উচ্চশিক্ষার শ্রেষ্ঠ মাধ্যম ছিল মুসলমানদের ক্ষেত্রে মৌলবীগণ পরিচালিত। মাদ্রাসা ও হিন্দুদের ক্ষেত্রে ব্ৰাহ্মণ পণ্ডিতগণ পরিচালিত চতুষ্পাঠীসমূহ। পাঠশালার সঙ্গে চতুষ্পাঠীর প্রধান পার্থক্য ছিল এই যে, পাঠশালা যে কোন জাতির লোক প্ৰতিষ্ঠা ও পরিচালনা করতে পারতেন, কিন্তু চতুস্পাঠিসমূহ সাধারণতঃ ব্ৰাহ্মণপণ্ডিতগণই পরিচালনা করতেন। চতুষ্পাঠীসমূহে নানা শাস্ত্রের শিক্ষা দেওয়া হত। চতুষ্পাঠীসমূহের শ্ৰেষ্ঠ কেন্দ্র ছিল নবদ্বীপ। শাস্ত্র অনুশীলন, অধ্যয়ন ও অধ্যাপনার জন্য নবদ্বীপের বিশেষ প্ৰসিদ্ধি ছিল। এই প্ৰসিদ্ধিৱঃ জন্যই নবদ্বীপকে বাঙলার ‘অকসফোর্ড’ বলে অভিহিত করা হত। নব্যন্যায় ও’ স্মৃতির অনুশীলনের জন্য নবদ্বীপ বিশেষভাবে খ্যাত ছিল। তবে নবদ্বীপই একমাত্র শিক্ষাকেন্দ্ৰ ছিল না। ব্ৰাহ্মণপণ্ডিতদের শান্ত্রি অধ্যয়ন ও অধ্যাপনার পীঠস্থান হিসাবে পূর্ববঙ্গে কোটালিপাড়ার বিশেষ প্ৰসিদ্ধি ছিল। পশ্চিমবঙ্গে শাস্ত্ৰ অধ্যয়ন ও অধ্যাপনার জন্য ত্ৰিবেণী, কুমারহট্ট (কামারহাটি), ভট্টাপঞ্জী (ভাটপাড়া), গোন্দলীপাড়া (চন্দ্রনগর), ভদ্ৰেশ্বর, জয়নগর-মজিলপুর, আব্দুল, বালী, বর্ধমান প্ৰভৃতিরও প্ৰসিদ্ধি ছিল। দ্রাবিড়, উৎকল, মিথিলা ও বারাণসী থেকে দলে দলে ছাত্র বর্ধমানের চতুষ্পাঠীতে অধ্যয়ন করতে আসত। এই সকল চতুষ্পাঠীতে যে মাত্র মব্যস্তায় বা স্মৃতিশাস্ত্রেরই অনুশীলন হত, তা নয়। জ্যোতিষ, আয়ুৰ্বেদ, ন্যায়, কোষ, নাটক, গণিত, ব্যাকরণ, ছন্দোসূত্র প্রভৃতি ও দণ্ডী, ভারবী, মাঘ, কালিদাস, প্ৰমুখদের কাব্যসমূহ এবং মহাভারত, কামন্দকীদীপিকা, হিতোপদেশ প্রভৃতি পড়ানো হত।
দুই
চতুষ্পাঠীতে যে মাত্র পুরুষেরাই পড়ত, তা নয়। মেয়েরাও কেউ কেউ চতুস্পাঠীতে পড়ে বিদুষী হত! তাদের মধ্যে অনেকেই সংস্কৃত শিক্ষার উচ্চ সোপানে উঠেছিল। যেমন পশ্চিমবঙ্গের হটি বিদ্যালঙ্কার ও হাঁটু বিদ্যালঙ্কার, এবং পূর্ববঙ্গের বিক্রমপুরের আনন্দময়ী দেবী ও কোটালিপড়ার বৈজয়ন্তী দেবী। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে স্থপ্রসিদ্ধা ছিলেন হাট বিদ্যালঙ্কার। তিনি ছিলেন রাঢ়দেশের এক কুলীন ব্ৰাহ্মণ পরিবারের বালবিধবা। সংস্কৃত ব্যাকরণ, কাব্য, স্মৃতি ও নব্যান্যায়ে তিনি বিশেষ পারদর্শিতা লাভ করে বারাণসীতে এক চতুষ্পাঠী স্থাপন করেছিলেন। বেশ বৃদ্ধ বয়সে ১৮১০ খ্ৰীস্টাব্দে তিনি মারা যান। হটু বিদ্যালঙ্কারের আসল নাম রূপমঞ্জরী। তিনিও রাঢ়দেশের মেয়ে ছিলেন, তবে তিনি জাতিতে ব্ৰাহ্মণ ছিলেন না। তাঁর পিতা নারায়ণ দাস অল্প বয়সেই মেয়ের অসাধারণ মেধা দেখে, তার ১৬/১৭ বছর বয়সকালে তাঁকে এক ব্ৰাহ্মণ পণ্ডিতের চতুষ্পাঠীতে পাঠিয়ে দেন। সেখানে অধ্যয়ন করে রূপমঞ্জরী ব্যাকরণ, সাহিত্য আয়ুৰ্বেদ ও অন্যান্য শাস্ত্ৰে