নাড়াজোল রাজবংশের আদিপুরুষ হচ্ছেন উদয়নারায়ণ ঘোষ। উদয়নারায়ণের প্রপৌত্রের ছেলে কাৰ্তিকরাম মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে ‘রায়’ উপাধি পান। তার পর তিন পুরুষ ধরে ওই বংশ ওই উপাধি ব্যবহার করেন। তারপর ওই বংশের অভিরাম রায় সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ‘খান’ উপাধিতে ভূষিত হন। অভিরামের মধ্যমপুত্ৰ শোভারাম খানের পুত্ৰ মতিরাম রাণী শিরোমণির তত্ত্ববধায়ক হন। মতিরামের মৃত্যুর পর তাঁর পিতৃব্যপুত্ৰ সীতারাম খান রাজ্যের রক্ষক হন । ১৮০০ খ্রীস্টাব্দে সম্পাদিত এক দানপত্র দ্বারা রাণী শিরোমণি সমস্ত রাজ্য সীতারামের জ্যেষ্ঠপুত্র আনন্দলালকে দান করেন। আনন্দলাল নিঃসন্তান অবস্থায় ১৮১০ খ্রীস্টাব্দে মারা যান। তিনি তাঁর ছোট ভাই মোহনলালকে কৰ্ণগড় রাজ্য ও মধ্যম ভাই নন্দলালকে নাড়াজোল রাজ্য দিয়ে যান ।
মেদিনীপুরের অন্তৰ্গত মুকসুদপুরের ভুঁইয়ারাও অতি প্ৰসিদ্ধ সদ্গোপ জমিদার ছিলেন। এছাড়া, মেদিনীপুরে অন্য জাতির জমিদারীও অনেক ছিল। তন্মধ্যে চেতুয়া-বরদার রাজারা, তমলুকের রাজারা, ঝাড়গ্রামের রাজারা, জামবনির রাজার, ঝাটিবণির রাজার ও ঘাটশিলার রাজারা উল্লেখের দাবী রাখে। এঁদের অনেকের সঙ্গেই বাঁকুড়ার মল্লরাজাদের মিত্ৰতা ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে তমলুকের রাজা ছিলেন কৈবর্ত জাতিভুক্ত আনন্দনারায়ণ রায়। ময়ুরধ্বজ তাম্রধ্বজ, হংসধধ্ব ও গরুড়ধ্বজ নামে চারজন রাজার পর আনন্দনারায়ণের উর্ধ্বতন ৫৬তম পূর্বপুরুষ বিদ্যাধর রায় এই রাজবংশ প্ৰতিষ্ঠা করেন। এই বংশের রাজারা বহু দেবদেউল নিৰ্মাণ করেন, তন্মধ্যে বর্গভীমের মন্দির সুপ্ৰসিদ্ধ।
চৈতন্য মহাপ্ৰভুর সময় ঝাড়খণ্ড বা ঝাড়গ্রাম ‘বন্যজাতি’ অধ্যুষিত ও ওড়িশাময়ূরভঞ্জের বনপথের সংলগ্ন ছিল। খ্ৰীস্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে ঝাড়গ্রামে যে রাজবংশ রাজত্ব করতেন, তাদের আদিপুরুষ ষোড়শ শতাব্দীতে ফতেপুর সিকরি অঞ্চল থেকে পুরীর জগন্নাথ ক্ষেত্রে তীর্থ করতে আসেন এবং আভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে ঝাড়গ্রামে একটি রাজ্য প্ৰতিষ্ঠা করেন। বাঁকুড়ার মল্লরাজগণের সঙ্গে ঝাড়গ্রামের রাজাদেরও বিশেষ মিত্ৰতা ছিল ।
বর্ধমানের রাজবংশ সম্বন্ধেও অনুরূপ কিংবদন্তী শোনা যায়। ওই বংশের প্ৰতিষ্ঠাতা সংগ্ৰামসিংহ পঞ্জাব থেকে শ্ৰীক্ষেত্রে তীর্থ করতে আসেন। ফেরবার পথে তিনি বর্ধমানের বৈকুণ্ঠপুর গ্রামে একখানা দোকান করেন। তারপর দোকানদারী থেকে জমিদারী ও জমিদারী থেকে রাজ্য স্থাপন। যাদের জমি গ্ৰাস করে তিনি রাজ্য স্থাপন করেন, তারা হচ্ছে গোপীভূমের সাদগোপ রাজারা। ১৯১০ খ্রীস্টাব্দে J.C.C Peterson, I. C. S. ‘বেঙ্গল ডিস্ট্রিকটস্ গেজেটিয়ারস্’-এর বর্ধমান খণ্ডে সদগোপ রাজাদের পরিখাবেষ্টিত