রাণী ভবানীর সমসাময়িক কালে নদীয়ার কৃষ্ণনগরে জমিদারী পরিচালনা করতেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় । কৃষ্ণচন্দ্রের জমিদারীর আয়তনও বিশাল ছিল। ভারতচন্দ্ৰ তার ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে কৃষ্ণচন্দ্রের রাজ্যের সীমানা সম্বন্ধে বলেছেন–“রাজ্যের উত্তরসীমা মুরশিদাবাদ। পশ্চিমের সীমা গঙ্গাভাগীরথী খাদ। দক্ষিণের সীমা গঙ্গাসাগরের খাদ । পূর্ব সীমা ধুলাপুর বড় গঙ্গা পার।” সিরাজউদ্দৌলাকে গদিচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে তিনিও ইংরেজদের সাহায্য করেন। এর প্ৰতিদানে তিনি ক্লাইভের কাছ থেকে পাঁচটি কামান উপহার পান। কিন্তু পরে খাজনা আদায়ের গাফিলতির জন্য মীরকাশিম তাঁকে মুঙ্গের দুর্গে বন্দী করে রাখে। ইংরেজের সহায়তায় তিনি মুক্তি পান।
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন আঠারো শতকের নিষ্ঠাবান হিন্দু সমাজের কেন্দ্ৰমণি। ১৭৫৩ খ্রীস্টাব্দের মাঘ মাসে তিনি অগ্নিহোত্র ও বাজপেয় যজ্ঞ সম্পাদন করেন। এই যজ্ঞ সম্পাদনের জন্য তাঁর ২০ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছিল। বাঙলা, তৈলঙ্গ, দ্রাবিড়, মহারাষ্ট্র, মিথিলা, উৎকল ও বারাণসীর বিখ্যাত পণ্ডিতরা এই যজ্ঞে আহুত হয়েছিলেন। এছাড়া, তার সভা অলঙ্কৃত করত বহু গুণিজন যথা গোপাল ভাঁড়, ভারতচন্দ্র, রামপ্ৰসাদ সেন, জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন, হরিরাম তর্কসিদ্ধান্ত, কৃষ্ণানন্দ বাচস্পতি, বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার প্রমুখ। নাটোর থেকে একদল মৃৎশিল্পী এনে, তিনি কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত মৃৎশিল্পের প্রবর্তন করেন। বাঙলা দেশে জগদ্ধাত্রী পূজারও তিনি প্রবর্তক।
বাঁকুড়ার মল্লরাজগণের রাজধানী ছিল বিষ্ণুপুরে। বিষ্ণুপুর জঙ্গলমহলেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে বিষ্ণুপুরের মল্লরাজগণ তাদের গৌরবের তুঙ্গে উঠেছিল। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীতে মল্লরাজগণ যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়ে। গোপাল সিংহের রাজত্বকালে বগীদের আক্রমণে রাজ্যটি বিধ্বংস হয় ও তার পতন ঘটে। কিন্তু এক সময় তারা এক বিশাল ভূখণ্ডের অধিপতি ছিল। এই ভূখণ্ড উত্তরে সাঁওতাল পরগণা থেকে দক্ষিণে মেদিনীপুর পর্যন্ত এবং পূর্বদিকে বর্ধমান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পশ্চিমে পঞ্চকোট, মানভূম ও ছোটনাগপুরের কিয়দংশ তাদের জমিদারীভুক্ত ছিল। মল্লরাজগণের আমলে বিষ্ণুপুর রেশম চাষ ও সংস্কৃত চর্চার একটা বড় কেন্দ্ৰ ছিল। মল্লরাজগণ প্ৰথমে শৈব ছিলেন, কিন্তু পরে শ্ৰীনিবাস আচাৰ্য কর্তৃক বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। বিষ্ণুপুরের প্রসিদ্ধ মন্দিরগুলি রাজা বীর হাম্বির (১৫৯১-১৬১৬), রঘুনাথ সিংহ (১৬১৬-৫৬), দ্বিতীয় বীরসিংহ (১৬৫৬-১৬৭৭), দুর্জন সিংহ (১৬৭৮-১৬৯৪) প্ৰমুখের আমলে নির্মিত হয়। এদের পর অষ্টাদশ শতাব্দীতে মল্লরাজগণ যখন দুর্বল হয়ে পড়ে, তাদের রাজ্য বর্ধমানের অন্তর্ভুক্ত হয়।
