তিন
অষ্টাদশ শতাব্দীতে শিক্ষার সার্বজনীন মাধ্যম ছিল পাঠশালা। প্ৰতি গ্রামেই *ार्छाला छेिल। পাঠশালাসমূহ পরিচালন করতেন গুরুমশাইরা। গুরুমশাইদের ছাত্ররা মশাই’ বলে সম্বোধন করত। গুরুমশাই খুব বদ্যান্যতার সঙ্গে বেতের ব্যবহার করতেন। পাঠশালাসমূহে ভর্তি হতে বা পড়তে কোন পয়সাই লাগত না। মাত্র মাঝে মাঝে গুরুমশাইকে একটা ‘সিধে’ দিতে হত। পাঠশালাসমূহে শিক্ষা দেওয়া হত। অক্ষর পরিচয়, ফল বানান, যুক্তাক্ষর ও লিখনপ্রণালী। দলিল লেখালেখি কোথাও শেখানো হত। এছাড়া অঙ্ক বিভাগে থাকত শঠকে, কড়াকে, গণ্ডাকে, বুড়িকে, সেরকে, মনকে, নামতা, সইয়ে, আড়াইয়ে, তেরিজ, জমা খরচ, -গুণ, ভাগ, বাজার দরকষা, সুদকষা, কাঠাকালি, বিঘাকালি, পুষ্করিণীকালি, ইটের পাঁজাকালি ইত্যাদি দৈনন্দিন জীবনের অনেক ব্যবহারিক বিষয়। এক কথায়, পাঠশালায় শিক্ষা করলে, একজন রীতিমত শিক্ষিত ও কৃতবিদ্য বলে সেকালে গণ্য হত। নিজ পরিবার মধ্যেও বিশেষ মৰ্যাদা লাভ করত।
পাঠশালায় যে মাত্র ছেলেরাই লেখাপড়া শিখত তা নয়, মেয়েরাও। সন্ত্রান্ত ঘরের মেয়েদের বাড়িতেই লেখাপড়া শেখানোর ব্যবস্থা করা হত। তাদের লেখাপড়ার জন্য পণ্ডিত নিযুক্ত করা হত। এভাবেই লেখাপড়া শিখেছিলেন বর্ধমানের মহারাণী কৃষ্ণকুমারী, নাটোরের রাণী ভবানী (১৭১৪-১৭৯৩) প্রমুখরা। বর্ধমান রাজবাড়ির আর যারা লেখাপড়া শিখেছিলেন তঁরা হচ্ছেন মহারাজা তেজশ্চন্দ্ৰের পট্টমহিষী মহারাণী কমলকুমারী ও মহারাজা প্ৰতাপচন্দ্ৰ বাহাদুরের দুই রাণী। এঁরা সকলেই সুশিক্ষিতা ছিলেন। নবদ্বীপাধিপতি মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় (১৭১০-১৭৮২) বাহাদুরের পরিবারের মেয়েরাও বিদ্যাভ্যাস করতেন। রাজা সুখময় রায় বাহাদুরের (?-১৮১১) পুত্র শিবচন্দ্র রায়ের মেয়ে .श्द्रश्नादौe मर्छुङ, तारा ७ श्कोि এই তিন ভাষায় এমন সুশিক্ষিতা হয়েছিলেন যে পণ্ডিতেরাও তেঁাকে ভয় করতেন। তিনি সেকালের একজন নামজাদা পণ্ডিত কুমারহট্ট নিবাসী রূপচাদ ন্যায়ালঙ্কারের কাছ থেকে সংস্কৃত রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণাদি তাবৎ গ্রন্থ পাঠ করে সেকালের একজন সুশিক্ষিতা মহিলা হয়েছিলেন। সাধারণ গ্রামের মেয়েরাও পাঁচালী ও কথকতার মাধ্যমে মঙ্গলকাব্যসমূহ, রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণাদির কাহিনীসমূহের সহিত রীতিমত পরিচিত হতেন। বলা বাহুল্য পাঁচালী গানই ছিল গণশিক্ষার প্রধান মাধ্যম।
চার
