পাঁচ
অষ্টাদশ শতাব্দীর শিক্ষাপ্রসারে ওয়ারেন হেস্টিংস-এর (১৭৩২-১৮৮১) নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। হেস্টিংস ছিলেন একজন বিদ্যানুরাগী ব্যক্তি। প্ৰাচ্যবিদ্যাসমূহের প্রতি তাঁর প্রগাঢ় অনুরাগ ছিল। তিনি হিন্দু আইনের যে বই এদেশের এগার জন পণ্ডিতদের দিয়ে প্রণয়ন করিয়েছিলেন তার কথা আমর! আগেই বলেছি। এ ছাড়া, তিনি হালহেডকে দিয়ে ইংরেজিতে বাংলাভাষার একখানা ব্যাকরণ লিখিয়েছিলেন এবং তা ছাপাবার জন্য চালস উইলকিনসকে দিয়ে বাংলা হরফ তৈরী করিয়েছিলেন। উইলকিনসকে দিয়ে তিনি ‘শ্ৰীমদভগবদগীতা’র ইংরেজি অনুবাদও করিয়েছিলেন, এবং তার ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন। মুসলমানদের উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি একটা মাদ্রাসাও স্থাপন করেছিলেন। এ সম্পর্কে ১৭৮০ খ্রীস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতার শিক্ষিত পদস্থ মুসলমানরা ওয়ারেন হেস্টিংস-এব। সঙ্গে দেখা করে জানান যে, তারা মাজিউদ্দিন নামে একজন পণ্ডিতের সন্ধান পেয়েছেন, এবং এই সুযোগে একটা মাদ্রাসা বা কলেজ প্ৰতিষ্ঠা করলে মুসলমান ছাত্ররা মজিউদিনের অধীনে মুসলমান আইন শিখে সরকারী কাজে সহায়তা করতে পারবে। হেস্টিংস এই প্ৰস্তাবে সম্মত হয়ে পরবর্তী অকটোবর মাসে মজিউদিনের ওপর একটা মাদ্রাসা স্থাপনের ভার দেন। আগে বৌবাজারের দক্ষিণপূর্বে যে বাড়ীতে চার্চ অভ স্কটল্যাণ্ডের জেনানা মিশন ছিল, সেই জমির ওপরই মাদ্রাসটি প্রথম নির্মিত হয়েছিল। কিন্তু সনাতনী হিন্দুদের তরফ থেকে এরূপ কোন প্ৰস্তাব না আসায়, কোন সংস্কৃত কলেজ স্থাপিত হয়নি। বস্তুতঃ শিক্ষার ব্যাপারে মুসলমানরা যেরূপ উদ্যোগী ছিল, সনাতনী হিন্দুরা সেরূপ ছিল না। এ সম্পর্কে অষ্টাদশ শতাব্দীর একজন বিশিষ্ট দানশীল মুসলমানের নাম উল্লেখযোগ্য। তিনি হচ্ছেন হাজী মহম্মদ মহসীন (১৭৩২-১৮১২)। তিনি মুসলমানদের শিক্ষার উন্নতিকল্পে এক লক্ষ ৫৬ হাজার টাকা আয়ের এক সম্পত্তি দান করেছিলেন। হুগলীর ইমামবাড়া, হুগলী কলেজ, মাদ্রাসা, মহসীন বৃত্তি প্ৰভৃতি তাঁরই অর্থ সাহায্যে প্রতিষ্ঠিত। এ ছাড়া, তার অর্থে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও হুগলীতে আরবী শিক্ষার জন্য বিদ্যায়তন স্থাপিত হয়েছিল।
গোড়ার দিকে ইংরেজদেরও এদেশে শিক্ষাবিস্তারের প্রয়াসের অভাব ছিল। এ সম্বন্ধে ডবলিউ. ডবলিউ. হাণ্টার বলেছেন–’During the early days of the East India Company’s rule the promotion of education was not recognised as a duty of government’। বস্তুতঃ শতাব্দীর উত্তীর্ণ হবার পর ১৮১৩ খ্রীস্টাব্দের,সময়েই শিক্ষাবিস্তারের জন্য প্রথম এক লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। প্ৰসঙ্গত এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে পরবর্তী কালে ইংরেজি ভাষার শব্দ বাংলা ভাষাকে (বিশেষ করে কথ্যভাষাকে) বেশ সমৃদ্ধশালী করে তুলেছিল।