অষ্টাদশ শতাব্দীর একজন দুর্ধর্ষ জমিদার ছিলেন রাজা সীতারাম রায়, বঙ্কিম যাকে তাঁর উপন্যাসে অমর করে গেছেন। যশোহরের ভুষনা গ্রামে তাঁর জন্ম। পিতা উদয়নারায়ণ ছিলেন স্থানীয় ভূম্যাধিকারী। মহম্মদ আলি নামে একজন ফকিরের কাছ থেকে তিনি আরবী, ফারসী ও সামরিক বিদ্যা শিক্ষা করেন। পরে তিনি পিতার জমিদারীর সৈন্য সংখ্যা বাড়িয়ে নিজেই ‘রাজা’ উপাধি গ্ৰহণ করেন। মুরশিদকুলি খান তাঁকে দমন করবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরে তিনি ঐশ্বৰ্যমত্ত হলে, তার রাজ্যে বিশৃঙ্খলার উদ্ভব হয়। সেই সুযোগে নবাবের সৈন্য তাঁর আবাসস্থল মহম্মদপুর আক্রমণ করে তাঁকে পরাজিত ও বন্দী করে। কথিত আছে তাকে শূলে দেওয়া হয়েছিল।
।। পাঁচ ।।
অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম তিনপাদে সামস্ত রাজগণের আমলে আমরা নিষ্ঠাবান সমাজ ও সাহিত্যের ধারাবাহিকতাই লক্ষ্য করি। বাংলা সাহিত্য তখনও তার পূৰ্ববর্তী খাতেই প্ৰবাহিত হচ্ছিল। এই সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বাঙলার সামান্তরাজগণ ও জমিদারবৃন্দ। তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় মঙ্গলকাব্য ও পৌরাণিক কাব্যসমূহের ধারা স্তিমিত হয়নি। কর্ণগড়ের রাজা যশোমন্ত সিংহের পৃষ্ঠপোষকতায় রামেশ্বর ভট্টাচাৰ্য রচনা করেছিলেন তাঁর ‘শিবায়ন’, বর্ধমানের রাজা কীৰ্তিচন্দ্রের পৃষ্ঠপোষকতায় ঘনরাম চক্রবর্তী রচনা করেছিলেন তাঁর ‘ধর্মমঙ্গল’, ও নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতচন্দ্র রচনা করেছিলেন তাঁর ‘অন্নদামঙ্গল’ ও ‘বিদ্যাসুন্দর’। শতাব্দীর দ্বিতীয় পাদে গঙ্গাধর দাস রচনা করেছিলেন তার ‘জগৎমঙ্গলা’ কাব্য। এই গঙ্গাধরেরই অগ্রজ ছিলেন ‘মহাভারত’ রচয়িতা কাশীরাম-দাস। শতাব্দী শেষ হবার পূর্বেই রচিত হয়েছিল আরও তিনখানা ধর্মমঙ্গল কাব্য–১৭৮১ খ্রীস্টাব্দে মানিক গাঙ্গুলির, ১৭৯০ খ্রীস্টাব্দে রামকান্তের ও ১৭৯৬ খ্ৰীস্টাব্দে গোবিন্দরামের । অনুবাদ সাহিত্যে শতাব্দীর প্রারম্ভেই শঙ্কর কবিচন্দ্র রচনা করলেন তার ‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারত, ও শতাব্দীর শেষের দিকে ( ১৭৯০ খ্রীস্টাব্দে ) রামপ্ৰসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় রচনা করলেন তাঁর ‘রামায়ণ’। এছাড়া রচিত হয়েছিল শচীনন্দন কর্তৃক তার ‘উজ্জ্বলনীলমণি’, রামপ্ৰসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক ‘দুর্গাপঞ্চর্যাত্ৰি’, জয়নারায়ণ সেন কর্তৃক তার ‘হরিলীলা’, জগৎ নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক ‘আত্মবোধ’, ও জয়নারায়ণ ঘোষাল কর্তৃক পদ্মপুরাণের ‘কাশীখণ্ড’। শতাব্দীর শেষের দিকে অনুবাদ সাহিত্যের ক্ষেত্রে উল্লেখনীয় সংযোজন হচ্ছে গোলাকনাথ দাস কর্তৃক ইংরেজি নাটক Disguise-এর বাংলা অনুবাদ, যা হেরোসিম লেবেডফ কর্তৃক ১৭৯৫ খ্রীস্টাব্দে মঞ্চস্থ হয়েছিল তাঁর ডোমতলার বেঙ্গল থিয়েটারে ।