পাঁচ
মাত্র হিন্দুরাই যে মন্দির তৈরী করে যাচ্ছিলেন, তা নয়। মুসলমানরাও অষ্টাদশ শতাব্দীতে বহু মসজিদ ও দরগা নির্মাণ করেছিলেন। তার মধ্যে প্ৰসিদ্ধ হচ্ছে মুরশিদাবাদের নিকট মুরশিদকুলি খান কর্তৃক নির্মিত কাটরা মসজিদ। এই মসজিদটি তৈরী হয়েছিল ১৭২৩ খ্রীস্টাব্দে। এটি একটি প্ৰশস্ত সমচতুষ্কোণ অঙ্গনের মধ্যে নির্মিত। মসজিদটি ১৩০ ফুট লম্বা ও ২৪ ফুট চওড়া। অনেক হিন্দু মন্দির ভেঙে তারই মালমশলা দিয়ে মসজিদটি তৈরী করা হয়েছিল। মসজিদটির চারকোণে ৬০ ফুট উচ্চ চারটি অষ্টকোণ মিনার ছিল। ৬৭টি ঘোরানো সিড়ি দিয়ে মিনারের চূড়ায় ওঠা যেত। মসজিদটির আঙ্গিনায় ওঠবার জন্য ১৪টি সোপান ছিল। এই সোপানের তলাতেই মুরশিদকুলি খানের সমাধিকক্ষ অবস্থিত। ১৭৬৭ খ্রীস্টাব্দে মীরজাফরের স্ত্রী মুনিবেগমও মুরশিদাবাদের প্ৰসিদ্ধ চক মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন।
শাস্ত্রানুশীলন, সাহিত্যসাধনা ও সঙ্গীতচর্চা
অষ্টাদশ শতাব্দীর যে সব পণ্ডিতের নাম আগের এক অধ্যায়ে উল্লেখ করেছি, তাদের সকলেরই টোল বা চতুষ্পাঠী ছিল। এই সকল চতুষ্পাষ্ঠীর মাধ্যমেই তঁরা শাস্ত্রানুশীলন করতেন ও ছাত্রদের নানা শাস্ত্র এবং শব্দ, ব্যাকরণ, কাব্য, অলঙ্কার, ছন্দ প্ৰভৃতি বিষয়ে শিক্ষাদান করতেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই নৈয়ায়িক ও স্মার্ত হিসাবে প্ৰতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন। অনেকে বিচিত্র বিধানও দিতেন। যেমন কৃষ্ণানন্দ সার্বভৌম (১৭৭৫-১৮৪০) শারদীয়া পূজার নবমীর দিনই দুর্গ। প্ৰতিমার বিসর্জনের বিধান দিয়েছিলেন। তা থেকেই ‘কৃষ্ণানন্দী দশহরা’ প্ৰবাদ বাক্যে দাঁড়িয়েছে। বরিশাল কলসিকাঠির বিখ্যাত ব্ৰাহ্মণ জমিদারবংশের পৃষ্ঠপোষকতায় যে সকল পণ্ডিত বাকলা সমাজকে উজ্জ্বল করেছিলেন, কৃষ্ণানন্দ ছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন দিকপাল। নবদ্বীপে শঙ্কর তর্কবাগীশের কাছে শিক্ষালাভ করে নিজ প্ৰতিভাগুণে তিনি যশস্বী হয়েছিলেন। ভারতের নানা অঞ্চল থেকে ছাত্ররা তার চতুষ্পাঠীতে শিক্ষালাভ করতে আসত।
ত্ৰিবেণীর জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের (১৬৯৪-১৮০৭) কথা আমরা আগেই বলেছি। অষ্টাদশ শতাব্দীতে এরকম দীর্ঘজীবী ও অসাধারণ পণ্ডিত আর দ্বিতীয় ছিল না। তাঁর মৃত্যুর পূর্বে তাঁকে গঙ্গাজলী করবার জন্য যখন তাকে নিয়ে আসা হয়, তখন তাঁর ছাত্রমণ্ডলী তাঁকে প্রশ্ন করেছিল ‘আপনি তো দীর্ঘকাল ধরে শাস্ত্রাঙ্কুশীলন ও ঈশ্বর সাধনা করলেন, এখন আমাদের বলে যান, ঈশ্বর সাকার না নিরাকার?’ জগন্নাথ উত্তর দিয়েছিল ‘ঈশ্বর নীরাকার’।
অন্যান্য সুত্র থেকেও আমরা অনেক পণ্ডিতের নাম পাই। নবদ্বীপের গোকুলানন্দ বিস্তামণি অষ্টাদশ শতাব্দীর একজন অসাধারণ জ্যোতির্বিদ পণ্ডিত ছিলেন। তিনি দেশীয় প্রথায় একটি উৎকৃষ্ট ঘড়ি তৈরী করেছিলেন, যার সাহায্যে দণ্ড, পল, ইত্যাদির সুক্ষ্মসময় সঠিকভাবে নির্ণয় করা যেত। নবদ্বীপের গোপাল (রামগোপাল) ন্যায়ালঙ্কার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্ৰের সভাপণ্ডিত ছিলেন। রাহা রাজবল্লভ (১৬৯৮-১৭৬৩) যখন তাঁর অষ্টমবর্ষীয়া বিধবা