গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ রাজস্ব আদায়কারী রেজা খাঁর অধীনে কানুনগোর কাজ করতেন। হেষ্টিংস তাকে কলকাতা কাউনসিলের দেওয়ানের পদ দেন, কিন্তু উৎকোচ গ্ৰহণের অপরাধে সে পদ থেকে অপস্থিত হন। পরে হেষ্টিংস-এর কৃপায় পুনরায় বহাল হন। পাঁচশালা বন্দোবস্তের সময় রাণী ভবানীর জমিদারীর কিয়দংশ হস্তগত করেন ও পাইকপাড়ার রাজবংশ প্ৰতিষ্ঠা করেন। জমিদার হিসাবে অত্যাচারী ও প্ৰজাপীড়ক ছিলেন।
কোম্পানির অধীনে চাকুরী করে আর ধারা প্রচুর অর্থ উপাৰ্জন করেছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন ভূকৈলাসের মহারাজ জয়নারায়ণ ঘোষাল। অষ্টাদশ শতাব্দীর আর বড়লোক ছিলেন বালাখানার চূড়ামণি দত্ত। ধনগরিমায় তিনি ছিলেন নবকৃষ্ণ দেবের প্রতিদ্বন্দ্বী।
দেওয়ানী করে আর ধারা পয়সা উপার্জন করেছিলেন তারা হচ্ছেন দেওয়ান হরি ঘোষ, শান্তিরাম সিংহ, রামহরি বিশ্বাস, রামসুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায়, বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণরাম বসু প্ৰমুখ।
বেনিয়ানী করে যথেষ্ট পয়সা উপার্জন করেছিলেন বাগবাজারের দুর্গাচরণ মুখোপাধ্যায়। বেনিয়ানগিরিতে বা ব্যবসায়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করে আর যারা প্ৰভূত ধনসম্পত্তি করেছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন রামচন্দ্ৰ মিত্র, বারাণসী ঘোষ, অত্ৰুর দত্ত, বিশ্বনাথ মতিলাল, হিদারাম ব্যানার্জি, মদনমোহন দত্ত, রামদুলাল দে সরকার, গঙ্গানারায়ণ সরকার, দুর্গাচরণ পিতুরী, রামকান্ত চট্টোপাধ্যায়, সুখময় ঠাকুর, দর্পনারায়ণ ঠাকুর, বৈষ্ণবচরণ শেঠ প্রমুখ।
তিন
১৭৬৬ খ্ৰীস্টাব্দে গোবিন্দরাম মিত্রের পৌত্র রাধাচরণ মিত্রের জালিয়াতি করার অপরাধে যে প্ৰাণদণ্ড হয় তা রদ করবার জন্য কলকাতার বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি গভর্নর-এর কাছে এক আবেদন করেছিলেন। এই আবেদন পত্রে স্বাক্ষরকারীদের সংখ্যা থেকে বুঝতে পারা যায় যে কলকাতার নাগরিক সমাজে তখন বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি ছিলেন। এই স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে ছিলেন নবকৃষ্ণ দেব, হুজুরীমল, গোকুল ঘোষ, শুকদেব মল্লিক, রাসবিহারী শেঠ, নিমাইচরণ শেঠ, মদনমোহন দত্ত, শ্যামর্টােব্দ দত্ত, হরেকৃষ্ণ দত্ত, মানিক দত্ত, কন্দৰ্প ঘোষ, রামর্টাব্দ ঘোষ, শঙ্কর হালদার, পূর্ণানন্দ বসাক, শোভারাম বসাক, রাধামোহন বসাক, দুর্গারাম সেন, নন্দরাম সেন, দয়ারাম শৰ্মা, জয়কৃষ্ণ শৰ্মা, উদয়রাম শৰ্মা, রাধাকান্ত শৰ্মা, রামনিধি শৰ্মা, রাধাচরণ মল্লিক, পীতাম্বর শেঠ, বিনোদবিহারী শেঠ, গুরুচরণ শেঠ, নীলাম্বর শেঠ, গোকুলকিশোর শেঠ, কুন্দ ঘোষাল, বাবুরাম পণ্ডিত, বনমালী ব্যানাজী, রাধাকৃষ্ণ মল্লিক, দয়ারাম মুখোপাধ্যায়, মনোহর মুখোপাধ্যায়, তোতারাম বসু, রামশঙ্কর বসু, রামশঙ্কর দত্ত, দুর্গারাম দত্ত, চূড়ামণি দত্ত, কৃষ্ণচাঁদ দত্ত, রামনিধি ঠাকুর, বিশ্বনারায়ণ ঠাকুর, দয়ারাম ঠাকুর, হরেকৃষ্ণ ঠাকুর, খাম চক্রবর্তী, কেবলরাম ঠাকুর, রামচরণ রায়, রূপরাম মিত্র, গোবর্ধন মিত্র, গণেশ বসু, গঙ্গারাম মিত্র, গোকুল মিত্র প্রমুখ। এছাড়া সমসাময়িককালে কাস্টমস হাউসে বাজেয়াপ্ত করা মালের নীলামে ক্রেতাদের মধ্যে আমরা দৰ্পনারায়ণ ঠাকুর, কেবলরাম নিয়োগী ও রাধাচরণ মিত্রেরও নাম পাই। অন্য সূত্র থেকে আমরা বনমালী সরকারের পুত্র রাধাকৃষ্ণ সরকার, নবকিশোর রায়, রামহরি রায়, রামসুন্দর মিত্র, নিমাইচরণ মিত্র, রামপ্রসাদ বকশী, সপ্তারাম ভঞ্জ, রামসুন্দর বসু, দয়ারাম চ্যাটার্জি, রামদুলাল দত্ত, গোকুল শিরোমণি প্ৰমুখদের নামও পাই।
