গ্রামীন সমাজ যা শহরে স্থানান্তরিত হয়েছিল, তা প্রথম আঘাত পায় অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে শহরে এক ‘অভিজাত” শ্রেণীর অভ্যুত্থানে। শেঠবসাকরা যারা প্ৰথম এই শহরে এসে বসতি স্থাপন করেছিল, তারা ইংরেজরা আসবার বহুকাল পৰ্ব পর্যন্ত গ্রামীণ সভ্যতার ধারক ছিল। শেঠ-বসাকরাই শহরে প্ৰথম কোঠাবাড়ী তৈরী করে। কলকাতার জমিদার সাবর্ণচৌধুরীদেরও লালদিঘির ধারে একটা কাছারিবাড়ী ছিল। তারপর ইংরেজরা আসবার পর আগন্তকদের মধ্যে যারা দু পয়সা রোজগার করেছিল, তাদের মধ্যে দু-চারজন কোঠাবাড়ী তৈরী করতে থাকে। গোড়ার দিকে বাঙালীটোল ছিল বড়বাজার থেকে হাটখোলার মধ্যে। একশ বছর পরে যখন মারবারীরা শহরে আসতে থাকে, তখন থেকেই বড়বাজার বাঙালীদের বাসকেন্দ্র হিসাবে তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে।
গোড়ার দিকে যে সব বাঙালী-জমকালো ধরণের বাড়ী তৈরী করতে চাইল, তাদের বড়বাজার-হাটখোলার বাইরে কুমারটুলিতে বাড়ী নিৰ্মাণ করতে হল। এখানে খুব জমকালো ধরনের বাড়ী তৈরী করল বনমালী সরকার। তারপর গোবিন্দরাম মিত্ৰও কুমারটুলিতে একটা বড় বাড়ী ও তার সংলগ্ন এক সুউচ্চ নবরত্ব মন্দির তৈরী করলেন। আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময় গোকুল মিত্ৰও ‘এসে কাছাকাছি এক বড় বাড়ী তৈরী করেন। এঁরা সকলেই নিষ্ঠাবান সমাজের লোক ছিলেন। তার মানে, এরা সকলেই গ্রামীণ আচার-বিচার ও শাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী ধর্মকর্ম করতেন। কিন্তু শতাব্দীর মধ্যাহ্নের পর যখন রাজা নবকৃষ্ণ দেব রাসপল্লীতে (পরোকার নাম শোভাবাজার) এসে বসতি স্থাপন করলেন, বাঙালীর সমাজজীবন এক নূতন রূপ ধারণ করল। হিন্দুর পালপার্বণে যেখানে ব্ৰাহ্মণ, আত্মীয় ও স্বজনবর্গ নিমন্ত্রিত হত, মহারাজা নবকৃষ্ণ দেব সাহেবদের অনুগ্রহ লাভের জন্য তাদের সঙ্গে যোগ করে দিলেন সাহেব-মেমদের। পূজাবাড়ীতে তখন প্রবেশ করল বিদেশী সুরা ও নিষিদ্ধ খানা। সঙ্গে সঙ্গে আরও প্ৰবেশ করল যবনী নর্তকীর দল। সাহেবদের অনুগ্রহ লাভের জন্য আরও পাঁচজন বড়লোক নবকৃষ্ণকে অনুসরণ করল। শহরে এক নূতন অভিজাত সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হল। ১৭৯০ খ্ৰীস্টাব্দে যখন জমিদারীসমূহ নিলাম হতে লাগল, তখন এরাই কিনলেন সেসব জমিদারী। এদের বংশধররা রাত্ৰিতে নিজ বাড়ীতে থাকা আভিজাত্যের হানিকর মনে করল। রাত্রিটা বুদ্মিক্ষতার গৃহেই কাটাতে লাগল। এদের জীবনযাত্ৰা প্ৰণালী গ্রামীণ সমাজ খুব কুটিল দৃষ্টিতে দেখল, যা উনবিংশ শতাব্দীর বিশের দশকে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তার
‘কলিকাতা কমলালয়’ ও অন্যান্য গ্রন্থে চিত্রিত করলেন। শহরের অভিজাত শ্রেণীর এই জীবনযাত্ৰা প্ৰণালী। কিন্তু সাধারণ লোককে প্রভাবান্বিত করল না। সাধারণ লোক নিষ্ঠাবান ও গ্রামীণ সংস্কৃতিরই ধারক হয়ে রইল। এটা আমরা সমসাময়িক শিল্পীদের আঁকা ছবি থেকে জানতে পারি। এঁরা হচ্ছেন টমাস ড্যানিয়েল, উইলিয়াম ড্যানিয়েল, সলভিনাস ও উইলিয়াম সিমপসন। এই সব শিল্পী গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে তুলে ধরেছেন আমাদের চোখের সামনে সমসাময়িক সামাজিক জীবন, ধর্মীয় উৎসব ও রীতিনীতির প্রতিচ্ছবি।