মঠ, মন্দির ও মসজিদ
বাঙলার অনেক বিত্তবান ও প্রভাবশালী ব্যক্তিই চৈতন্য (১৪৮৫-১৫৩০) প্রচারিত গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম গ্ৰহণ করেছিলেন। চৈতন্যের তিরোভাবের পর তারা অনেকেই বাঙলার নানাস্থানে রাধাকৃষ্ণ ও গৌর-নিতাই-এর মন্দির স্থাপন করেছিলেন। তাছাড়া, বৈষ্ণবরা অনেক মঠও প্ৰতিষ্ঠা করেছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতেও এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল। তা ছাড়া, অষ্টাদশ শতাব্দীতে বহু শিবমন্দির ও শক্তিমন্দিরও নির্মিত হয়েছিল। অধিকাংশ স্থানেই এই সকল মন্দির নির্মাণে বাঙলার নিজস্ব স্থাপত্যরীতি অনুসৃত হয়েছিল। বাঙলার নিজস্ব স্থাপত্য রীতি কি তা এখানে বলা প্ৰাসঙ্গিক হবে।
বাঙলার মন্দিরসমূহকে সাধারণত তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়-(১) চালা, (২) রত্ন, ও (৩) দালান রীতিতে নির্মিত মন্দির। এগুলো ভারতীয় মন্দির-স্থাপত্যের ক্ষেত্রে সাধারণভাবে স্বীকৃত ‘রেখ’, ‘বেশরি’ ও ‘দ্রাবিড়’ শৈলীরীতিতে নির্মিত মন্দিরসমূহ থেকে ভিন্ন। তার মানে বাঙলার মন্দিরসমূহ বাঙলার নিজস্ব স্থাপত্যরীতিতে গঠিত। গ্রাম-বাঙলার সর্বত্র খড়ের যে চারাচালার কুটির দেখতে পাওয়া যায়, তার অনুকরণে নির্মিত হত চারাচালা মন্দির। একটি চারাচালা মন্দিরের মাথার ওপর আর-একটি ছোট চারাচালা মন্দির নির্মাণ করে আটচালা মন্দির গঠন করা হত। আটচালা মন্দিরের নিদর্শন বাঙলার সর্বত্র পরিদৃষ্ট হয়। বাঙলার শিবমন্দিরগুলি সাধারণতঃ এই শৈলীরীতিতে গঠিত মন্দির। কালীঘাটের কালীমন্দিরও এই রীতিতে গঠিত মন্দির। আর যখন মাঝখানে একটি বড় শিখর বা চুড়া তৈরী করে, তার চার কোণে চারটি ছোট শিখর বা চুড়া তৈরী করা হত, তাকে ‘পঞ্চরত্ব মন্দির বলা হত। আবার যখন পঞ্চরত্ন মন্দিরের মাঝের চূড়াটির স্থানে একটি দ্বিতল কুঠরি তৈরী করে, তার ছাদের চারকোণে চারটি ছোট চুড়া ও মাঝখানে একটি বড় চুড়া তৈরী করা হত, তখন তাকে ‘নবরত্ন’ মন্দির বলা হত। এভাবে এক এক তল বাড়িয়ে মন্দিরকে ভ্ৰয়োদশরত্ব, সপ্তদশরত্ন করা হত। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে যে উনবিংশ শতাব্দীতে নির্মিত দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণীর মন্দির নবরত্ন মন্দির। যেখানে শিখরের বদলে মন্দিরের ছাদ সমতল হত, তাকে ‘দালান’ রীতিতে গঠিত মন্দির বলা হত। বাগবাজারের সিদ্ধেশ্বরীর মন্দির দালানরীতিতে গঠিত মন্দিরের নিদর্শন। বলা বাহুল্য, বাঙলার মন্দিরসমূহ ইট দিয়ে তৈরী করা হত। পাথর দিয়ে নয়।. তবে পাথরের তৈরী মন্দিরও দু-চারটে আছে, তবে সেগুলি ‘রেখ’ মন্দির।