এগারো
অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাঙলা দেশে নির্মিত হয়েছিল অসংখ্য দেব-দেউল। এগুলির মধ্যে সংখ্যায়। সবচেয়ে বেশী ছিল শিবমন্দির। শিবমন্দিরগুলি সাধারণতঃ ‘আটচালা’ মন্দিরের আকারেই তৈরী হত। তবে স্থানে স্থানে শিবমন্দির ‘রত্ন’ মন্দিরের আকারেও নির্মিত হত। অন্যান্য দেবদেবীর মন্দির ‘রত্ন’ ও ‘দালান’ রীতিতেই তৈরী হত। এসব মন্দিরের দেবদেবীর মধ্যে ছিল কালী, দুৰ্গা, সিংহবাহিনী, অন্নপূর্ণা, বিশালাক্ষী, রাধাকৃষ্ণ, গোপাল, ধর্মঠাকুর প্রভৃতি। এসব দেবদেবীর মন্দিরগাত্র শোভিত করা হত পোড়ামাটির অলঙ্করণ দ্বারা। (পরবর্তী মঠ, মন্দির ও মসজিদ’ অধ্যায় দেখুন)। এ সব দেবদেবী থেকে আমরা অষ্টাদশ শতাব্দীর লোকের উপাসনা পদ্ধতির একটা পরিচয় পাই। শতাব্দীর একেবারে শেষদিকে ‘কর্তাভজা’ নামে এক নূতন ধর্মসম্প্রদায়েরও উদ্ভব ঘটেছিল। এঁরা হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যুক্তসাধনার বাণী প্রচার করেছিলেন। এঁদের ধর্মের নাম ছিল ‘সত্যধর্ম’। কর্তাভজা সম্প্রদায়ের আদিগুরু ছিল আইলচাঁদ। আউলচাঁদের মৃত্যুর পর দল ভাঙতে শুরু করে। প্রধান দলের কর্তা রামশরণ পালই সত্যধর্ম প্ৰতিষ্ঠা করেছিল। পরবর্তী উনিশ শতকে কলকাতার বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি ও অভিজাত পরিবার রামশরণ পাল কর্তৃক প্ৰতিষ্ঠিত ‘সত্যধর্ম’-এর অনুগামী ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে আরও দুটা ধর্ম সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটেছিল। একটা হচ্ছে নদীয়া মেহেরপুরের ‘বলরাম ভজা৷’ সম্প্রদায়, ও অপরটি কুসঙ্গ পরগনার বাউলধর্মী ‘পাগলপন্থী’ সম্প্রদায়। বলরামের শিষ্যরা তাকে রামচন্দ্রের অবতার বলত। কর্তাভজা সম্প্রদায়ের মত এ সম্প্রদায়ের মধ্যেও জাতিভেদ প্ৰথা ছিল না। সম্প্রদায়টি দুই শ্রেণীতে বিভক্ত-(১) গৃহী, ও (২) ভিক্ষোপজীবী। পাগলপন্থী সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছে ফকির করম শা। গারো ও হাজংদের তিনি সাম্যভাবমূলক ও সত্যসন্ধ্যানী বাউলধর্মে দীক্ষিত করেন। ‘পাগলপন্থী’ নামটা ইংরেজদের দেওয়া। এ সম্প্রদায় পরে জমিদারশ্ৰেণীয় শোষণ ও উৎপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল।
সাহিত্যে জনজীবন
অষ্টাদশ শতাব্দীর জনজীবনের এক বিশ্বস্ত চিত্র আমরা পাই সমসাময়িক সাহিত্য থেকে। আগেই বলেছি যে বাঙলার সমৃদ্ধি নির্ভর করত তার কৃষির ওপর। সেজন্য সবাজাতের লোকই কৃষিকর্মে নিযুক্ত থাকত। জনজীবনে কৃষির এই গুরুত্বের জন্য অষ্টাদশ শতাব্দীর সুচনায় কবি রামেশ্বর ভট্টাচাৰ্য যখন তাঁর ‘শিবায়ন’ কাব্য রচনা করলেন, তখন তিনি শিবঠাকুরকে বাঙলার কৃষক সমাজেরই একজন মানুষ হিসাবে চিত্রিত করলেন।