যারা চতুষ্পাঠীসমূহ পরিচালনা করতেন, তারা সকলেই বিখ্যাত পণ্ডিত, ছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর বিখ্যাত পণ্ডিতদের নাম আমরা চারটা সূত্র থেকে *পাই। এ চারটা সুত্র হচ্ছে-(১) মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের (১৭১০-১৭৮২) -অধিক্টোম ও বাজপেয় যজ্ঞে যে সকল পণ্ডিত উপস্থিত ছিলেন, (২) যে এগারজন পণ্ডিত দ্বারা ওয়ারেন হেষ্টিংস ‘বিবাদার্ণবসেতু’, নামক ব্যবস্থাপুস্তক রচনা করিয়ে ছিলেন, (৩) মহারাজা নবকৃষ্ণ দেব এক সপ্তাহব্যাপী যে ‘বিচার’-এর আয়োজন করেছিলেন, তাতে যে সকল পণ্ডিত উপস্থিত ছিলেন, ও (৪) ১৮০০ খ্ৰীস্টাব্দে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় যে সকল পণ্ডিত ওই কলেজে অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত হয়েছিলেন।
১১৬০ বঙ্গাব্দের (১৭৫০ খ্রীস্টাব্দ) মাঘ মাসে নবদ্বীপাধিপতি রাজা কৃষ্ণচন্দ্ৰ রায় অগ্নিষ্টেম ও বাজপেয় যজ্ঞ করেন। ওই যজ্ঞে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের বহুসংখ্যক ব্ৰাহ্মণ পণ্ডিত সমাগত হন। বাঙলার যে সকল পণ্ডিত আহুত হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন। হরিরাম তর্কসিদ্ধান্ত, রামগোপাল সার্বভৌম, রাধামোহন গোস্বামী (১৭৩০-৩২), জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন (১৬৯৪-১৮০৭), রমাবল্লভ বিদ্যাবাগীশ, বীরেশ্বর ন্যায়পঞ্চানন, বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার, রমানন্দ বাচস্পতি, মধুসুদন ন্যায়ালঙ্কার, গোপাল ন্যায়ালঙ্কার, শিবরাম বাচস্পতি, কৃষ্ণানন্দ বাচস্পতি প্ৰমুখ। এঁদের মধ্যে বাণেশ্বর ছিলেন রুষ্ণচন্দ্রের (১৭১০ – ১৭৮৯) সভাপণ্ডিত। গুপ্তিপাড়ায় তার জন্ম। তাঁর পিতা ছিলেন রামদেব তর্কবাগীশ। কৃষ্ণচন্দ্ৰ কোন কারণে বাণেশ্বরের ওপর রুষ্ট হলে, তিনি বর্ধমান রাজ চিত্ৰসেনের আশ্রয়ে যান। সেখানে তিনি চিত্ৰসেনের আদেশে বৰ্গীর হাঙ্গামা সম্বন্ধে গদ্যে-পদ্যে ‘চিত্রচম্পূৰ্ণ সংজ্ঞ্যক এক গ্ৰন্থ রচনা করেন। (আগে দেখুন)। চিত্রসেনের মৃত্যুর পর তিনি পুনরায় কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভায় যান। পরে কলকাতায় মহারাজা নবকৃষ্ণ দেবের (১৭৩৩-১৭৯৭) আশ্রয়ে যান। ওয়ারেন হেষ্টিংস (১৭০২-১৮১৮) যে এগার জন পণ্ডিতের সাহায্যে ‘বিবাদার্ণব সেতু’ নামে হিন্দু আইনের এক গ্ৰন্থ রচনা করিয়েছিলেন, বাণেশ্বর তাদের অন্যতম ছিলেন। বর্ধমান রাজসভায় থাকাকালীন তিনি ‘চন্দ্রাভিষেক’ নামে একখানি নাটকও রচনা করেছিলেন।
