উত্তরবঙ্গে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের অপর একজন নেতা ছিলেন দর্পদেব। ১৭৭৩ খ্রীষ্টাব্দে ইংরেজবাহিনীর সঙ্গে তিনি এক খণ্ড যুদ্ধ করেন।
কুচবিহারে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের অন্যতম নায়ক ছিলেন রামানন্দ গোঁসাই। ১৭৭৬ খ্রীস্টাব্দে দিনহাটা নামক স্থানে তার বাহিনীর সঙ্গে লেফটানেণ্ট মরিসনের এক প্ৰচণ্ড যুদ্ধ হয়। ইংরেজবাহিনীর তুলনায় অস্ত্রশস্ত্ৰ স্বল্প ও নিকৃষ্ট থাকায় তিনি গেরিলা যুদ্ধের কৌশল অবলম্বন করে মরিসনের বাহিনীকে সম্পূর্ণ পরাজিত করেন। ইংরেজবাহিনী ছত্ৰভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়।
সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ১৭৬৩ থেকে ১৮০০ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত চলেছিল। এই বিদ্রোহের শেষ পর্বের যারা নায়ক ছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখনীয় ইমামবাড়ী শাহ, বুদ্ধ, শাহ, জহুরী শাহ, মূসা শাহ, সোভান আলি প্রমুখ। আরও একজন ছিলেন, তার নাম জয়রাম। তিনি ছিলেন একজন এদেশীয় সুবেদার। ১৭৭৩ খ্রীস্টাব্দে ইংরেজবাহিনীর সঙ্গে সন্ন্যাসীবাহিনীর যে সংগ্ৰাম হয়, তাতে তিনি কয়েকজন সিপাইসহ সন্ন্যাসীদের সাহায্য করেছিলেন। সেই যুদ্ধে ইংরেজবাহিনী পরাজিত হয়েছিল। জয়রাম কিন্তু ইংরেজদের হাতে ধরা পড়েন। ইংরেজরা তাঁকে কামানের তোপে হত্যা করে।
ইংরেজদের সঙ্গে সংঘর্ষে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের অপর একজন নেতা জহুরী শাহ-ও ধরা পড়ে। বিদ্রোহের অপরাধে তাকে ১৮ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
সন্ন্যাসী বিদ্রোহের শেষ পর্বের শ্রেষ্ঠতম নায়ক ছিল মুশা শাহ। তিনি ছিলেন মজনু শাহের যোগ্য শিষ্য ও ভ্রাতা। ১৭৮৬ খ্রীস্টাব্দে মজনুর মৃত্যুর পর তিনিই বিদ্রোহ অব্যাহত রাখেন। ১৭৮৭ খ্রীস্টাব্দের মার্চ মাসে তিনি রাজশাহী জেলায় প্ৰবেশ করেন। সেখানে রাণী ভবানীর বীরকন্দাজ বাহিনী তাঁর প্রতিরোধ করে। কিন্তু মুশা বরকন্দাজবাহিনীকে পরাজিত করেন। ১৭৮৭ খ্রীস্টাব্দের মে মাসে লেফটানেন্ট ক্রিষ্টির নেতৃত্বে এক ইংরেজবাহিনী মুশাকে আক্রমণ করে। ইংরেজ বাহিনী মুশার পশ্চাদ্ধারন করেও তাকে বন্দী করতে পারে না। পরে ফেরাগুল শাহের নেতৃত্ব নিয়ে যে দ্বন্দ্ব হয়, সেই দ্বন্দ্বে মুশা ফেরাগুলোর হাতে নিহত হন।
সন্ন্যাসী বিদ্রোহের শেষ পর্বের অপর এক প্ৰধান নেতা ছিলেন সোভান আলি। এক সময় তিনি বাঙলা, বিহার ও নেপালের সীমান্ত জুড়ে এক বিরাট এলাকায় ইংরেজশাসক ও জমিদারগোষ্ঠীকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিলেন। দিনাজপুর, মালদহ ও পূর্ণিয়া জেলায় ইংরেজ কুঠি ও জমিদার-মহাজনদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাবার সময় তার সহকারী জহুরী শাহ ও মতিউল্লা ইংরেজদের হাতে ধরা পড়ে ও কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়। পালিয়ে গিয়ে তিনি আমুদী শাহ নামে এক ফকির নায়কের দলে যোগ দেন। কিন্তু ইংরেজদের হাতে এ দল পরাজিত হয়। এই পরাজয়ের পর ৩০০ অনুচর নিয়ে ১৭৯৭-১৭৯৯ খ্রীস্টাব্দ পৰ্যন্ত উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় তিনি ছোট ছোট আক্রমণ চালান। তাঁকে গ্রেপ্তারের জন্য ইংরেজ সরকার চার হাজার টাকা পুরষ্কার ঘোষণা করে। তাঁর শেষ জীবন সম্বন্ধে আমরা কিছু জানি না।