দুই
অষ্টাদশ শতাব্দীর কলকাতায় যে অভিজাত শ্রেণীর অভ্যুত্থান ঘটেছিল, তারা পয়সা করেছিল দেওয়ানী, বেনিয়ানি ও ব্যবসাবাণিজ্যে। গোড়ার দিকে অবশ্য অনেকে ঠিকাদারী ও চাকুরী করেও পয়সা উপার্জন করেছিল। কলকাতার ঠাকুরবংশের প্রতিষ্ঠাতা পঞ্চানন কুশারী জাহাজে মাল ওঠানো-নামানোর ঠিকাদারী করতেন। তার ছেলে জয়রাম কলকাতার কালেকটর বাউচারের অধীনে আমিনের চাকুরী করতেন। বনমালী সরকার ইংরেজদের ডেপুটি ট্ৰেভার ছিলেন। নন্দরাম সেন কালেকটরের সহকারী ছিলেন। গোবিন্দরাম মিত্ৰও তাই। শেঠ-বসাকরা ব্যবসা করতেন। রতু সরকার ও শোভারাম বসাকও তাই। শোভারাম ইংরেজদের সঙ্গে সুতা ও বস্ত্রের কারবার করে কোটিপতি হয়েছিলেন। শতাব্দীর মধ্যাহ্নে গোকুল মিত্র মুনের একচেটিয়া ব্যবসা ও ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির হাতি ও ঘোড়ার রসদ সরবরাহ করে প্রভূত অর্থ উপার্জন করেছিলেন। পাথুরিয়াঘাটার মল্লিক পরিবারের প্রতিষ্ঠাতাদ্বয় শুকদেব মল্লিক ও নয়নচাদ মল্লিক। পয়সা করেছিলেন তেজারিতি কারবার করে। সিদুরিয়াপটিতে নয়নটাদের সাতমহল বাড়ি ছিল। নয়নৰ্চাদের ছেলে নিমাইচাঁদ নুনের ও জমিজমার ফাটক করে তিন কোটি টাকার মালিক হয়েছিলেন। চোরবাগানের রাজেন্দ্ৰ মল্লিকের পিতামহ ব্যবসা-বাণিজ্যে নিযুক্ত থেকে প্রভূত অর্থ উপার্জন করেছিলেন। অগাধ ধনের মালিক হিসাবে অষ্টাদশ শতাব্দীতে খ্যাতি ছিল গৌরী সেনের। সামান্য অবস্থা থেকে আমদানী রপ্তানীর কারবারে তিনি অসাধারণ ধনশালী হয়েছিলেন।
অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যাহ্নের পর খুব চঞ্চল্যকরভাবে বড়লোক হয়েছিলেন মহারাজ নবকৃষ্ণ দেব বাহাদুর। অষ্টাদশ শতাব্দীর আর একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন মহারাজ রাজবল্লভ। হেষ্টিংস-এর দৌলতে যারা বড়লোক হয়েছিলেন, র্তাদের মধ্যে ছিলেন। কাশিমবাজার রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা কৃষ্ণকান্ত নন্দী বা কান্তবাবু ও পাইকপাড়ার রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ।
কৃষ্ণকান্ত নন্দী মূদীর দোকানে কাজ করতেন বলে বাঙলার জনসমাজে কান্ত মুদী নামে পরিচিত ছিলেন। ফারসী ও যৎসামান্য ইংরেজি জানতেন, এবং সেজন্য ইংরেজ কুঠিতে মুহুরীর কাজ পেয়েছিলেন। সিরাজের ভয়ে ভীত ওয়ারেন হেষ্টিংসকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেন। হেষ্টিংস যখন গভর্নর-জেনারেল হন, তখন হেষ্টিংস-এর ব্যক্তিগত ব্যবসায়ের মুৎসুন্দী হয়ে হেষ্টিংস-এর সকল রকম দুষ্কার্যের সহায়ক হন। নন্দকুমারের ফাঁসি ও কাশীর রাজা চৈত সিং-এর ধনসম্পত্তি লুণ্ঠনে কান্তবাবুই প্ৰধান ষড়যন্ত্রী ছিলেন এবং পুরষ্কারস্বরূপ লুষ্ঠিত সম্পত্তির কিছু অংশ পান। তা ছাড়া, হেষ্টিংস-এর কৃপায় তিনি বহু জমিদারী ও ভূসম্পত্তি উপহার পান। অত্যন্ত চতুর ও ফন্দীবাজ লোক ছিলেন ও কাশিমবাজার রাজবংশ প্ৰতিষ্ঠা করেন। যে সকল সুযোগসন্ধানী ও স্বাৰ্থ্যান্ধ বঙ্গসন্তান অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধের বাঙলার ইতিহাসকে কলঙ্কিত করে গেছেন, তিনি তাদের অন্যতম। ১৭৯৩ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি বেঁচে ছিলেন।