কন্যার বিয়ে দেবার জন্য কৃষ্ণচন্দ্রের মতামত জানবার জন্য কয়েকজন পণ্ডিত পাঠান, তখন তারা গোপালকে তর্কযুদ্ধে হারিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু গোপাল অপকৌশল প্রয়োগ করে বিধবা বিবাহ দেশাচার বিরুদ্ধ বলে প্রচার করে, এবং রাজবল্লাভের চেষ্টা ব্যৰ্থ করে। তিনি ‘আচারনির্ণয়’, ‘উদ্বাহনির্ণয়’, ‘কালনির্ণয়’, ‘শুদ্ধিনির্ণয়’, ‘দায়নির্ণয়’, ‘বিচার নির্ণয়’, ‘তিথিনির্ণয়’, ‘সংক্রান্তিনির্ণয়’, প্ৰভৃতি গ্ৰন্থ রচনা করে গেছেন।
ফরিদপুরের চন্দ্রনারায়ণ ন্যায়পঞ্চানন একজন প্ৰখ্যাত নৈয়ায়িক পণ্ডিত ছিলেন। নিজ শাস্ত্ৰজ্ঞান দ্বারা তিনি নদীয়ার শঙ্কর তর্কবাগীশ, ত্ৰিবেণীর জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন প্রভৃতি পণ্ডিতদের সন্তুষ্ট করেছিলেন। নব্যন্যায়ে তার রচিত ‘চান্দ্রনারায়ণী’ পত্রিকা পণ্ডিতসমাজে প্রচারিত হয়েছিল। এ ছাড়া তিনি ‘কুসুমাঞ্জলি’র টীকা ও ন্যায়সূত্রের বৃত্তি রচনা করেছিলেন।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে পূর্ববঙ্গের বাকুলার একজন বড় পণ্ডিত ছিলেন জগন্নাথ পঞ্চানন। তাঁক্স পাণ্ডিত্যের সুবাদে তাঁর গ্রাম নলচিড়া ‘নিম নবদ্বীপ’ বা অর্ধনবদ্বীপ আখ্যা পেয়েছিল।
২৪ পরগণার খাটুরার অনস্তরাম বিদ্যাবাগীশের অসাধারণ পাণ্ডিত্য ছিল স্মৃতি শাস্ত্ৰে। শোভাবাজার রাজবাটিতে তাঁর যথেষ্ট প্ৰতিপত্তি ছিল এবং কলকাতার হাতিবাগানে তিনি একটি টোল খুলেছিলেন। তাঁরই জ্ঞাতি ও ছাত্র ছিলেন। কালীকিঙ্কর তর্কবাগীশ। একবার শোভাবাজার রাজবাটিতে কোনও এক বিচারে জয়লাভ করে তিনি নিজ অধ্যাপক অনন্তরামের সম্মান বৃদ্ধি করেছিলেন।
কৃষ্ণরাম ভট্টাচাৰ্য ছিলেন নদীয়ার মালীপোতার একজন বিখ্যাত শাস্ত্রজ্ঞপণ্ডিত। আসামের আহমবংশীয় নৃপতি রুদ্ৰসিংহ হিন্দু শাস্ত্রাহ্যায়ী ক্রিয়া কলাপাদির (১৬৯৬-১৭১৪) জন্য তাঁকে আহবান করে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং তাঁর কাছ থেকে শক্তিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিলেন। কামাখ্যা মন্দির রক্ষার ভার তার ওপর অৰ্পিত হয়েছিল। সাহিত্যে অসাধারণ পাণ্ডিত্য ছিল নদীয়ার বজাপুরের জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের (১৭৭৫-১৮৪৬)। তিনি প্ৰাচ্যতত্ত্ববিদ কোলক্রকের এবং পরে শ্ৰীরামপুর মিশনের ক্যারীর পণ্ডিত ছিলেন। স্বকবি হিসাবেও তিনি সুপরিচিত ছিলেন। ফারসী ভাষাতেও তঁরে দখল ছিল, এবং • তিনি একখানা ফারসী অভিধানও সংকলন করেছিলেন। নৈয়ায়িক হিসাবে সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন নদীয়ার রামভদ্র সার্বভৌমের ছাত্র জয়রাম ন্যায়পঞ্চানন। নদীয়ারাজ রামকৃষ্ণ তীর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর রচিত নয়খানা। গ্রন্থের মধ্যে প্ৰসিদ্ধ ‘ন্যায়সিদ্ধান্তমালা’, ‘তত্ত্বচিন্তামণি’, ‘গুণদীধিতিবিবৃতি’, ‘কাব্যপ্ৰকাশতিলক’ ইত্যাদি। কাশীতে অধ্যাপনাকালে তিনি তার পাণ্ডিত্যের, জন্য “জগদগুরু’ আখ্যা লাভ করেছিলেন। নৈয়ায়িক হিসাবে নাম করেছিলেন ত্রিপুরার কালীকচ্ছের দয়ারাম ন্যায়ালঙ্কার। বহু দূরদেশ থেকে ছাত্ররা তাঁর চতুষ্পাঠীতে পড়তে আসত।