সাহেবী সমাজ
সাহেবরাই কলকাতা শহরকে গড়ে তুলেছিল। সুতরাং গোড়া থেকেই এটা সাহেবদের শহর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ১৭৬০ খ্ৰীস্টাব্দে কলকাতায় ১২০০ ইংরেজ বাসিন্দা ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৪০০০। কিন্তু তাদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা ছিল মাত্র ২৫০ জন। সুতরাং যে সমাজে পুরুষের তুলনায় মেয়েছেলে কম থাকে, সে সমাজে যা ঘটে, এক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল। ইংরেজদের যৌন চরিত্রের মান খুব উচ্চস্তরের ছিল না। অধিকাংশ ইংরেজই তাদের যৌনক্ষুধা মেটাতো এদেশী মেয়েদের মাধ্যমে। সাহেবদের এরূপ এদেশী ঘরাণীদের ‘বিবিজান’ বলা হত।
অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে সাহেবরা যখন কলকাতায় বসবাস শুরু করে। তখন তারা ছিল মিতব্যয়ী ও খুব সংযমী। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে বিশেষ করে পলাশী যুদ্ধের পর তার হয়ে ওঠে অত্যন্ত বিলাসপরায়ণ। তখন কোম্পানির কর্মচারীদের মধ্যে ‘নবাব’ হবার বাসনা জেগে ওঠে। তারা অবৈধ উপায়ে প্রচুর অর্থ উপায় করত। উৎকোচ গ্ৰহণ করা কোম্পানির উচ্চস্তরের কর্মচারীদের মধ্যে বিশেষভাবে প্ৰচলিত ছিল। যুগের হাওয়া অনুযায়ী কোম্পানির নিম্নস্তরের কর্মচারীরাও অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জন করে এক একজন খুদে নবাব হয়ে উঠেছিল। সে যুগের পাদরী, ডাক্তার, অ্যাটনী প্রভৃতির দক্ষিণাও ছিল অসম্ভব। এ সব সাহেবদের একটা বৈশিষ্ট্য ছিল নানারকম দাসদাসী রাখা। এ ছাড়া, সাহেবদের ক্রীতদাস ছিল। অনেক সাহেবের আবার এদেশী ঘরাণীও ছিল। (সাহেবদের এদেশী ঘরণী সম্বন্ধে লেখকের ‘কলকাতার চালচিত্ৰ’, পৃষ্ঠা ১৪-১৯ দ্রষ্টব্য)।
সস্তাগণ্ডার বাজার ছিল বলে সাহেবরা বেশ গাণ্ডেপিণ্ডে খেত। ১৭৭৮ খ্রীষ্টাব্দে খাদ্যসামগ্রীর দাম ছিল–একটা গোটা ভেড়া দুটাকা, একটা বাচ্চা ভেড়া এক টাকা, ছয়টা ভাল মুরগী বা হাঁস এক টাকা, এক পাউও মাখন আট আনা, ১২ পাউণ্ড রুটি এক টাকা, ১২ বোতল বিলাতী ক্লারেট মদ ৬০ টাকা ইত্যাদি। সাহেবরা দিনে তিনবার খেত। সকালে প্রাতরাশ। যার যা খুশী খেত, এবং পরিমাণের হিসাব থাকত না। তারপর দুটার সময় মধ্যাহ্ন ভোজন (পরবর্তী কালে এটা একটার সময় খাওয়া হত, এবং এটাকে ‘টিফিন’ বলা হত)। মধ্যাহ্নভোজনে যত পারত খেত ঝলসানো ও কষা মাংসের পদ। তা ছাড়া মুরগী বা হাঁসের মাংস, নানারকম শাকসবজী, আলু ইত্যাদি। এ ছাড়া ছিল মদ্যপান করার ধুম। প্ৰতি মেয়েছেলে দিনে এক বোতল ও পুরুষরা চার বোতল মদ খেত, মধ্যাহ্নভোজনের পর সকলেই এক ঘুম ঘুমিয়ে নিত। সন্ধ্যাবেলা ঘুম থেকে উঠে চা খাবার পালা পড়ত। তারপর ছিল সান্ধ্যভ্রমণ। বাড়ী ফিরে রাত দশটার সময় সান্ধ্যভোজনের পালা। এটাতেও রীতিমত চর্ব্য, চোষ্য, লেহ, পেয় সবই থাকত।