বিশেষ পারদর্শিতা লাভ করেন। নানা জায়গা থেকে ছাত্ররা তার কাছে ব্যাকরণ, চড়কসংহিতা, নিদান ও আয়ুর্বেদের নানা বিভাগের বিষয়বস্তু সম্বন্ধে শিক্ষালাভ করতে আসত। অনেক বড় বড় কবিরাজ তার কাছে চিকিৎসা সম্বন্ধে পরামর্শ নিতে আসতেন। রূপমঞ্জরী শেষপৰ্যন্ত অবিবাহিতাই ছিলেন এবং মস্তকমুণ্ডন করে মাথায় শিখা রেখে পুরুষের বেশ ধারণ করতেন। ১০০ বৎসর বয়সে ১৮৭৫ খ্রীস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু ঘটে।
আনন্দময়ী ও বৈজয়ন্তী দেবী দুজনেই ছিলেন পূর্ববঙ্গের মেয়ে। আনন্দময়ী জাতিতে ব্ৰাহ্মণ ছিলেন না। তাঁর পিতার নাম লাল রামগতি সেন। ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের অন্তর্গত জিপসা গ্রামে তার জন্ম। ছেলেবেলা থেকেই আনন্দময়ীর বিদ্যাশিক্ষার প্রতি তীব্ৰ অনুরাগ ও মেধা ছিল। সংস্কৃত সাহিত্যে -बू९,नडि नाड करब डिनि বিশেষ প্ৰসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। মহারাজা রাজবল্লভ যখন রামগতি সেনের নিকটা অগ্নিষ্টোম যজ্ঞের প্রমাণ ও প্রতিকৃতি চেয়ে পাঠান, তখন পিতা অন্য কাজে ব্যস্ত থাকায়, আনন্দময়ী নিজেই সেই দায়িত্ব গ্রহণ করে অগ্নিষ্টেম যজ্ঞের প্রমাণ ও প্রতিকৃতি নিজেই তৈরী করে তাঁর কাছে পাঠিয়ে দেন। গান রচনাতেও তিনি সিদ্ধহস্তা ছিলেন। তার রচিত গানসমূহ বিবাহ, অন্নপ্রাশন ইত্যাদি মাঙ্গলিক উৎসবে বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। তা ছাড়া, তিনি নিজ খুল্লতাত জয়নারায়ণকে ‘হরিলীলা’ (১৭৭২ খ্রীস্টাব্দে রচিত) কাব্য রচনায় সাহায্য করেছিলেন। তিনি বিবাহিতা ছিলেন। পয়গ্রাম নিবাসী পণ্ডিত অযোধ্যানারায়ণের সঙ্গে তার বিবাহ হয়েছিল। পিতৃগৃহে স্বামীর মৃত্যুর সংবাদ শুনে তিনি অনুমৃত হন। তাঁর মা-ও কাশীর মণিকর্ণিকার ঘাটে সহমৃতা হয়েছিলেন। সুতরাং এ থেকে বুঝতে পারা যাচ্ছে যে অষ্টাদশ শতাব্দীর বাঙালী সমাজে অনুমৃতা ও সহমৃতা হওয়া ব্যাপকভাবে প্ৰচলিত ছিল।
বৈজয়ন্তীদেবী ব্ৰাহ্মণকন্যা ছিলেন। ফরিদপুরের খানুকা গ্রামে তাঁর জন্ম। স্বামী ছিলেন কোটালিপাড়া নিবাসী প্ৰখ্যাত পণ্ডিত কৃষ্ণনাথ সার্বভৌম। কাব্য, সাহিত্য, দর্শন, ধর্মশাস্ত্ৰ প্ৰভৃতিতে পাণ্ডিত্যের জন্য বৈজয়ন্তী বিশেষ প্ৰসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। তিনি সুন্দরী ছিলেন না এবং শ্বশুরকুল অপেক্ষা হীন ছিলেন বলে বহুদিন যাবৎ স্বামীগৃহে যেতে পারেন নি। পরে সংস্কৃত লোকে রচিত পত্রে তার কবিত্বশক্তির পরিচয় পেয়ে স্বামী তাকে নিজগৃহে নিয়ে যান। সেখানে তিনি স্বামীর সঙ্গে মিলিতভাবে ‘আনন্দালতিকা’ নামে এক কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। এখানি সংস্কৃত ভাষায় একখানি উচ্চমানের কাব্যগ্রন্থ বলে প্রসিদ্ধ।