তবে অষ্টাদশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত ছিলেন জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন। ১৬৯৬ খ্রীষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করে ১১১ বৎসর জীবিত থেকে, তিনি মারা যান। ১৮০৭ খ্ৰীস্টাব্দে। চব্বিশ বৎসর বয়সে পিতার মৃত্যুর পর তিনি অধ্যাপনা শুরু করেন। অসাধারণ নৈয়ায়িক হিসাবে জগন্নাথের খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। দীর্ঘ ৮৭ বৎসর তিনি তার এই খ্যাতি অমান রাখেন। জগন্নাথ মহারাজা নবকৃষ্ণ দেবের রাজসভাও অলঙ্কত করতেন। মহারাজ তাকে একখানা তালুক ও পাকা। বসতবাড়ী দিয়েছিলেন। মহারাজ একবার তাকে বাৎসরিক এক লক্ষ টাকা আয়ের একটা জমিদারী দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু জগন্নাথ তা প্ৰত্যাখান করে বলেন যে তা হলে তার বংশধরেরা বিলাসী হয়ে পড়বে ও ধনগর্বে বিদ্যচর্চা বন্ধ করে দেবে। ইংরেজরাও জগন্নাথকে জজ-পণ্ডিত নিযুক্ত করতে চেয়েছিল, কিন্তু তাও তিনি প্ৰত্যাখান করেছিলেন তার পৌত্র গঙ্গাধরের আনুকুল্যে। স্বপ্রীম কোর্টের বিচারপতি স্যার উইলিয়াম জোনস্-এর আদেশে জগন্নাথ বিবাদ ভঙ্গার্ণব’ নামে একখানা ব্যবস্থাপুস্তক রচনা করেছিলেন (১৭৮৮-৯২)। কোলব্রুক সাহেব সেখানা তর্জমা করে নাম দেন ‘A Digest of Hindu Law on Contracts and Succession’. এ বইখানার ইতিহাস এখানে বলা দরকার। হিন্দুদের প্রাচীন শাস্ত্ৰসমূহ থেকে কাৰ্যোপযোগী একখানা ব্যবস্থাপুস্তক সংকলন করবার প্রথম আয়োজন করেন ওয়ারেন হেষ্টিংস। এ কাজের ভার তিনি এগার জন পণ্ডিতের ওপর দেন। (যথাক্রমে তারা হচ্ছেন রামগোপাল ন্যায়ালঙ্কার, বীরেশ্বর পঞ্চানন, কৃষ্ণজীবন ন্যায়ালঙ্কার, বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার, কৃপারাম তর্কসিদ্ধান্ত, কৃষ্ণচন্দ্র সার্বভৌম, গৌরীকান্ত তর্কসিদ্ধান্ত, কৃষ্ণকেশব তর্কালঙ্কার, সীতারাম ভট্ট, কালীশঙ্কর বিদ্যাবাগীশ ও শ্যামসুন্দর ন্যায়সিদ্ধান্ত) এঁরা যে ব্যবস্থাপুস্তক রচনা করেছিলেন, তা প্ৰথম ফারসীতে এবং তা থেকে ন্যাথানিয়াল ব্রাশী হালহেড ইংরেজিতে অনুবাদ করেন (১৭৭৫-৭৬)। কিন্তু দুবার ভাষান্তরিত হবার ফলে গ্ৰন্থখানি (‘Gentoo Code) মূল সংস্কৃত থেকে পৃথক হয়ে পড়েছিল। সেজন্য একখানি বিশুদ্ধ ও প্রামাণিক ব্যবস্থাপুস্তক রচনা করবার জন্য সচেষ্ট হন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি স্যার উইলিয়াম জোনস। প্ৰথমে তিনি এর ভার দেন মিথিলার স্মর্ত পণ্ডিত সৰ্বরী। ত্ৰিবেদীর ওপর। সৰ্বরী ত্ৰিবেদী যে বইখানা তৈরী করেছিলেন ৩ার নাম ছিল ‘বিবাদ সারার্ণব’। কিন্তু সেখানা মনঃপূত না হওয়ায় জোনস এর ভার দেন জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের ওপর। জগন্নাথের বইখানা ছিল ৮০০ পৃষ্ঠার বই এবং এখানার নাম ছিল ‘বিবাদভঙ্গার্ণব’। জোনস্-এর হঠাৎ মৃত্যু ঘটায় কোলব্রুক সাহেব সেখানে ইংরেজিতে তর্জমা করান।