নগরীসমূহ, প্রাসাদ, দুর্গ, মূর্তি ও মন্দিরাদির ধ্বংসাবশেষ দেখে বিস্মিত হয়ে লিখেছিলেন যে, “একদা দামোদর-অজয় বেষ্টিত ভূখণ্ডের এক বিস্তৃত অঞ্চলে সদগোপ রাজাদের আধিপত্য ছিল।” সাম্প্রতিককালে বিনয় ঘোষ তার ‘পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’ গ্রন্থে বলেছেন–‘গোপভূমের সদ্গোপ রাজবংশের ইতিহাস রাঢ়ের এক গৌরবময় যুগের ইতিহাস। আজও সেই অতীতের স্মৃতি-চিহ্ন ভালকি, আমরাগড়, কাঁকশা, রাজগড়, গৌরাঙ্গপুর প্ৰভৃতি অঞ্চলে রয়েছে। বাঙলার সংস্কৃতির ইতিহাসে সদগোপদের দানের গুরুত্ব আজও নির্ণয় করা হয়নি।’
অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে গোপীভূমে যে সদ্গোপ রাজা রাজত্ব করছিলেন। তার নাম শতক্ৰতু। ১৭১৮ খ্ৰীস্টাব্দে শতক্ৰতু মারা গেলে তাঁর পুত্ৰ মহেন্দ্র রাজা হন। মহেন্দ্ৰ নিজ পিতৃরাজ্য বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। নবদ্বীপাধিপতি রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের জীবনচরিতে রাজা মহেন্দ্রর কথা বিস্তারিতভাবে লেখা আছে । যখন জগৎশেঠের বাড়িতে নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে সভা আহূত হয়, তখন রাজা মহেন্দ্র একজন প্ৰধান উদ্যোগী ছিলেন। নবাবের বিপক্ষে বিরোধী হওয়ার জন্য তাঁর রাজ্য বর্ধমানের রাজা কর্তৃক আক্রান্ত হয় এবং তিনি শেষ পর্যন্ত পরাজিত হন।
অষ্টাদশ শতাব্দীর বাঙলায় আরও রাজা মহারাজা ছিলেন । তাদের মধ্যে অনেকেই ব্ৰাহ্মণ ছিলেন। যেমন চন্দ্রকোনার রাজারা, নাটোরের রাজবংশ, নদীয়ার রাজবংশ ইত্যাদি ।
অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে নাটোরের জমিদার ছিলেন রাজা রামকান্ত রায় । ১৭২৬ খ্রীস্টাব্দে রামকান্তের মৃত্যুর পর তার ৩২ বৎসর বয়স্কা বিধবা রাণী ভবানী নাটোরের বিশাল জমিদারীর উত্তরাধিকারিণী হন। ওই বিশাল জমিদারী কৃতিত্বের সঙ্গে পরিচালনার স্বাক্ষর তিনি ইতিহাসের পাতায় রেখে গেছেন। তাঁর জমিদারীর বাৎসরিক আয় ছিল দেড় কোটি টাকা। নবাব সরকারে সত্তর লক্ষ টাকা রাজস্ব দিয়ে বাকী টাকা তিনি হিন্দুধর্ম ও ব্রাহ্মণ প্ৰতিপালন, দীনদুঃখীর দুর্দশামোচন ও জনহিতকর কাৰ্যে ব্যয় করতেন। বারাণসীতে তিনি ভবানীশ্বর শিব স্থাপন করেছিলেন ও কাশীর বিখ্যাত দুৰ্গাবাড়ী, দুৰ্গাকুণ্ড ও কুরুক্ষেত্ৰতলা জলাশয় প্রভৃতি তার কীর্তি। বড়নগরে তিনি ১০০টি শিবমন্দির স্থাপন করেছিলেন। যদিও সিরাজউদ্দৌলাকে গদিচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে তিনি ইংরেজ পক্ষকেই সাহায্য করেছিলেন, তা সত্বেও তাঁর জমিদারীর কিয়দংশ ইংরেজরা কেড়ে নিয়েছিল। তার বাহেরবন্দ জমিদারী ওয়ারেন হেষ্টিংস বল পূর্বক কেড়ে নিয়ে কান্তবাবুকে দিয়েছিলেন। পাঁচশালা বন্দোবস্তের সুযোগ নিয়ে গঙ্গাগোবিন্দ সিংহও তাঁর রংপুরের কয়েকটা পরগণা হস্তগত করেছিলেন।