যাকে নিয়ে এই ব্ৰহ্মহত্যা ঘটেছিল, তিনি হচ্ছেন মহারাজ নন্দকুমার রায়। আগেই বলেছি (পৃ. ৭৩) যে ওয়ারেন হেষ্টিংস ষড়যন্ত্র করে মহারাজ নন্দকুমারের ফাঁসি ঘটিয়েছিলেন। কিন্তু এ সম্বন্ধে ব্যাপারটা বিশদভাবে অনেকেরই জানা নেই। সেটাই এখানে বলছি।
নন্দকুমারের পৈতৃক বাসস্থান ছিল বীরভূম জেলার ভদ্রপুর গ্রামে। পিতার নাম পদ্মনাভ রায়। তিনি ছিলেন মুরশিদকুলি খাঁর আমিন। নন্দকুমার ফারসী, সংস্কৃত, বাংলা ও পিতার রাজস্ব-সংক্রান্ত কাজ শিখে আলিবর্দী খাঁর আমলে প্ৰথমে হিজলি ও মহিষাদল পরগনার রাজস্ব আদায়ের আমিন ও পরে হুগলীর ফৌজদারের দেওয়ান পদে নিযুক্ত হন। পলাশী যুদ্ধের পর নন্দকুমার নানা উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হন। এই সময় বর্ধমানের খাজনা আদায়ের কতৃত্ব নিয়ে ওয়ারেন হেষ্টিংস-এর সঙ্গে তার বিরোধের সূত্রপাত হয়। হেষ্টিংস তখন কোম্পানির রেসিডেণ্ট ছিলেন।
উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হয়ে পরে নন্দকুমার কলকাতায় আসেন। কলকাতায় তিনি একজন খুব প্রভাবশালী ব্যক্তি হয়ে দাঁড়ান। তিনি প্ৰতিভাশালী ব্যক্তিও ছিলেন। তাঁর নানা রকম গুণে মুগ্ধ হয়ে বাদশাহ শাহ আলম তীকে ‘মহারাজ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। দেশের লোককে রেজা খাঁর অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য দেশের লোকেরাও তিনি প্রিয় হয়েছিলেন। তিনি কোনরূপণ অত্যাচার সহ করতে পারতেন না, এবং সব সময় অত্যাচারিতের পক্ষ নিয়ে দণ্ডধারণ করতেন। তা ছাড়া, বীডন স্কোয়ারের নিকট তার বাড়ির দ্বার সব সময়েই দরিদ্র দেশবাসীর জন্য উন্মুক্ত থাকত। প্রত্যহ এক বিরাট জনতা তাঁর বাড়িতে ভোজন করত।
এহেন নন্দকুমারের মত ব্যক্তির বিচার পৃথিবীর নবম আশ্চৰ্যরূপে পরিগণিত হয়েছিল। হেষ্টিংস ও তাঁর কাউনসিলের সঙ্গে নন্দকুমারের বনিবনা ছিল না। তিনি হেষ্টিংস-এর রোহিলা যুদ্ধ ও ফৈজাবাদের সন্ধির তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। হেষ্টিংস-এর সঙ্গে তার বিরোধ চরমে ওঠে যখন ১৭৭৫ খ্রীস্টাব্দে বর্ধমানের রাণী অভিযোগ করেন যে হেষ্টিংস তার কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছেন। ওই ১৭৭৫ খ্রীস্টাব্দেই নন্দকুমার অভিযোগ করেন যে, হেষ্ট্রিংস মুনি বেগমের কাছ থেকে ৩,৫৪,১০৫ টাকা ঘুষ নিয়ে তাঁকে নাবলিক নবাবের অভিভাবক নিযুক্ত করেছেন। হেষ্টিংস প্ৰত্যাভিযোগ আনেন যে, নন্দকুমার কামালউদ্দিন নামে (কামালউদ্দিন হেষ্টিংস-এরই আশ্রিত লোক) এক ব্যক্তিকে প্ররোচিত করেছেন হেষ্টিংস-এর বিরুদ্ধে উৎকোচ গ্রহণের অভিযোগ আনবার জন্য। নন্দকুমার এ মামলায় সম্পূর্ণ নির্দোষ প্রমাণিত হন। তখন হেষ্টিংস কামালউদ্দিন ও মোহনপ্ৰসাদ নামক আর এক ব্যক্তি দ্বারা নন্দকুমারের বিরুদ্ধে এক জালিয়াতির মামলা আনেন। এই মামলাতেই নন্দকুমারের ফাঁসি হয়।
