বাঙলার জাতিসমূহের এক প্ৰধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে এগুলো অন্তর্বিবাহের (endogamous) গোষ্ঠী। তার মানে বাঙালীকে তার জাতির মধ্যেই বিবাহ করতে হত। অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাঙালী তার বৃত্তিগত বৈশিষ্ট্য হারালেও, তার এই সামাজিক বৈশিষ্ট্য হারায়নি। বিবাহ জাতির মধ্যেই হত। জাতির মধ্যে বিবাহ না দিলে, বাঙালীকে ‘এক ঘরে’ হতে হত। এক ঘরে হওয়া সেযুগে এক কঠোর সামাজিক শান্তি ছিল। কেননা, তার নাপিত, ধোবা, পুরোহিত সব বন্ধ হয়ে যেত, এবং তার সঙ্গে কেউ সামাজিক আদানপ্ৰদান করত না।
দুই
বিবাহ সম্পর্কে অষ্টাদশ শতাব্দীর সমাজে ছিল কৌলিন্য প্ৰথা। এটা প্ৰথমে ব্ৰাহ্মণ্যসমাজেই প্রবর্তিত হয়েছিল। পরে কায়স্থ, বৈদ্য, সাদগোপ প্ৰভৃতি সমাজেও প্রবর্তিত হয়। কৌলিন্য প্রথার ফলে নিজ জাতির মধ্যেই পরস্পরের আহার ও বৈবাহিক বিষয়ে নানারকম জটিল রীতিনীতি ও প্রথাপদ্ধতির উদ্ভব হয়েছিল। সমাজে যাদের একবার কুলীনের মর্যাদা দেওয়া হত, তারা বংশপরম্পরায় কুলীন বলে আখ্যাত হতেন। রাঢ়ীয় ব্ৰাহ্মণসমাজে যাদের কুলীন করা হয়েছিল, তারা হচ্ছেন মুখোপাধ্যায়, বন্দ্যোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায় ও গঙ্গোপাধ্যায়। অনুরূপভাবে বঙ্গজ কায়স্থসমাজে ঘোষ, বসু, গুহ ও মিত্রদের কুলীনের মৰ্যাদা দেওয়া হয়েছিল। সাদগোপ সমাজে শূর (সুর), নিয়োগী ও বিশ্বাস-য়া কুলীন বলে পরিগণিত হতেন। সমজাতীয় সমাজে বিভিন্ন বংশকে উচ্চ ও নীচরূপে চিহ্নিত করে, এই -প্ৰথা যে সমাজকে দুর্বল করে দিয়েছিল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
ব্ৰাহ্মণসমাজে এই প্রথাটি ছিল কন্যাগত। তার মানে, কুলীনের ছেলে কুলীন ছাড়া অকুলীনের মেয়েকেও বিবাহ করতে পারত। কিন্তু কুলীনের মেয়ের বিবাহ কুলীনের ছেলের সঙ্গেই দিতে হত। অকুলীনের সঙ্গে তার বিবাহ দিলে মেয়ের বাপের কৌলীন্য ভঙ্গ হত, এবং সমাজে তাকে হীন বলে মনে করা হত। স্বতরাং কুলরক্ষার জন্য কুলীন ব্রাহ্মণ পিতাকে যেনতেনপ্রকারেন কুলীন পাত্রের সঙ্গে মেয়ের বিবাহ দিয়ে নিজের কুলরক্ষা করতে হত। তার কারণ অনুষ্ঠা কন্যা শ্বরে রাখা বিপদের ব্যাপার ছিল। এক দিকে তো সমাজ তাকে একঘরে করত, আর অপর দিকে ছিল যবনের নারী লোলুপতা। অনেক সময় যবনেরা নারীকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে (এমন কি বিবাহমণ্ডপ থেকে) নিকা করতে কুণ্ঠ বোধ করত না।
সাধারণতঃ কুলীন ব্রাহ্মণগণ অগুনতি বিবাহ করত এবং স্ত্রীকে তার পিত্রালয়েই রেখে দিত। এরূপ প্ৰবাস-ভর্তুক সমাজে কুলীন কন্যাগণ যে সব ক্ষেত্রেই সতীসাবিত্রীর জীবন যাপন করত, সে কথা হলপ করে বলা যায় না। এর ফলে বাঙলার কুলীন সমাজে যে দূষিত রক্ত প্রবাহিত হয়েছিল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তা ছাড়া, নারীর যবন দ্বারা ধৰ্ষিত হবারও সম্ভাবনা ছিল। যবনদূষিত হবার শঙ্কাতেই বাঙালী সমাজে বাল্যবিবাহ, শিশুহত্যা, সতীদাহ প্ৰভৃতি প্ৰথা দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেয়েছিল।