রামেশ্বরের আদিবাড়ি ছিল যদুপুরে। কিন্তু সেখান থেকে শোভাসিংহের ভাই হেমতসিংহ কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে, তিনি আশ্ৰয় নেন। কর্ণগড়ের রাজা রামসিংহের। সেখানে তিনি রামসিংহের সভাসদ ও পুরাণপাঠক হন। পরে রামসিংহের মৃত্যুর পর তার পুত্র যশোমন্ত সিংহ তাকে সভাকবির সম্মান দেন। তারই নির্দেশে তিনি ‘শিবায়ন’ বা ‘শিবকীর্তন’ কাব্য রচনা করেন।
রামেশ্বরের কাব্যে শিব কৃষক, শিবানী কৃষক-পত্নী। বাঙলার অন্য কৃষকদের মত শিবও শুভদিনে চাষ আরম্ভ করেন। জমি চৌরস করেন, আল বাঁধেন। বীজ বপন করেন। তারপর বীজগুলি বেরুতে আরম্ভ করে। বর্ষার জল পেয়ে ধানের পাশে আরও নানারকম গাছপালা জন্মায়। তখন শিব নিড়ানের কাজ আরম্ভ করেন। বর্ষার সঙ্গে জোক মশা মাছির উপদ্রব বাড়ে। কিন্তু তা বলে তো কাতর হয়ে চাষী চাষ বন্ধ রাখে না। শিবও বিরত হন না। ধানগাছের মাত্র মূলটুকু ভিজা থাকবে, এমন জল রেখে বাকী জল নালা কেটে, ভাদ্র মাসে ক্ষেত থেকে বের করে দেন। আবার আশ্বিন-কার্তিকে ক্ষেতে জল বঁধেন। এর মধ্যে ডাক-সংক্রান্তি এসে পড়ে। শিব ক্ষেতে নল পুতেন। দেখতে দেখতে সোনালী রঙের ধান দিগন্ত পৰ্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। শিবের আনন্দ ধরে না। দেখতে দেখতে পৌষ মাসে ধান কাটার সময় আসে। শাঁখ বাজিয়ে গৌরী ধান ঘরে তুলেন। সবশেষে রামেশ্বর দিয়েছেন বাঙালী কৃষক গৃহস্থের মত নবায়ে ও পৌষপার্বণে শিবের দুই ছেলের সঙ্গে ভোজনের এক মধুময় আনন্দ চিত্র।
অন্য কৃষকপত্নীদের মত গৌরীও শিব ঠাকুরকে খাবার দিতে মাঠে যায়। গৌরীকে দেখে শিবঠাকুর হাল ছেড়ে দিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করেন—‘কি গো খাবার আনতে এত দেরী কেন?’ গৌরী বলে—’ছেলেপুলের সংসার এক হাতে সব করতে গেলে এমনই হবে।’ কথায় কথা বাড়ে। ক্ষুধিত শিব গৌরীর চুল ধরে টানে। শিব রুষ্ট হয়ে বলে-’ক্ষেমা কর ক্ষেমঙ্করি খাব নাঞি ভাত। যাব নাঞি ভিক্ষায় যা করে জগন্নাথ।’ আবার অন্য সময় শিব আদর করে গৌরীর হাতে শাঁখাও পরিয়ে দেন।
রামেশ্বর অপূর্ব বর্ণনা দিয়েছেন গৌরীর স্বামীপুত্রকে খাওয়ানোর-তিন ব্যক্তি ভোক্তা এক অন্ন দেন সতী। দুটি সুতে সপ্তমুখ, পঞ্চমুখ পতি। তিন জনে বার মুখে পাঁচ জনে খায়। এই দিতে এসে নাঞি হাড়ি পানে চায়। স্বাক্ত খায়া ভোক্তা যদি হস্ত দিল শাকে। অন্নপূর্ণ অন্ন আনে। রুদ্রমূর্তি ডাকে। কাতিক গণেশ বলে অন্ন আন মা হৈমবতী বলে বাছা! ধৈৰ্য হইয়া খা। উন্বন চর্বণে ফির্যা ফুরাইল ব্যঞ্জন। এক কাল্যে শূন্য থালে ডাকে তিন জন ॥ চটপট পিষিত মিশ্রিত করা যুষে। বায়ুবেগে বিধুমুখী বাস্ত হইয়া আসে। চঞ্চল চরণেতে নুপুর বাজে আর। রিনি রিনি কিঙ্কিনী কঙ্কন ঝঙ্কার॥’