নিত্যানন্দ (মিশ্র) চক্রবর্তী মেদিনীপুরের কাশীজোড়াধিপতি রাজনারায়ণের সভাসদ ছিলেন। তিনি রচনা করেছিলেন ‘শীতলামঙ্গল’, ‘ইন্দ্ৰপূজা’, ‘পাণ্ডবপূজা’, ‘বিরাট পূজা’, ‘সীতাপূজা’, ‘লক্ষ্মীমঙ্গল’, ‘কালুরায়ের গীত’ প্ৰভৃতি। তাঁর লেখার মধ্যে বহু ফারসী, হিন্দী ও উর্দু শব্দ আছে। তাঁর লেখাগুলি পাঁচালী আকারে মেদিনীপুরে গীত হত।
বস্তুতঃ বাংলা সাহিত্যের পূর্ববর্তী ধারা অনুযায়ী অষ্টাদশ শতাব্দীতে আমরা মঙ্গলকাব্য ও অনুবাদ কাব্যের প্রাচুর্যই বেশী পরিমাণে লক্ষ্য করি। শতাব্দীর দ্বিতীয় পাদে গঙ্গাধর দাস রচনা করেছিলেন তাঁর ‘জগৎমঙ্গল’ কাব্য। শতাব্দীর শেষের দিকে রচিত হয়েছিল তিনখানা ধর্মমঙ্গল কাব্য-মানিক গাঙ্গুলির, রামকান্তের ও গোবিন্দরামের। এ ছাড়া আঠারো শতকেই রচনা করেছিলেন। জীবন ঘোষাল তার ‘মনসামঙ্গল,’ নিধিরাম কবিচন্দ্ৰ তার ‘গোবিন্দমঙ্গল’, নিধিরাম কবিরত্ব তাঁর কালিকামঙ্গল’ ও আনন্দরাম চক্রবর্তী তার ‘পদ্মাপুরাণ’। অনুবাদ সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছিলেন রামপ্ৰসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়। তার রচিত ‘রামায়ণ’ দ্বারা। এছাড়া আঠারো শতকে রচিত হয়েছিল গঙ্গারাম দাস (দেব -চৌধুরীর) ‘লিবকুশ সংবাদ’, ‘শুক সংবাদ ও ‘মহারাষ্ট্র পুরাণ’, জয়নারায়ণ রায়ের ‘চণ্ডীকার্য’ ও ‘হরিলীলা’, নিধিরাম কবিচন্দ্ৰের সংক্ষিপ্ত ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’ ও ‘দাতাকৰ্ণ’, বনদুর্লভের ‘দুর্গাবিজয়’, ’’ শচীনন্দনের ‘উজ্জলনীলমণি’, রামপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দুর্গাপঞ্চর্যাত্রি, জগৎ নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আত্মবোধ’ ও জয়নারায়ণ ঘোষাল কতৃক পদ্মপুরাণের ‘কাশীখণ্ড’। অনুবাদ সাহিত্যে আরও উল্লেখনীয় সংযোজন হচ্ছে রামগতি সেনের ‘মায়াতিমিরচিন্দ্ৰিকা’, ‘প্ৰবোধচন্দ্ৰোদয়’, ও ‘যোগকল্পলতা’ প্রভৃতি সংস্কৃত গ্রন্থের অনুবাদ ও গোলকনাথ দাস কতৃক ইংরেজি ‘Disguise’ নাটকের অনুবাদ। দামোদর মিশ্র রচনা করেছিলেন। একখানা সঙ্গীতের বই, নাম ‘সঙ্গীত দৰ্পণ’, ও রামসিংহ তার ‘রাজমালা’।
তিন
পদাবলী সাহিত্যেও আঠারো শতক বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়ে আছে। শতাব্দীর প্রখ্যাত পদকর্তা ছিলেন গিরিধার। তিনি জয়দেব-রচিত ‘গীতগোবিন্দ’ সর্বপ্রথম বাংলা পদ্যে অনুবাদ করেন (১৭৩৬)। ‘পদকল্পতরু’ নামক বিখ্যাত পদাবলী গ্ৰন্থ এই শতাব্দীতেই সংকলন করেন স্বনামধন্য কীর্তনীয়া বৈষ্ণবদাস (আসল নাম গোকুলানন্দ সেন)। বর্ধমান জেলার বৈদ্যাপুরে তাঁর বাড়ী ছিল। তিনি আরও সংকলন করেছিলেন ‘গুরুকুলপঞ্জিক’। তাঁর রচিত গীতসমূহ এখনও ‘টেঞার ঢপ’ নামে প্ৰসিদ্ধ। আঠারো শতকের একজন বড় পদকর্তা ছিলেন উদ্ধব দাস। তাঁর রচিত শতাধিক পদ পাওয়া যায়। আঠারো শতকের পদকর্তাদের মধ্যে শ্ৰীকৃষ্ণচৈতন্যের মহিমাসুচক শ্রুতিমধুর অনুপ্ৰাসযুক্ত পদরচনায় বিশেষ দক্ষতা ছিল বীরভূমের জোফিলাই নিবাসী জগদানন্দের। শতাব্দীর আর দু’জন দক্ষ পদরচয়িত ছিলেন চন্দ্ৰশেখর (শশিশেখর) ও অকিঞ্চন। অকিঞ্চনের প্রকৃত নাম ছিল ব্রজকিশোর রায়। তিনি বর্ধমানরাজের দেওয়ান ছিলেন। তিনি বেশ উচ্চমানের বহু শুষ্ঠামাসঙ্গীত ও কৃষ্ণ-বিষয়ক গান রচনা করেছিলেন।
চার
অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রখ্যাত পালাগান রচয়িতা ছিলেন শ্ৰীকৃষ্ণকিঙ্কর। তাঁর রচিত মনসামঙ্গল, শীতলামঙ্গল, রাবণ্যপূজা, বরুণপূজা, ইন্দ্ৰপূজা, লঙ্কাপূজা, পঞ্চাননমঙ্গল, দেবী লক্ষ্মীর গীত, সত্যনারায়ণের সাত ভাই, দুঃখীর পাল, শীতলার জন্মপাল, শীতলার জাগরণপালা প্ৰভৃতি পালাগানগুলি এক সময় মেদিনীপুর ও হাওড়া জেলার গ্ৰামাঞ্চলে খুব জনপ্রিয় ছিল।
অষ্টাদশ শতাব্দীর সাহিত্যধারার পাশে আর এক সাহিত্যধারার সৃষ্টি হয়েছিল। এটা হচ্ছে কবিওয়ালাদের গান। এর স্রষ্টা ছিল। রঘুনাথ দাস। শতাব্দীর প্ৰখ্যাত কবিয়ালদের মধ্যে ছিল রাসুন্নুসিংহ (১৭৩৫-১৮০৭) নীলমণি ঠাকুর, গোজলা গুই, নিত্যানন্দ বৈরাগী (১৭৫১–১৮২১), নৃসিংহ রায় (১৭৩৮-১৮০৪), বলাই বৈষ্ণব, ভবানী বণিক, ভোলা ময়রা, এণ্টনী ফিরিঙ্গী (- ১৮৩৭) ও হরু ঠাকুর (১৭৪৯-১৮২৪)।
পাঁচ
সঙ্গীতের ক্ষেত্রে অষ্টাদশ শতাব্দীর বিশেষ অবদান বিষ্ণুপুর ঘরানার উদ্ভব। এটা ধ্রুপদেরই একটা বিশেষ ঘরানা। এই ঘরানার বিশিষ্ট কলাবিৎদের মধ্যে ছিলেন গদাধর চক্রবর্তী, মাধব ভট্টাচাৰ্য, কৃষ্ণমোহন গোস্বামী, নিতাই নাজীর ও বৃন্দাবন নাজীর। অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে রামশঙ্কর ভট্টাচাৰ্য কর্তৃক এই ঘরানার সাংগীতিক খ্যাতি বিশেষভাবে বর্ধিত হয়।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে বাঙলাদেশে টপ্পা গানের গায়ক হিসাবে প্ৰসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। নিধুবাবু বা রামনিধি গুপ্ত। যদিও তাকে বাঙলা দেশে টপ্পা গানের প্রবর্তক বলা হয়, তা হলেও সেটা ঠিক নয়। তাঁর পূর্বে কালী মির্জা বা কালিদাস চট্টোপাধ্যায়ই টপ্পা গানের গায়ক ও রচয়িতা ছিলেন। তবে নিধুবাবুই এটাকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। তার রচিত টপ্পাতেই আধুনিক বাংলা কাব্যের আত্মকেন্দ্ৰিক লৌকিক সুর প্রথম ধ্বনিত হয়।’
শ্যামাসঙ্গীতে হালিশহরের রামপ্ৰসাদ সেন ছিলেন অদ্বিতীয়। তিনি একাধারে শক্তিসাধক, কবি ও গায়ক ছিলেন। প্ৰথম জীবনে তিনি কলকাতায় মুহুরীর চাকরি করতেন। পরে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আশ্রয় লাভ করেন। মহারাজ তাকে একশত বিঘা জমি দান করেন। তিনিও একখানা ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্য রচনা করেন। তাঁর অপর রচনা ‘কালীকীর্তন’। তাঁর কাব্য প্রতিভার জন্য তিনি ‘কবিরঞ্জন’ উপাধি পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সবচেয়ে বেশী প্ৰসিদ্ধ তাঁর রচিত সঙ্গীতের জন্য। তাঁর রচিত গান রামপ্রসাদী সঙ্গীত’ নামে প্ৰসিদ্ধ ও তাঁর গীতি-ভঙ্গী ‘রামপ্রসাদী সুর’ নামে পরিচিত। রামপ্রসাদী গান এক, সময় বাঙলার লোককে মাতিয়ে রেখেছিল।
নাগরিক সমাজের অভ্যুদয়
১৬৯০ খ্ৰীস্টাব্দে ইংরেজরা এসে যখন প্ৰথম কলকাতায় বসবাস শুরু করে, তখন জায়গাটার সম্পূর্ণ গ্ৰাম্যরূপ ছিল। সেজন্য যে সকল বাঙালী প্ৰথম কলকাতায় এসে বাস আরম্ভ করেছিল, তাদের পক্ষে এখানকার পরিবেশটা বেশ সহজ ছিল। তার মানে, যারা প্ৰথম গ্ৰাম থেকে কলকাতায় এসেছিল, তারা গ্রামকেই এখানে তুলে নিয়ে এসেছিল। গ্রামীণ ধৰ্মকৰ্ম কলকাতায় অনুসরণ করা যাতে না বিঘ্নিত হয়, তার জন্য তারা সঙ্গে করে এনেছিল তাদের বামুনপুরুত, নাপিত ইত্যাদি। সঙ্গে করে তারা আরও এনেছিল গ্রামের আচারব্যবহার, রীতিনীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা যথা পাঠশালা, চতুষ্পাঠী ইত্যাদি।