কৌলিন্য প্ৰথা বাঙালী সমাজকে ক্রমশ অবনতির পথেই টেনে নিয়ে। গিয়েছিল। যে সমাজে কৌলিন্য প্রথা প্রচলিত ছিল ও মেয়ের বিবাহ কষ্টকর ও ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপারে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, সে সমাজে মেয়েকে অপসরণ। করবার একটা স্বাভাবিক প্ৰবৃত্তি পিতামাতার মনে জেগেছিল। সেজন্য গঙ্গাসাগরের মেলায় গিয়ে মেয়েকে সাগরের জলে ভাসিয়ে দেওয়াটা এদেশে একটা প্ৰথায় দাঁড়িয়েছিল। উনবিংশ শতাব্দীতে ইংরেজ সরকার আইন দ্বারা এই প্ৰথা বন্ধ করে দেয়। অনেকে আবার মেয়েকে সাগরের জলে ভাসিয়ে না দিয়ে, মন্দিরের দেবতার নিকট তাদের দান করতেন। মন্দিরের পুরোহিতরা এই সকল মেয়েদের নৃত্যগীতে পটীয়সী করে তুলতেন। এদের দেবদাসী বলা হত। এটাও বিংশ শতাব্দীভে আইন দ্বারা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
তিন
কৌলিন্য প্ৰথাই অষ্টাদশ শতাব্দীর সমাজে একমাত্র অপপ্ৰথা ছিল না। আরও ছিল সহমরণ ও দাসদাসীর কেনাবেচা। হিন্দুর মেয়েরা তো অনেকে স্বামীর সঙ্গে সহমৃতা হতেনই, এমন কি ধর্মান্তরিত নিম্নশ্রেণীর মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যেও এই প্ৰথা কোথাও কোথাও অনুস্থত হত। অষ্টাদশ শতাব্দীতে, কৌলিন্য-কলুষিত সমাজে এটা প্রায় বাধ্যতামূলক প্রথায় দাঁড়িয়েছিল। সবক্ষেত্রেই যে স্ত্রী স্বেচ্ছায় সহমৃতা হতেন, তা নয়। অনেক ক্ষেত্রে স্ত্রীকে অহিফেন লেবান করিয়ে তার প্রভাবে বা বলপূর্বক তাকে চিতায় চাপিয়ে পুড়িয়ে মারা হত। নিজের জ্যেষ্ঠভ্ৰাতৃজায়া সহমৃতা হওয়ায় রাজা রামমোহন রায় এরূপ ব্যথিত হয়েছিলেন যে নিষ্ঠাবান সমাজের বিরুদ্ধে একাকী খড়্গহস্ত হয়ে এই প্ৰথা লোপ করতে তিনি বদ্ধপরিকর হন। তারই চেষ্টায় তৎকালীন গভর্নর-জেনারেল লর্ড বেণ্টিঙ্ক ১৮২৯ খ্রীস্টাব্দে আইন প্রণয়ন দ্বারা এই প্রথা নিষিদ্ধ করে দেন।
চার
দাসদাসী কেনাবেচা অষ্টাদশ শতাব্দীতে বিশেষভাবে প্ৰচলিত ছিল। তাদের ওপর গৃহপতির সম্পূর্ণ মালিকানা স্বত্ব থাকত। গৃহপতির অধীনে থেকে তারা গৃহপতির ভূমিকৰ্ষণ ও গৃহস্থালীর কাজকর্ম করত। সাধারণতঃ এদের হাট থেকে কেনা হত। দাসদাসীর ব্যবসাটা বিশেষভাবে চলত দুভিক্ষের সময়। এটা যে অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে নিবদ্ধ ছিল, তা নয়। চাষাভূষার ঘরেও দাসদাসী থাকত। সাধারণতঃ লোক দাসীদের সঙ্গে মেয়ের মত আচরণ করত। অনেকে আবার নিজের ছেলের সঙ্গে কোন দাসীর বিয়ে দিয়ে তাকে পুত্রবধু করে নিত। তখন সে দাসত্ব থেকে মুক্ত হত। অনেকে আবার যৌনলিন্স চরিতার্থ করবার জন্য দাসীদের ব্যবহার করত। এরূপ দাসীদের গর্ভজাত সন্তানদের উত্তরাধিকার সম্পর্কে স্মৃতিতে নির্দেশও দেওয়া হয়েছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে আগন্তুক ইংরেজরাও দাসদাসী কিনত ও খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে তাদের বেচিত।