ওপরে শঙ্কর তর্কবাগীশের (১৭২৩-১৮১৬) নাম করেছি। তিনি ছিলেন কর্কশ তর্কশাস্ত্রে প্রতিভার মুখ্য অবতার। ১৭৯১ খ্ৰীস্টাব্দে তীর জীবদ্দশায় লিখিত হয়েছিল–‘Shankar Pandit is the head of the college ofNadia, and allowed to be the first philosopher” and scholar in the “whole university; his name, inspired the youth with the
love of learning, and the greatest rajahs regarded him with great veneration.’ নানাশাস্ত্রে তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল, এবং বাঙালী প্রতিভার মূর্ত প্ৰতীকরূপে ভারতের সর্বত্র তিনি অসাধারণ প্ৰতিপত্তি লাভ করেন।’ যারা মহারাজা নবকৃষ্ণ দেব অনুষ্ঠিত ‘বিচার’-এ অংশ গ্ৰহণ করেছিলেন তাদের মধ্যেও শঙ্কর তর্কবাগীশ ছিলেন। শঙ্কর তর্কবাগীশ ও জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন ছাড়া, আরও যে সব পণ্ডিত ওই ‘বিচার’-এ অংশ গ্ৰহণ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন বলরাম তর্কভূষণ, মানিকচন্দ্র তর্কভূষণ ও বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার।
বাঙলার পণ্ডিত সমাজের মধ্যে আর যারা ফোট উইলিয়াম কলেজের অধ্যাপকের পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, রামনাথ বিদ্যাবাচস্পতি, শ্ৰীপতি মুখোপাধ্যায়, আনন্দচন্দ্র, রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়, কাশীনাথ মুখোপাধ্যায়, চণ্ডীচরণ মুনশী, তারিণীচরণ মিত্র, পদ্মলোচন চূড়ামণি, রামরাম বসু প্ৰমুখ।
অন্যান্য সূত্র থেকে আমরা অষ্টাদশ শতাব্দীর আরও অনেক পণ্ডিত ও শিক্ষিত ব্যক্তির নাম পাই। পণ্ডিতজনের মধ্যে বিশেষ উল্লেখের দাবী রাখেন। কৃষ্ণানন্দ সার্বভৌম, গোকুলানন্দ বিদ্যামণি, গোপাল ন্যায়ালঙ্কার, চন্দ্রনারায়ণ ন্যায়পঞ্চানন, জগন্নাথ পঞ্চানন, কালিকিঙ্কর তর্কবাগীশ, অনন্তরাম বিদ্যাবাগীশ, কালীশঙ্কর সিদ্ধাস্তবাগীশ, জয়গোপাল তর্কালঙ্কার, জয়রাম ন্যায়পঞ্চানন, দয়ারাম ন্যায়ালঙ্কার, দুলালচাদ তর্কবাগীশ, বলদেব বিদ্যাভূষণ, বিশ্বনাথ ন্যায়ালঙ্কার, মথুরেশ (মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভাসদ), মানিকচন্দ্র তর্কভূষণ, রূপমঞ্জরী, শ্ৰীকৃষ্ণ তর্কালঙ্কার, শ্ৰীকৃষ্ণ সার্বভৌম, হাটী বিদ্যালঙ্কার ও হরিহরানন্দ তীৰ্থস্বামী। এ সকল পণ্ডিতদের শাস্ত্রাঙ্কুশীলন ও সাহিত্যচর্চার কথা আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে বলব। সেখানে আরও বলব। অষ্টাদশ শতাব্দীর সাহিত্যসাধক ও অন্যান্য গুণিজনের কথা। তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে যাঁদের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে, তাঁরা হচ্ছেন গঙ্গারাম দাস (দেব চৌধুরী), গোপাল ভঁড়, গোলাকনাথ দাস, জগন্দ্রাম রায়, আনন্দরাম চক্রবর্তী, ঈশা আল্লাহ খান, কবিচন্দ্র, জয়নারায়ণ রায়, জীবন ঘোষাল, দামোদর মিশ্র, দ্বিজরাম, নিত্যানন্দ মিশ্র, নিধিরাম কবিচন্দ্ৰ, পুরুষোত্তম মিশ্ৰ, বনদূর্লভ, বিশ্বনাথ চক্রবর্তী, রমানাথ রায়, রামসিংহ ও রামগতি সেন।
