নয়
বাণিজ্য বাঙালীর সমৃদ্ধির একটা প্ৰধান সুত্র ছিল। এজন্য বণিক সমাজের ধনাঢ্যতা প্ৰবাদবাক্যে দাঁড়িয়েছিল। এই বণিকসমাজই কলকাতা নগরীর গোড়াপত্তন করেছিল। মাত্র নবাগত বিদেশীরাই যে বাঙলার হাট থেকে মাল কিনাত, তা নয়। ভারতের নানা স্থান থেকে ব্যবসায়ীরা বাঙলার হাটে মাল কিনতে আসত। তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কাশ্মীরী, মুলতানী, আফঘান, পাঠান, শেখ, পগেয়া, ভুটিয়া ও সন্ন্যাসীরা। সন্ন্যাসীরা যে কারা, তা আমরা সঠিক জানি না। মনে হয় তারা হিমালয়ের সানু দেশ থেকে চন্দন কাষ্ঠ, মালার গুটি ও ভেষজ গাছগাছড়া বাঙলায় বেচতে আসত। তার বিনিময়ে তারা বাঙলা থেকে তাদের প্রয়োজনীয় সামগ্ৰী নিয়ে যেত। হলওয়েলের এক বিবরণী থেকে আমরা জানতে পারি যে দিল্পী ও আগর থেকে পগোয়ারা বর্ধমানে এসে প্রচুর পরিমাণ বন্ধ, সীসা, তামা, টিন ও লঙ্কা কিনে নিয়ে যেত। আর ভার পরিবর্তে তারা বাঙলায় বেচে যেত আফিম, ঘোড়া ও সোরা। অনুরূপভাবে কাশ্মীরের লোকেরা বাঙলা থেকে কিনে মিয়ে যেত লবণ, চামড়া, নীল, তামাক, চিনি, মালদার সাটন কাপড় ও বহুমূল্য রত্নসমূহ। এগুলি তারা বেচত নেপাল ও তিব্বতের লোকদের কাছে।
বাঙলার বাহিরের ব্যবসায়ীরা যেমন বাঙলায় আসত, বাঙলার ব্যবসায়ীরাও তেমনই বাঙলার বাহিরো যেত। ১৭৭২ খ্রীস্টাব্দে জয়নারায়ণ কর্তৃক রচিত ‘হরিলীলা’ নামক এক বাংলা বই থেকে আমরা জানতে পারি। যে বাঙলার একজন বণিক ব্যবসা উপলক্ষে হস্তিনাপুর, কর্নট, কলিঙ্গ, গুর্জর, বারাণসী, মহারাষ্ট্র, কাশ্মীর, ভোজ, পঞ্চাল, কম্বোজ, মগধ, জয়ন্তী, দ্রাবিড়, নেপাল, কাকী, অযোধ্যা, অবস্তী, মথুরা, কাম্পিলা, মায়াপুরী, দ্বারাবতী, চীন, মহাচীন ও কামরূপ প্ৰভৃতি দেশে গিয়েছিলেন।
যারা বাণিজ্যে লিপ্ত থাকত, তারা বেশ দু’পয়সা রোজগার করে বড়লোক হত। তাদের ধনদৌলত প্ৰবাদবাক্যে পরিণত হয়েছিল। ধনীলোকদের জীবনযাত্রা প্ৰণালী সাধারণ লোকদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। তাদের পোশাকআশাক ও অলঙ্কার দেখে বিদেশীরা আশ্চৰ্য হয়ে যেত। গৌড় ও পূর্ববাঙলার ধনীলোকেরা সোনার থাল-বাটিতে আহার করত। মাত্ৰ এক শতাব্দী আগে সপ্তদশ শতাব্দীতে ফিরিস্তা মন্তব্য করেছে যে কোনও বড়লোকের ঘরে কতসংখ্যক সোনার থাল-বাসন আছে, সেটাই ছিল তার ধনাঢ্যতার মাপকাটি।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে জিনিষপত্তরের দাম খুব সুলভ ছিল। ১৭২৯ খ্রীস্টাব্দের এক মূল্য তালিকায় আমরা মুরশিদাবাদে প্রচলিত যে দাম পাই, তা থেকে জানতে পারি যে প্ৰতি টাকায় মুরশিদাবাদে পাওয়া যেত সরু চাল এক মন দশ সের থেকে এক মন পনেরো সেরা পৰ্যন্ত, দেশী চাল চার মন পচিশ সের থেকে সাত মন কুড়ি সেরা পৰ্যন্ত, গম তিন মন ৩০ সের, তেল ২১ সেরা থেকে ২৪ সের, ধি দশ সের আট ছটাক থেকে ১১ সের ৪ ছটাক, ও তুলা দুই মন থেকে দুই মন ৩০ সের।
