পরবের দিনসমূহে লোক গঙ্গাস্নান বা নিকটস্থ কোন পবিত্ৰ পুষ্করিণীতে স্নান করত। বড় বড় পরব উপলক্ষে এই সব জায়গায় মেলা বসত। ভদ্রসম্প্রদায়ের মেয়েরা ওই সব মেলায় সুযোগ পেত নিজেদের মনোমত গৃহস্থালীর জিনিষপত্তর কেনবার।
সাত
পুরুষরা মাঠে-ঘাটে, হাটে ব্যস্ত থাকত। আর মেয়ের ঘরকান্নার কাজ করত। ঘরকন্নার কাজের মধ্যে একটা প্ৰধান কাজ ছিল রান্নাবান্না করা ও অবসর সময়ে সুতাকাটা ও প্ৰদীপের সলতে পাকানো। তা ছাড়া তারা পান। সাজত ও নানারকম নকসাওয়ালা কঁথা সেলাই করত। ডালের বড়ি দিত। মুড়ি ভাজিত ও মুড়কি তৈরী করত। নারিকেল দিয়ে নানারকম মিষ্টান্ন তৈরী করত। এ সব জলখাবার হিসাবে ব্যবহৃত হত। রান্নাবান্না হত কাঠের আগুনে, কেননা কয়লা অষ্টাদশ শতাব্দীতে ওঠেনি। মাটির ইড়িতেই ভাত ডাল রান্না হত। খাওয়া-দাওয়া হত। পাথরের ও র্কাসার থাল-বাসনে। লোক কাঠের পিড়া বা আসনের ওপর বসে খাওয়া-দাওয়া করত। বিধবাদের জন্য আলাদা রান্না হত, হয় ভিন্ন উনুনে নয় অন্য উনুন ন্যাতা-গোবর বুলিয়ে শুদ্ধ করে। এ সম্বন্ধে শুচিতা খুব কঠোর ছিল। খাদ্যাখ্যান্য সম্বন্ধে আগেকার দিনের রঘুনন্দনের বিধান অনেকটা হালকা হয়ে গিয়েছিল। কেননা, ষোড়শ শতাব্দীতে পর্তুগীজরা আসবার পর বাঙালী তার গৃহস্থালীতে পর্তুগীজদের আনীত অনেক আনাজ-তরকারী ও অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রীকে স্থান দিয়েছিল। সেগুলো বাংলা ভাষায় পর্তুগীজ শব্দের প্রাচুৰ্য থেকে বুঝতে পারা যায়। সে সব দ্রব্যসামগ্রীর অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে-আলু, তামাক, বজরা, সাগু, কাজু বাদাম, আনারস, আতা, আমড়া, পেঁপে, পেয়ারা, লেবু, আচার, আরক, ভাঙ, বৃঙ্খল, চা, কোকো, কাবাব, বাসন, বিস্কুট, জোলাপ ইত্যাদি। আরিষ্ণু যে সব পর্তুগীজ শব্দ অষ্টাদশ শতাব্দীর বাঙালী ব্যবহার করত, সেগুলো হচ্ছে—আয়, আলমিরা, বালতি, বাট্ট, বুটিক, কামরা, কামিজ, চাবি, গুদাম, ঝিলমিলি, লঙ্কর, নিলাম, মিন্ত্রি, পাদরী, পালকি, পমফ্রেট, পিওন, রসিদ, বারাগু, আলকাতরা, ভাপ, বিয়া, বোতাম, বোতল, কেদাবা, কফি, কাফ্রি, কাকাতুয়া, কামান, ছাপ, কোঁচ, কম্পাস, ইস্পাত, ইঙ্গি, ফিতা, ফর্ম, গরাদ, জানালা, লাণ্টাৰ্ণ, মাস্তুল, মেজ, পিপা, পিরিচ, পিস্তল, পেরেক, রেস্ত, সাবান, টোকা, তুফান, তোয়ালে, বরগা, বেহালা ইত্যাদি।
আট