চার
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষপাদে অনেকে ইংরেজি ভাষাও শিখতে আরম্ভ করেছিল। ইংরেজদের সঙ্গে কাজকর্মের সুবিধার জন্য এদেশের একশ্রেণীর লোকের মধ্যে ইংরেজি শেখার প্রবল আকাঙ্খা জেগেছিল। বস্তুতঃ ১৭৭৪ খ্ৰীস্টাব্দে সুপ্রিম কোর্ট স্থাপনের পর থেকেই বাঙালী ইংরেজি শিখতে শুরু করেছিল। এ সময় আমরা সুপ্রিম কোটের আইনজীবীদের মধ্যে রামনারায়ণ মিশ্র ও আনন্দরামের নাম শুনি। সুপ্রিম কোটের কেরানীদের তো ইংরেজি শিখতেই হত। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে শেরিফের আফিসের হেড ক্লার্ক রামমোহন মজুমদারের নাম হিকির ‘স্মৃতিকথা’য় লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। এ ছাড়া, এটনীদের ক্লার্কদেরও ইংরেজি জানতে হত। এ রকম কেরানীদের মধ্যে আমরা হিকির ‘হেড কেরানী রামধন ঘোষের নাম শুনি। সে যুগে যারা সাহেবদের দেওয়ানী বা বেনিয়ানি করত, তাদেরও ইংরেজি জানতে হত। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির গোলন্দাজ বাহিনীর ক্যাপটেন নাথানিয়াল কিণ্ডারসলের স্ত্রী শ্ৰীমতী কিণ্ডারসলে ১৭৬৫ থেকে ১৭৬৯ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত কলকাতায় বাসু করেছিলেন। তিনি তাঁর ভ্ৰমণ কাহিনীতে লিখে গেছেন যে এদেশের বেনিয়ানরা মোটামুটি ভাল ইংরেজি বলে। (‘usually speak pretty tolerable English’)। হেষ্টিংস-এর বেনিয়ান কান্তবাবুও ইংরেজি জানতেন।
এরা সকলে প্ৰথম প্ৰথম কিভাবে ইংরেজি শিখতেন, তা আমাদের জানা নেই। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে তিনখানা শব্দকোষ প্ৰকাশিত হওয়ায় ইংরেজি শেখার খানিকটা সুবিধা হয়েছিল। এই তিনখানা শব্দকোষ হচ্ছে ১৭৯৩ খ্রীস্টাব্দে প্ৰকাশিত অ্যারন আপজন কৃত ‘ইঙ্গরাজি ও বাঙ্গালি বোকেবিলারি’, ১৭৯৭ খ্রীস্টাব্দে প্ৰকাশিত জন মিলারের ‘শিক্ষাগুরু’ ও ১৭৯৯ খ্ৰীস্টাব্দে প্রকাশিত হেনরী পিটস ফরস্টারের ‘ভোকাবুলারী’। এই তিনখান বইয়ের মধ্যে ফরস্টারের বইটাই বাঙালী সমাজের বিশেষ কাজে লেগেছিল। এ থেকে শব্দচয়ন করে বাঙালী কাজ চালাবার মত ইংরেজি শিখেছিল। সে যুগের বাঙালীরা অবশ্য গ্রামার বা ইডিয়মের ধার ধারত না। তবে সাহেবরা সে রকম ইংরেজি বুঝত।
শিক্ষাক্ষেত্রে অষ্টাদশ শতাব্দীর খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে জেনারেল ক্লড মাটিন (১৭৩৫-১৮০০) নামে কোম্পানির এক কর্মচারী কর্তৃক বিনামূল্যে ‘বিদ্যার্থীদের পাঠার্থে।’ এক বিদ্যায়তন স্থাপনের জন্য তেত্ৰিশ লক্ষ টাকা উইল করে রেখে যাওয়া। সেই টাকার কিছু অংশে পরবর্তী শতাব্দীতে স্থাপিত হয়েছিল কলকাতায় ‘লা মার্টিনিয়ার’ বিদ্যায়তন (১৮৩৩-৩৫)।