কিন্তু এই সুলভতা সত্বেও ছিল নিম্নকোটির লোকদের দারিদ্র্য। দারিদ্র্যের কারণ ছিল সরকারী কর্মচারীদের অত্যাচার ও জুলুম। রাজত্ব দিতে না পারলে যে কোন হিন্দুর স্ত্রী ও ছেলেগুলোকে নীলাম করে বেচে দেওয়া হত। এছাড়া, সরকারী কর্মচারীরা যখন তখন কৃষক রমণীদের ধর্ষণ করত। এর কোন প্ৰতিকার ছিল না। তার ওপর ছিল যুদ্ধ বিগ্রহের সময় সৈন্যগণের অত্যাচার ও বাঙলার দক্ষিণ অংশের উপকূলভাগে মগ ও পর্তুগীজ দস্যুদের উপদ্রব। তারা যে মাত্র লুটপাট করত ও গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দিত, তা নয়, মেয়েদের ধর্ষণ করত ও অসংখ্য নরনারী ও শিশুদের ধরে নিয়ে গিয়ে বিদেশের দাসদাসীর হাটে বেচে দিত। আরও ছিল বিদেশী বণিকদের অত্যাচার। ভারতচন্দ্ৰ তার ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে লিখেছেন-‘উদাসীন ব্যাপারী বিদেশী যারে পায়। লুটে লৈয়ে বেড়ি দিয়া ফাটকে ফেলায়।’ এটা ছিল শতাব্দীর মধ্যাহের পরিস্থিতি।
দশ
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষপাদে ইংরেজ গ্রাম-বাঙলার আর্থিক জীবনকে ধ্বংস করেছিল। ১৭৬৯ খ্রীস্টাব্দের ১৭ মার্চ তারিখে কোম্পানির বিলাতে অবস্থিত ডিরেকটররা এখানকার কর্মচারীদের আদেশ দেন-বাঙলার রেশম বয়ন-শিল্পকে নিরুৎসাহ করে মাত্র রেশম উৎপাদনের ব্যবসায়কে উৎসাহিত করা হউক।’ শীঘ্রই অনুরূপ নীতি তুলাজাত বস্ত্র ও অন্যান্য শিল্প সম্বন্ধেও প্রয়োগ করা হয়। ইংরেজ এখান থেকে কাঁচামাল কিনে বিলাতে পাঠাতে লাগল, আর সেই কাঁচামাল থেকে প্ৰস্তুত দ্রব্য বাঙলায় এনে বেচিতে লাগল। বাঙলা ক্রমশ গরীব হয়ে পড়ল। ১৭৮২ খ্রীষ্টাব্দ থেকে সাহেবরা নীলচাষে লিপ্ত হল। দরিদ্র কৃষকদের ওপর অত্যাচারের এটা এক যন্ত্র হয়ে দাঁড়াল। Percival Spear বলেছেন–“Bengal sank from a state of fabled prosperity to rural misery”.
ইংরেজ একদিকে যেমন বাঙলার গ্রামগুলিকে হীন ও দীন করে তুলল, অপর দিকে তেমনই শহরে ও তার আশপাশে গড়ে তুলল এক নূতন সমাজ। সে সমাজের অঙ্গ ছিল ব্যবসাদার, ঠিকাদার, দালাল, মহাজন, দোকানদার, মুনসী, কেরানী প্ৰভৃতি শ্রেণী। বস্তুত অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে বাঙলার সমাজ জীবনে এক বিরাট পরিবর্তন দেখা দিল। এর ফলে গ্ৰামীন সমাজজীবন (যেখানে শতকরা ৯৯ জন বাস করত) সম্পূর্ণভাবে ভেঙ্গে পড়ল। তারপর বামালোতী সহজিয়া বৈষ্ণবধর্মের দল এনে দিল গ্রামীন জীবনে এক ন্যাঙ্কার জনক নৈতিক শৈথিল্য।