নব্যন্যায়ের প্রখ্যাত পণ্ডিত ছিলেন বর্ধমানের সাতগাছিয়ার দুলাল তর্কবাগীশ। তিনি শঙ্কর তর্কবাগীশের প্রতিপক্ষ ছিলেন। তাঁর রচিত। নব্যন্যায়ের বহুতর পত্রিকা নবদ্বীপাদি সমাজে ও বাঙলার বাহিরে প্রচারিত হয়েছিল। তার কৃতী ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চানন, জগমোহন তর্কসিদ্ধান্ত, জয়রাম তর্কপঞ্চানন, কান্তিচন্দ্ৰ সিদ্ধান্তশেখর, দুৰ্গাদাস তর্কপঞ্চানন প্ৰমুখ। নৈয়ায়িক ও পত্রিকাকার হিসাবে আরও একজন বিখ্যাত পণ্ডিত ছিলেন নবদ্বীপের বিশ্বনাথ ন্যায়ালঙ্কার। তিনি রাজা রুষঃচন্দ্রের দানভাজন ছিলেন। সমকালীন প্ৰখ্যাত নৈয়ায়িকগণ তাঁর পত্রিকাসমূহকে প্রামাণিক বলে গণ্য করতেন। বৈদ্যবংশীয় মহারাজা রাজবল্লভ দ্বিজাচারে উপনয়ন-অনুষ্ঠানের জন্য যে সব পণ্ডিতগণের ব্যবস্থাপত্র নিয়েছিলেন, বিশ্বনাথ তাঁদের অন্যতম। এই ব্যবস্থাপত্রের রচনাকাল ১৭৫০ খ্রীস্টাব্দ। বিশ্বনাথের ছেলে কালীপ্রসাদ তর্কালঙ্কারও (১৭৩৯-?) একজন প্ৰখ্যাত নৈয়ায়িক ছিলেন।
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবিদের অন্যতম ছিলেন মথুরেশ। তিনি একবার এক হেয়ালিপূর্ণ শ্লোক আবৃত্তি করে একজন দিগ্বিজয়ী পণ্ডিতকে হারিয়ে মহারাজার কাছ থেকে ‘মহাকবি’ উপাধি পেয়েছিলেন। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের প্ৰধান সভাপণ্ডিতদের মধ্যে আরও ছিলেন শিবরাম বাচস্পতি। ‘ষড়দর্শনবিৎ’ আখ্যায় তিনি ভূষিত হয়েছিলেন। অনুমানখণ্ডের চর্চা যখন চরমে উঠেছিল, সে সময় তিনি অনাদৃত প্ৰাচীন ন্যায়ের চর্চা পুনজীবিত করেন। তাঁর রচিত গ্রন্থের ‘মধ্যে প্ৰসিদ্ধ ‘গৌতমসূত্ৰবিধি’ ও গদাধর-রচিত মুক্তিবাদের ওপর এক টীকা। রাজা রাজবল্লতের সভায় তিনি আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। শ্ৰীকৃষ্ণ তর্কালঙ্কারের আদি বাড়ি ছিল মালদহে। কিন্তু নবদ্বীপে অধ্যয়ন করতে এসে তিনি নবদ্বীপেই বসবাস করেন। স্মৃতিশাস্ত্রে তার বিশেষ বুৎপত্তি ছিল। তারা প্ৰণাত জীমূতবাহনের দায়ভাগ টীকা ও দায়ক্রমসংগ্রহ’ প্ৰামাণিক গ্ৰন্থ হিসাবে গণ্য হয় ও এখনও নবদ্বীপে পড়ানো হয়। কোলক্ৰক সাহেব তীব্র ‘দায়ক্ৰমসংগ্ৰহ-এর ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন।
স্মার্তপণ্ডিত হিসাবে নদীয়ার রাজবংশের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। শ্ৰীকৃষ্ণ সার্বভৌম। ১৭০৩ খ্রীস্টাব্দে নবদ্বীপাধিপতি রামকৃষ্ণ রায় তাঁকে ভূমিদান করেন, ও রাজা রামজীবনের তিনি সভাপণ্ডিত ছিলেন। তাঁর রচিত গ্রন্থের মধ্যে প্রসিদ্ধ ‘কৃষ্ণপদামৃত’ (১৭২২), ‘পদাঙ্কদূত’ (১৭২৩), ‘মুকুন্দপদমাধুরী’ ও ‘সিদ্ধান্তচিন্তামণি’। অষ্টাদশ শতাব্দীতে তন্ত্রশস্ত্রে বিশেষ বুৎপত্তি ছিল হুগলী পালপাড়ার হরিহরানন্দনাথ তীৰ্থস্বামীর (১৭৬২-১৮৩২)। তার ‘কুলাবধূত উপাধি ছিল। রাজা রামমোহনের (১৭৭২-১৮৩৩) সঙ্গে তার বিশেষ হৃদ্যতা ছিল, এবং অনেকের মতে তিনি রামমোহনের তন্ত্রশিক্ষার গুরু ছিলেন। তাঁর রচিত ‘কুলাৰ্ণবতন্ত্র’ ও ‘মহনির্বাণতন্ত্র’-দ্বয়ের টাকা তন্ত্রশাস্ত্রে তার অসাধারণ, পাণ্ডিত্যের পরিচয় দেয়।