অষ্টাদশ শতাব্দীর সমাজে আর্থিক সম্পদ প্ৰতিষ্ঠিত ছিল কৃষি, শিল্প ও লাণিজ্যের ওপর। নদীমাতৃক বঙ্গভূমি উৎপন্ন করত প্রচুর পরিমাণ কৃষিজাত পণ্য। এই সকল কৃষিজাত পণ্য বাঙলার নিজস্ব চাহিদা মিটিয়ে বিক্রীত হত দেশ-দেশান্তরের হাটে। কৃষিজাত পণ্যের মধ্যে প্রধান ছিল চাউল, তুলা, ইক্ষু, তৈলবীজ, সুপারি, আদা, লঙ্কা, কলা ও অন্যান্য নানাবিধ ফল। পরে পাট ও নীলের চাষও প্ৰভূত পরিমাণে হত। শতকরা ৯৯ জন লোক কৃষিকর্মে নিযুক্ত থাকত। কৃষিকে হীনকর্ম বলে কেউ মনে করত না। এমন কি ব্ৰাহ্মণরাও ক্লষিকৰ্ম করতে লজ্জাবোধ করত না। তবে দুৰ্ভিক্ষ মাঝে মাঝে সুজলা, সুফলা বাঙলার জনজীবনকে বিপন্ন করত। এরূপ বিপৰ্যয় চরমে উঠেছিল ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময়।
শিল্পজাত পণ্যের মধ্যে প্ৰধান ছিল কার্পাস ও রেশমজাত বস্ত্র। সুক্ষ্মবন্ত্র প্ৰস্তুতের জন্য বাঙলার প্রসিদ্ধি ছিল৷ একাপ বস্ত্ৰ বয়নের জন্য প্ৰতি ঘরে ঘরে মেয়েরা সুতা কাটিত। দেশবিদেশে বাঙলার বস্ত্রের চাহিদা ছিল। বাঙলার শর্করার প্রসিদ্ধিও সর্বত্র ছিল। এছাড়া বাঙলায় প্ৰস্তুত হত শঙ্খজাত নানারূপ পদার্থ, লৌহ, কাগজ, কালি, লাক্ষা, কৃষিকর্মের জন্য নানারূপ যন্ত্রপাতি, বারুদ ও ও বরফ। বীরভূমের নানাস্থানে ছিল লৌহপিণ্ডের আকর। তা থেকে লৌহ ও ইস্পাত তৈরী হত। বীরভূমের যে সকল স্থানে লৌহ ও ইস্পাতের কারখানা ছিল, সেগুলি হচ্ছে দামরা, ময়সার, দেওচা ও মহম্মদনগর। এই সকল লোহা দিয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পাদ পর্যন্ত কলকাতা ও কাশিমবাজারের কামান তৈরী হত। লোহা ও ইস্পাত প্রস্তুতের জন্য বীরভূমের কারিগরগণ নিজস্ব প্রণালী অবলম্বন করত। বরফ তৈরীর জন্যৎবাঙলার নিজস্ব প্ৰণালী ছিল। শীতকালে মাটিতে গর্ত করে, তার মধ্যে গরম জল ভরতি করে সমস্ত রাত্রি রাখা হত। প্ৰভাতে তা বরফে পরিণত হত। এছাড়া, চিনি তৈরীর জন্যও বাঙলার নিজস্ব পদ্ধতি ছিল। এই পদ্ধতি অনুযায়ী যে চিনি তৈরী হত তা ধবধবে সাদা। এই চিনি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা হত। এছাড়া, বাঙলার বিশেষ পারদর্শিতা ছিল পালকি ও নৌকা নির্মাণে। এই সকল নৌকা দেশের মধ্যে নদীপথে পরিবহণের কাজে ও সমুদ্রপথে বাণিজ্যে লিপ্ত থাকত। তা ছাড়া মৎসজীবীরা এই সকল নৌকার সাহায্যে সুন্দরবন প্রভৃতি অঞ্চলে মাছ ধরত। বাঙলার মৃৎশিল্পেরও যথেষ্ট উৎকর্ষতা ছিল। মৃৎশিল্পীরা হাঁড়িকলসী, পুতুল, প্ৰতিমা ও মন্দিরগাত্রের মৃৎফলকসমূহ তৈরী করত। মৃৎশিল্পে নাটোরের বিশেষ প্ৰসিদ্ধি ছিল। পরে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় নাটোর থেকে কয়েকজন মৃৎশিল্পী এনে কৃষ্ণনগর ঘরানার পত্তন করেছিলেন।
খাগড়া, নলহাটি ও দাঁইহাটা কাঁসার বাসন শিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল। বীরভূম, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর প্রভৃতি অঞ্চলের কাঁসিারিরা ছাঁচে ঢালা বা চাদর পেটাই করে কুঁদে নানারকম বসন তৈরী করত, যথা ধান মাপবার কুনকে, পিতলের প্রদীপ, পিলসুজ, ইত্যাদি।