বাঙালী ঘরের গৃহিণী হিসাবে গৌরীকে দিনরাত পরিশ্রম করতে হয়। মা মেনকা গৌরীকে বিশ্রাম দেবার জন্য বাপের বাড়ী নিয়ে যেতে চান। কিন্তু শিবের মর্যাদাজ্ঞান খুব বেশী। মাত্র তিন দিনের কড়ারে শিব গৌরীকে বাপের বাড়ী পাঠান।
গৌরীর বিবাহপূর্ব জীবনও রামেশ্বরের কাব্যে খুব মধুর। আর পাঁচটা বাঙালী মেয়ের মত গৌরী পুতুল খেলা করে। পুতুলের বিয়ে দেয়। নিজের সখীদের পুতুলের বিয়েতে বিকল্প ভোজন করায়। অন্য বাঙালীর মেয়ের মত গৌরীর বিয়েতেও ঘটকের প্রয়োজন হয়। ভাগনে নারদই মামার বিয়েতে ঘটকালী করে। বিয়েতে পালনীয় সব কর্মই অকুষ্ঠিত হয়। এয়োরা আসে, কন্যা সম্প্রদান হয়, যৌতুকও বাদ যায়না। রামেশ্বর এয়োদের যে নামের তালিকা দিয়েছেন, তা থেকে আমরা তৎকালীন মেয়েদের নামের নমুনা পাই। তবে অন্যান্য মঙ্গলকাব্যে যেমন কবিরা পতিনিন্দার অবতারণা করেছেন, রামেশ্বর অ করেন নি। তার পরিবর্তে তিনি শ্বাশুড়ীদের মুখ দিয়ে জামাতাদের নিন্দ প্রকাশ করেছেন। রামেশ্বরের কাব্যের এই অংশ অত্যন্ত কৌতুকাবহ।
দুই
রামেশ্বর বাঙলার পরিবারিক জীবনের যে সুখময় চিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন, তা হচ্ছে অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের। কিন্তু মুঘল সাম্রাজ্যের অবনতির অন্তরালে, বাঙলায় যে রাষ্ট্রীয় বিশৃঙ্খলতা প্রকাশ পেয়েছিল, তার প্রতিঘাতে বাঙলার সমাজ ও পরিবারিক জীবন বিধ্বস্ত হয়েছিল। সে চিত্র আমরা পাই শতাব্দীর মধ্যাহ্নে রচিত ভারতচন্দ্রের ‘বিদ্যাসুন্দর’-এ। একটা কামলালসাচ্ছন্ন সমাজের স্বষ্টি হয়েছিল, যে সমাজে নারী ও পুরুষ উভয়েই নৈতিকশৈথিল্যের নিম্নস্তরে গিয়ে পৌঁছেছিল। সে সমাজের নারী বলছে–‘বৎসর পনের ষোল বয়স আমার। ক্ৰমে ক্ৰমে বদলিনু এগার ভাতার।’ আবার কবির উক্তি—‘পরকীয় রস যত, ঘরে ঘরে শুনি কত, অভাগীর ধর্ম ভয় এত করে মরি লো। পরপুরুষের মুখ হেরিলে যে হয় সুখ। এ কি জ্বালা সদা জ্বলি হরি হরি লো।’ সাধারণ লোকের ঘরেই যে এরূপ ঘটত তা নয়। রাজা রাজড়ার ঘরেও ঘটত। অনূঢ়া অবস্থাতেই অনেকে অন্তস্বত্বা হত। নায়িকা বিদ্যাই তার দৃষ্টান্ত।
অন্যান্য মঙ্গলকাবের ন্যায় মেয়েদের প্রতিনিন্দ, এয়োদের নামের তালিকা, রন্ধনে নানা পদের ব্যঞ্জনের ফর্দ (পাপড় ও লুচি সমেত), জন্মের পর ষষ্ঠীপূজা, ছয় মাসে অন্নপ্রাশন, বিবাহে নানারূপ মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান প্ৰভৃতির উল্লেখও আমরা ‘বিদ্যাসুন্দর’-এ পাই।
ভারতচন্দ্র বর্ধমান শহরের এক সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন। ‘দেখি পুরী। বর্ধমান, সুন্দর চৌদিকে চান, ধন্য গৌড় যে দেশে এ দেশ। রাজা বড় ভাগ্যধর, কাছে নদ দামোদর, ভাল বটে জানিন্ত বিশেষ। চৌদিকে সহরপন, দ্বারে চৌকী কত জনা, মুরুচা বুরুজ শিলাময়। কামানের হুড়হুড়ি, বন্দুকের দুরদুরি, সলখে বানের গড় হয়। বাজে শিঙ্গা কাড়া ঢোল, নৌবত ঝাঝের রোল, শঙ্খ ঘণ্টা বাজে ঘড়ি ঘড়ি ॥’ বৰ্গীর হাঙ্গামা সম্বন্ধেও তার উক্তি আগে দ্রষ্টব্য। গ্ৰাম্যব্যবসায়ীদের ওপর ইংরেজ বণিকদের লুণ্ঠন ও পীড়নের কথাও তিনি বলেছেন‘উদাসীন ব্যাপারী বিদেশী যারে পায়। লুটেপুটে বেড়ি দিয়া ফাটকে ফেলায়।’ আবার কুলীন বনিতাদের বিবাদময় জীবনের চিত্রও দিয়েছেন- আর রামা বলে আমি কুলীনের মেয়ে। যৌবন বহিয়া গেল বর চেয়ে চেয়ে৷ যদি বা হইল বিয়া কতদিন বই। বয়স বুঝিলে তার বড় দিদি হই। বিয়াকালে পণ্ডিতে পণ্ডিতে বাদ লাগে। পুনর্বিয়া হবে কিনা বিয়া হবে। আগে। বিবাহ করেছে সেটা কিছু ঘাটবাট। জাতির। যেমন হৌক কুলে বড় আঁটি। দুচারি বৎসরে যদি আসে একবার। শয়ন করিয়া বলে কি দিবি ব্যাভার। সুতা বেচা কড়ি যদি দিতে পারি তায়। তবে মিষ্টি মুখ নহে। রুষ্ট হয়ে যায় ॥’
তিন
পারিবারিক জীবনে সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব, ও সমাজজীবনে রাজকর্মচারীদের অত্যাচার ও নির্যাতন ও ইংরেজের লুণ্ঠন ও শোষণ প্রভৃতির প্ৰতিক্রিয়ায় অষ্টাদশ শতাব্দীর মানুষের মন ক্রমশ বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল। এর প্ৰকোপে শতাব্দীর শেষভাগে নানা বিদ্রোহ ঘটেছিল। লৌকিক ছড়ার মাধ্যমে জনগণ এই সব বিদ্রোহ সম্বন্ধে নিজেদের মনোভাব প্ৰকাশ করেছিল। দেবী সিংহ-এর অত্যাচার সম্বন্ধে এক ছড়ায় বলা হয়েছে-“কত যে খাজনা পাইবে তার লেখা নাই। যত পারে তত নেয়, আরো বলে চাই। দেও দেও যাই যাই একমাত্র বোেল। মাইরের চোটেতে উঠে ক্ৰন্দনের রোল।’ মানীর সম্মান নাই, মানী জমিদার। ছোট বড় নাই সবে করে হাহাকার। সোয়ারিত চড়িয়া যায় পাইকে মারে জুতা। দেবী সিংহের কাছে আজ সবে হলো ভেঁাতা।’ ‘পারে না ঘাটায় চলতে কিউরী বউরী। দেবী সিংহ-এর লোক তাকে নেয় জোর, করি। পূর্ণ কলি অবতার দেবী সিংহ রাজা। দেবী সিংহ-এর উপদ্রবে। প্ৰজা ভাজা ভাজা।’ মজনুর বিদ্রোহ ইংরেজ শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে হলেও, ছড়ায় মজনুর ফকির সম্প্রদায় কর্তৃক নারী ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়েছে–’ভাল ভাল মানুষের কুলবধু জঙ্গলে পলায়। লুটুরা ফকির যত পাছে পাছে ধায়। যদি আসে লাগপাস জঙ্গলের ভিতর। বাজে আসি ধরে যেন লোটন কৈতর। বসন কাড়িয়া লয় চাহে আলিঙ্গন। যুবতি কাকুতি করে নাহি শুনে করয়ে শিঙ্গার।’ আবার সন্ন্যাসী বিদ্রোহ সম্বন্ধে ছড়ায় বলা হয়েছে‘পৌষ মাসের সোমবার অমাবস্যার ভোগ। মূল নক্ষত্ৰতে পাইল নারায়ণী যোগ। মঙ্গলবারের দিন আইল ছয়শত সন্ন্যাসী। তারা কাশীবাসী মহাঋষি উর্ববাহুর ঘটা। সন্ন্যাসী আইল বলা লোকের পড়ে গেল শঙ্কা। হাজারে হাজারে বেটারা লুট করিতে আসে।’ যদিও বঙ্কিমের ‘আনন্দমঠ’-এ আমরা এর অন্য চিত্ৰ পাই।
শিক্ষা ও পণ্ডিতসমাজ
সার্বজনীন স্তরে অষ্টাদশ শতাব্দীর সমাজে শিক্ষাবিস্তারের মাধ্যম ছিল। হিন্দুদের পাঠশালা ও মুসলমানদের মকতাব। এ ছাড়া ছিল। কথকতা গান, যাত্রাভিনয় ও পাঁচালী গান যার মাধ্যমে হিন্দুরা পৌরাণিক কাহিনীসমূহের সঙ্গে পরিচিত হত। পাঠশালায় ছেলেমেয়ে উভয়েই পড়ত। কোনও কোনও ক্ষেত্রে মেয়েরা লেখাপড়া করে বিদুষী হতেন, তা আমরা অষ্টাদশ শতাব্দীর রচনা থেকে জানতে পারি। ভারতচন্দ্রের ‘বিদ্যাসুন্দর’-এর নায়িকা বিদ্যা তো বিদ্যারই মূর্তিময়ী প্ৰতীক ছিল। রাণী ভবানীও বেশ সুশিক্ষিতা মহিলা ছিলেন। বর্ধমানের রাজপরিবারের মেয়েরাও সুশিক্ষিতা ছিলেন। তবে মেয়েদের মধ্যে দু-চারজন উচ্চশিক্ষিতা হলেও সাধারণ মেয়ের অল্পশিক্ষিতাই হত। এর প্রধান কারণ ছিল বাল্যবিবাহের প্রচলন l