিশ আমরা করতে পারি না।’ আদালত নন্দকুমারের প্রাণদণ্ডের আদেশ দেয় (তখনকার বিলাতী আইন অনুযায়ী জালিয়াতি অপরাধে প্রাণদণ্ড হত)। শুধু তাই নয়। নন্দকুমারের সমর্থনে যার সাক্ষী দিয়েছিল, তাদের অভিযুক্ত করবারও আদেশ দেয়।
কলকাতাবাসীর পক্ষ থেকে নন্দকুমারকে বাঁচাবার সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছিল। কেননা, বিলাতে রাজার নিকট ক্ষমা প্রার্থনার আবেদনে জুরিদের অনুমোদন থাকা চাই। জুরিরা সে অনুমোদন দেননি।
১৭৭৫ খ্রীস্টাব্দের ৫ আগস্ট তারিখে খিদিরপুরের কাছে কুলিবাজারের ফাঁসিমঞ্চে নন্দকুমারকে তোলা হল। অত্যন্ত প্ৰশান্ত মুখে ইষ্টদেবতার নাম করতে করতে নন্দকুমার ফাঁসিমঞ্চে ওঠেন। ইংরেজ-বিচারের যুপকাষ্ঠে বলি হলেন বাঙলার একজন নিষ্ঠাবান ব্ৰাহ্মণ। সব শেষ হয়ে গেলে গঙ্গার অপর পারে সমবেত হিন্দু নরনারী ‘বাপরে বাপ’ বলে চীৎকার করতে করতে গঙ্গায় ঝাপিয়ে পড়ল তাদের পাপক্ষালনের জন্য।
পরিশিষ্ট ‘খ’ – বাঙলার শাসকগণ
মুঘল সুবেদারগণ
১। আজিম-উস-শান (১৬৯৮-১৭০৭)
২। ফারুকশিয়ার (১৭০৭-১৭১২)
মুরশিদাবাদের নবাবগণ
১। মুরশিদকুলি খান (১৭১৩-১৭২৭)
২। সরফরজ খান (১৭২৭)
৩। শুজাউদ্দিন (১৭২৭-১৭৩৯)
৪। সরফরজ খান দ্বিতীয় বার (১৭৩৯-১৭৪০)
৫। আলিবর্দি খান (১৭৪০-১৭৫৬)
৬। সিরাজদ্দৌলা (১৭৫৬-১৭৫৭) (বাঙলার শেষ স্বাধীন নবাব)
৭। মীরজাফর (১৭৫৭-১৭৬০)
৯। মীরজাফর দ্বিতীয় বার (১৭৬৩- ১৭৬৫)
১০। নজম-উদ-দ্দৌলা (১৭৬৫-১৭৬৬)
১১। সইফ-উদ-দ্দৌলা (১৭৬৬-১৭৭০)
১২। মুবারক-উদ-দৌলা (১৭৭০ – ১৭৯৩)
১৩। নাজির-উল-মুলক (১৭৯৩-১৮১০)
১৪। জিনুদ্দিন আলি খান (১৮১০) (পেনসন দান)