দুই
বাঙলা দেশের বহু ইটের মন্দিরের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ‘টেরাকোটা’ বা পোড়ামাটির অলঙ্করণ। এগুলি সাধারণত তৈরী করা হত। টালির আকারে ছাচে ফেলে, বা কাঁচামাটির ওপর উৎকীর্ণ করে ‘পোন’ বা ভাটিতে পুড়িয়ে। এরূপ অলঙ্করণের দিক দিয়ে হালিশহরের নন্দকিশোরজীউর মন্দির ও বীরভূমের মন্দিরসমূহ বিশেষ প্ৰসিদ্ধ। অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীর মন্দিরগুলির অলঙ্করণের বিষয়বস্তু হচ্ছে—রামায়ণ, মহাভারত ও পৌরাণিক কাহিনী, কৃষ্ণলীলা-বিষয়ক বৃত্তান্ত, সমকালীন সমাজচিত্র, বন্যপশুর অনায়াস বিচরণ-ভঙ্গী ও সাবলীল গতিবেগ, এবং ফুল, লতাপাত ও জ্যামিতিক নকশা প্ৰভৃতি। রামায়ণের কাহিনীর মধ্যে চিত্রিত হয়েছে হরধনুভঙ্গ, রামসীতার বনগমন, সূৰ্পণখার নাসিকাছেদন, মারীচবধ, রাবণ-জটায়ুর যুদ্ধ, জটায়ুবিধ, অশোক বনে সীতা প্ৰভৃতি, এবং মহাভারতের কাহিনীর মধ্যে অর্জনের লক্ষ্যভেদ, শকুনির পাশাখেলা, দ্ৰৌপদীর বস্ত্রহরণ, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধদৃশ্য, ভীষ্মের শরশয্যা প্রভৃতি। পৌরাণিক বিষয়বস্তুর মধ্যে রূপায়িত হয়েছে বিষ্ণুর দশাবতার, দশ দিকপাল, দশ মহাবিদ্যা ও অন্যান্য মাতৃকাদেবীসমূহ এবং অন্যান্য জনপ্রিয় উপাখ্যান যথা-শিববিবাহ, দক্ষযজ্ঞ, মহিষাসুরমর্দিনী ইত্যাদি। সামাজিক দৃশ্যসমূহের মধ্যে আছে বারাঙ্গন-বিলাস ও নানাবিধ আমোদ-প্ৰমোদ, বেদেবেদেনীর কসরৎ, সাহেবদের কাছে এদেশী মেয়েদের প্ৰেম-নিবেদন, মোহান্ত সম্প্রদায়ের আচার-আচরণ ও নানারূপ ঘরোয়া দৃশ্য। (এই প্রসঙ্গে এই লেখকের ‘বাঙলা ও বাঙালী’ পৃঃ ৩৮-৫৬ ও ‘বাঙলার সামাজিক ইতিহাস’ পৃঃ ৭৮-৮০ দ্রষ্টব্য)।
তিন
এইবার অষ্টাদশ শতাব্দীতে নির্মিত মন্দিরগুলি সম্বন্ধে কিছু বলি। অষ্টাদশ শতাব্দীর মন্দির-নির্মাতা বিশিষ্ট ভূম্যাধিকারীদের মধ্যে ছিলেন নাটোরের রাণী ভবানী, নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়, ভূষণার সীতারাম রায় প্রমুখ। (কলকাতার মন্দির নির্মাতাগণ সম্বন্ধে নীচে দেখুন)। পূর্ববতী সপ্তদশ শতাব্দীর প্রবল প্রতাপশালী ভূম্যাধিকারী ছিলেন বাঁকুড়া-বিষ্ণুপুরের মল্লরাজগণ। তাদের রাজত্বকালই ছিল মধ্যযুগের হিন্দু মন্দির নির্মাণের স্বর্ণযুগ। সপ্তদশ শতাব্দীতে নির্মিত তাদের অনেক মন্দির এখন পরিত্যক্ত বা ভগ্ন অবস্থায় বিষ্ণুপুরে দেখতে পাওয়া যাবে। এ সকল মন্দিরের কারুকার্য ও স্থাপত্যরীতি এখনও আমাদের বিস্ময় উদ্রেক করে। যদিও অষ্টাদশ শতাব্দীতে বিষ্ণুপুরের রাজাদের আধিপত্য অনেক পরিমাণে হ্রস পেয়েছিল এবং তার সঙ্গে মন্দির নির্মাণের ধারাও স্তিমিত হয়েছিল, তা হলেও অষ্টাদশ শতাব্দীতে মল্লরাজগণ কতৃক মন্দির নির্মাণ একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। মল্লরাজগণ কতৃক অষ্টাদশ শতাব্দীতে নির্মিত মন্দিরের মধ্যে উল্লেখের দাবী রাখে লালবঁধের ধারে কালাচাদের মন্দির ও ১৭৫৮ খ্রীস্টাব্দে নির্মিত রাধাশ্যামের মন্দির। অষ্টাদশ শতাব্দীতে বিষ্ণুপুরের বসুপল্লীতে বসুপরিবারের কোন ব্যক্তি নবরত্ন শ্ৰীধর মন্দিরটিও নির্মাণ করিয়েছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ভূষণার রাজা সীতারাম রায় একটি কৃষ্ণমন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন (১৭০৩-০৪)। এই শতাব্দীতেই নির্মিত হয়েছিল বর্ধমান জেলার অন্তর্গত খাটনগরের লক্ষ্মীনারায়ণের পঞ্চরত্ন মন্দির (১৭৫৪), ও তারই কাছে অবস্থিত শিখরবিশিষ্ট একটি শিবমন্দির ও দিনাজপুরের ১২ মাইল দূরে অবস্থিত কান্তনগরের বিচিত্র কারুকার্যখচিত নবরত্ন মন্দির (১৭০৪-২২)। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে নির্মিত হয়েছিল বর্ধমান জেলার কালনা গ্রামে অবস্থিত পচিশ-রত্ন লালজীর মন্দির ও কৃষ্ণচন্দ্ৰ মন্দির। শতাব্দীর মধ্যভাগে একটা পাথরের তৈরী ‘রেখ’ দেউল তৈরী হয়েছিল বীরভূম জেলার ভাণ্ডীশ্বরে (১৭৫৪)। শতাব্দীর গোড়ার দিকে (১৭০৪) পুরুলিয়ার ধরা পাট গ্রামের রেখ’ মন্দিরটিও পাথর দিয়েই তৈরী হয়েছিল। তা না হলে, বাঙলাদেশের মন্দিরগুলো সব ইটেরই তৈরী। মুরশিদাবাদের সন্নিকটে ভাগীরথীর পশ্চিমতীরে বড়নগরে রাণী ভবানী বহু মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। তার মধ্যে বিশাল ভবানীশ্বর মন্দিরই সবচেয়ে বড়। এখানে এক পুষ্করিণীর চারপাশে চারটি জোড়বাংলা মন্দিরও আছে। শতাব্দীর শেষের দিকে ত্রিপুরাধিপতি কৃষ্ণমাণিক্য (-১৭৭৩)-এর আমলে কুমিল্লায় এক সপ্তদশ-রত্ন মন্দির নির্মিত হয়েছিল।
অষ্টাদশ শতাব্দীর মন্দির-নির্মাণ পদ্ধতির একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সারিবদ্ধভাবে অনেকগুলি মন্দির তৈরী করা। অধিকাংশ স্থলেই এটা শিবমন্দিরের ক্ষেত্রেই অবলম্বিত হত। এরূপ সারিবদ্ধ মন্দিরের সংখ্যা ১২ থেকে ১০৮ পর্যন্ত হত। যেমন, রাণী ভবানী বড়নগরে ১০০ শত শিবমন্দির তৈরী করেছিলেন।
চার
এবার অষ্টাদশ শতাব্দীতে তৈরী কলকাতার কতগুলি মন্দিরের কথা বলব। মনে হয়ে, অষ্টাদশ শতাব্দীতে কলকাতার মন্দিরসমূহের মধ্যে সবচেয়ে প্ৰাচীন হচ্ছে নন্দরাম সেন, বনমালী সরকার ও গোবিন্দরাম মিত্ৰ নির্মিত মন্দিরসমূহ। নন্দরাম সেন প্রতিষ্ঠিত রামেশ্বর শিবের মন্দির নন্দরাম সেন স্ত্রীটে অবস্থিত। নন্দরাম সেন ছিলেন কলকাতার প্রথম কালেকটর র্যােলক্ শেলডনের সহকারী। সেজন্য মনে হয় মন্দিরটি অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বনমালী সরকারের শিবমন্দির ও গোবিন্দরাম মিত্রের নবরত্ন মন্দির, এ দুটোও অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম তিন চার দশকের মধ্যেই নির্মিত হয়েছিল। দুটো মন্দিরই কুমারটুলিতে অবস্থিত ছিল। মন্দিরের গায়ে খোদিত তারিখ অনুযায়ী ঠিনঠনিয়ার সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দিরও অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে স্থাপিত হয়েছিল, তবে তারিখটা সন্দেহজনক। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে যে সব মন্দির স্থাপিত হয়েছিল, তার মধ্যে ছিল মদনমোহন দত্তের শিবমন্দিরসমূহ। মদনমোহন ছিলেন বিখ্যাত ব্যবসায়ী ও হাটখোলার দত্ত পরিবারের প্রতিভূ। তাঁর স্থাপিত আটচালারীতিতে গঠিত দুটি শিবমন্দিরই হাটখোলায় অবস্থিত। ত্ৰিলোেকরাম পাকরাশী স্থাপিত মন্দিরগুলি বৌবাজারে কিণ্ডারডাইন লেনে অবস্থিত। একটি নবরত্ব ও দুটি পঞ্চরত্ন। ত্ৰিলোেকরাম ছিলেন। কলকাতা দুর্গের দেওয়ান। কলকাতায় নূতন দুর্গ নির্মাণের সময় যে সব মালমশলা ব্যবহৃত হয়েছিল, এই মন্দিরগুলি সেই সেই মালমশলায় নির্মিত। সেজন্য মনে হয় এগুলি অষ্টাদশ শতাব্দীর ষাটের দশকে তৈরী হয়েছিল। ১৭৮০ খ্ৰীস্টাব্দে স্থাপিত হয়েছিল ভূকৈলাস রাজবাড়ীর শিবগঙ্গা জলাধারের উক্তর দিকের ঘাটের দুইপাশে আটচালা-রীতিতে নির্মিত দুটো বড় শিব মন্দির। সমসাময়িককালে কতকগুলি আটচালা শিবমন্দির তৈরী করিয়েছিলেন বাগবাজারে দুর্গাচরণ মুখুজ্যে মশায়। এগুলো প্রায় সবই গিরিশ অ্যাভেন্যুর গর্ভে গিয়েছে।