মামলার বিষয়বস্তু ছিল একগাছা মোতির মালা ও কয়েকটি অন্যান্য অলঙ্কার। ১১৬৫ বঙ্গাব্দের (ইংরেজি ১৭৫৮ খ্রীস্টাব্দের) আষাঢ় মাসে মহারাজ নন্দকুমার এই মোতির হার ও অলঙ্কারগুলি মুরশিদাবাদে বলাকীদাস নামে এক ব্যক্তির কাছে গচ্ছিত রেখেছিলেন বিক্রয়ের জন্য। মীরকাশিমের সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধের সময় মুরশিদাবাদে যে বিশৃঙ্খল অবস্থার উদ্ভব হয়েছিল, সে সময় বলাকীদাসের বাড়ি থেকে এগুলি লুষ্ঠিত হয়। ১১৭২ বঙ্গাব্দে (১৭৬৫ খ্রীস্টাব্দে) বলাকীদাস যখন কলকাতায় আসেন, নন্দকুমার তখন এগুলি তার কাছ থেকে ফেরত চান। বলাকীদাস এগুলি ফেরত দিতে অসমর্থ হয়ে, নন্দকুমারের আনুকূল্যে একখানা দলিল তৈরী করে দেন। বলাকীদাস ওই দলিলে লিখে দেন যে, কোম্পানির ঢাকায় অবস্থিত খাজাঞ্চিখানায় তার যে রোক টাকা আছে, তা ফেরত পেলে তিনি নন্দকুমারের ওই মোতির হার প্রভৃতির মূল্য বাবদ ৪৮,০২১ সিঙ্কা টাকা মুল্য হিসাবে এবং তার ওপর টাকায় চার আনা হিসাবে অতিরিক্ত ব্যাজ দেবে। এই দলিল সম্পাদনের চার বছর পরে ১৭৬৯ খ্রীস্টাব্দের জুন মাসে বলাকীদাসের মৃত্যু ঘটে। বলাকীদাস। তাঁর মৃত্যুশয্যায় নন্দকুমারকে ডেকে বলেন—‘আমি আমার স্ত্রী ও কন্যারা ভার আপনার ওপর সমৰ্পণ করে যাচ্ছি। আমি আশা করি এতদিন অপনি আমার প্রতি যেরূপ আচরণ করেছেন, আমার স্ত্রী ও কন্যার সঙ্গেও সেরূপ আচরণ করবেন।’ এর কিছুদিন পরে যখন বলাকীদাসের বিষয়সম্পত্তি ও দেনাপাওনার নিম্পত্তি হয়, তখন নিম্পত্তিকারীরা নন্দকুমারের প্রাপ্য টাকা তাকে দিয়ে দেন। তখন বলাকীদাসের উক্ত দলিল বাতিল করা অবস্থায় কলকাতার মেয়র আদালতের ফেজখানায় জমা পড়ে এবং সেখান সেখানেই থেকে যায়।
হেষ্টিংস নন্দকুমারের বিরুদ্ধে প্ৰতিশোধ নেবার জন্য, মেয়র আদালতের ফেজখানা থেকে ওই দলিলটা উদ্ধার করেন এবং ওরই ভিত্তিতে এক মামলা রুজু করে বলেন যে দলিলখানা জাল।
১৭৭৫ খ্রীস্টাব্দের ৬ মে তারিখে কলকাতাবাসীরা স্তম্ভিত হয়ে গেল। যখন তারা শুনল যে নন্দকুমারের ন্যায় ব্যক্তির বিরুদ্ধে জালিয়াতির মামলা আনা হয়েছে, এবং তাঁকে সাধারণ কয়েদীদের রাখার জন্য নির্দিষ্ট জেলখানায় রাখা হয়েছে। সরকারের কাছে আরজি পেশ করা হল যে, নন্দকুমারের ন্যায় শ্রেষ্ঠ ও নিষ্ঠাবান ব্ৰাহ্মণকে সাধারণ জেলখানায় রাখলে তাঁর ধর্ম নষ্ট হবে। কিন্তু তাতে কোন ফল হল না। হেষ্টিংস-এর প্ররোচনায় বিচারকরা সকলে একমত হয়ে রায় দিলেন। যে ‘শেরিফ যেন নন্দকুমারকে সাধারণ জেলখানাতেই রাখে।’