দুই
পণ্ডিতগণ কর্তৃক শাস্ত্র অনুশীলন ও সংস্কৃত ভাষায় প্রামাণিক টাকা-টিপ্পনী রচনা ছাড়া, অষ্টাদশ শতাব্দী উদ্ভাসিত হয়ে আছে বাংলা সাহিত্যচর্চার আলোকে। সুধীজন, নূতন নূতন কাব্য রচনা করেছিলেন, এবং এ বিষয়ে অনেকেই সমসাময়িক রাজারাজড়াদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। যারা এরূপ পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন রামেশ্বর (চক্রবর্তী) ভট্টাচাৰ্য, ঘনরাম চক্রবর্তী, ভারতচন্দ্ৰ, কবিচন্দ্ৰ, জগন্দ্রাম ও নিত্যানন্দ। রামেশ্বরই ছিলেন অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের সবচেয়ে বড় কবি। তাঁর কথা আমরা আগেই বলেছি।
‘শিবায়ন’ ছাড়াও রামেশ্বর রচনা করেছিলেন একখানা ‘সত্যনারায়ণের পাঁচালী’ ও মহাভারতের শাস্তিপর্ব অবলম্বনে এক কাব্য।
আঠারো শতকের গোড়ার দিকে বিষ্ণুপুররাজ গোপাল সিংহের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন শঙ্কর কবিচন্দ্র। তিনি গোপাল সিংহের (১৭১২-৪৮) সভাকবি ছিলেন। তাঁর রচিত গ্রন্থের মধ্যে ছিল ‘গোবিন্দমঙ্গল’, ‘কৃষ্ণমঙ্গল’, ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’ প্ৰভৃতি।
সমসাময়িককালে তাঁর কবিখ্যাতির জন্য বর্ধমান-রাজ কীৰ্তিচন্দ্ৰ কতৃক সভাকবির পদে বৃত হয়েছিলেন ঘনরাম চক্রবর্তী। রাজার আদেশে তিনি একখান ‘ধর্মমঙ্গল’ কাব্য রচনায় প্ৰবৃত্ত হন, এবং ১৭১১ খ্রীস্টাব্দে, তা সম্পূৰ্ণ করেন। তিনিও একখানা ‘সত্যনারায়ণের পাঁচালী’ রচনা করেছিলেন।
ঘনরামের কাব্যভাষার উত্তরসূরী হচ্ছেন রায় গুণাকর ভারতচন্দ্ৰ (১৭১২১৭৬০)৷ নানারূপ অদৃষ্টবৈগুণ্যের পর তিনি নদীয়াধিপতি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আশ্রয় পান, এবং তাঁর সভাকবি নিযুক্ত হন। কৃষ্ণচন্দ্রের আদেশে তিনি ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্য রচনা করে ‘রায় গুণাকর’ উপাধি পান। তিনি আরও রচনা করেন ‘বিন্যাসুন্দর’, ‘রাসমঞ্জরী’, ‘সত্যপীরের কথা’, ‘নাগাষ্টক’ প্ৰভৃতি গ্ৰন্থ। ভাষার লালিত্য, ও সুষমা ছন্দের নৈপুণ্য ও চরিত্র অঙ্কনের দক্ষতার জন্য তিনি প্ৰসিদ্ধ।
পঞ্চকুটাধিপতি রঘুনাথ সিংহের আদেশে একখানা ‘অদ্ভুত রামায়ণ’ রচনা করেছিলেন বাঁকুড়া জেলার ভুলুই গ্রামের জগন্দ্রাম রায়। মূল অদ্ভুত রামায়ণ-এর नgझ ५८ीव्र (कान् शिश G惠। এতে রামায়ণের সপ্তকাণ্ড ছাড়া পুষ্কর্যাকাণ্ড নামে একটা অতিরিক্ত কাণ্ড আছে। ‘অদ্ভুত রামায়ণ’ ছাড়া তিনি আরও রচনা করেছিলেন ‘দুর্গাপঞ্চরাত্র’, ‘আত্মবোধ’ ইত্যাদি।