শেষ পর্যন্ত ইমামবাড়ী শাহ ও বুদ্ধ, শাহ বগুড়ার জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের ঝাণ্ডা উড্ডীন রেখেছিলেন।
একদিকে যেমন ‘সন্ন্যাসী বিদ্ৰোহ’ চলছিল, অপরদিকে তেমনই ইংরেজশাসক ও জমিদারগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দেশের মধ্যে গণ-আন্দোলন ও চলছিল। তাদের মধ্যে উল্লেখনীয় চুয়াড় ও বাগড়ী নায়েক বিদ্রোহ, চাকমা বিদ্রোহ, ঘরুই বিদ্রোহ, হাতিখেদা বিদ্রোহ, বাখরগঞ্জের সুবান্দিয়া গ্রামের বিদ্রোহ, ত্রিপুরার রেজশনাবাদ পরগণায় সমশের গাড়ীর বিদ্রোহ ও শতাব্দীর শেষের দিকে তন্তুবায়দের ওপর ইংরেজ বণিকদের উৎপীড়নের বিরুদ্ধে তন্তুবায়দের বিদ্রোহ। এসব বিদ্রোহ সম্বন্ধে বিশদ বিবরণ যাঁরা জানতে চান, তাঁরা আমার ‘প্রসঙ্গ পঞ্চবিংশতি’ বইখানা পড়ে নিতে পারেন।
গ্রামীন সমাজ ও জীবনচর্য
অষ্টাদশ শতাব্দীর বাঙালী সমাজ জাতিভেদ প্রথার ওপরই প্ৰতিষ্ঠিত ছিল। জাতিবিন্যাসের শীর্যদেশ ছিল ব্রাহ্মণ। তার নীচে ছিল নানান জাতি যথা বৈদ্য, কায়স্থ, সাদগোপ, কৈবর্ত, গোয়ালা, তাম্বুলি, উগ্ৰক্ষেত্রী, কুম্ভকার, তিলি, যুগী, তীৰ্গতি, মালি, মালাকার, কলু, নাপিত, বুজক, দুলে, শাঁখারী, হাড়ি, মুচি, ডোম, চণ্ডাল, বাগদী, স্বর্ণকার, সুবর্ণবণিক, কর্মকার, সূত্রধর, গন্ধবেনে, জেলে, পোদ্দার, বারুই ইত্যাদি। তবে মধ্যযুগের সমাজের ন্যায় ব্ৰাহ্মণরা সকল জাতির হাত থেকে জল গ্রহণ করতেন না। মাত্র নয়টি জাতি জল আচরণীয় জাতি বলে চিহ্নিত ছিল। এদের ‘নবশাখ’ বলা হত। এরা হচ্ছে তিলি, তাঁতি, মালাকার, সাদগোগ, নাপিত, বারুই, কামার, কুম্ভকার ও ময়রা।
প্ৰতি জাতিরই এক একটা বিশেষ পেশা বা বৃত্তি ছিল। ইংরেজদের সংস্পর্শে এসে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যাহ্নেই বাঙালী তার কৌলিক বৃত্তি হারাতে আরম্ভ করে। এর আভাস আমরা পাই ১৭৪৮ খ্রীষ্টাব্দের এক দলিক থেকে। ইংরেজরা আগে সুতীবস্ত্র সংগ্রহের জন্য দাদন দিত শেঠ-বসাকদের। শেঠ-বসাকরা ছিল তন্তুবায় গোষ্ঠীর লোক। কিন্তু ১৭৪৮ খ্রীষ্টাব্দে ইংরেজরা সূতীবস্ত্রের জন্য কয়েকজন ভিন্ন জাতীয় লোককে দাদন দেয়। তাতে শেঠ-বসাকরা তাদের আপত্তি জানায়। তখন থেকেই ইংরেজদের সংস্পর্শে এসে নাগরিক সমাজে বাঙালী তার জাতিগতবৃত্তি হারিয়ে ফেলে। কলকাতা শহরে এসে বাঙালী যে তার জাতিগত বৃত্তি হারিয়ে ফেলছিল তা ১৭৬৩ থেকে ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে কোম্পানি বিভিন্ন জাতির লোককে নানারকম কারবার করবারু জন্য যে লাইসেন্স দিয়েছিল, তা থেকেই প্ৰকাশ পায়। নানান জাতির লোক যে নানারকম ব্যবসায়ে লিপ্ত হচ্ছিল, তা আমরা অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধের ব্যবসাদারদের নাম থেকেও বুঝতে পারি। বস্তুতঃ অষ্টাদশ শতাব্দীতে শহরে বাঙলার জাতিসমূহের বৃত্তিগত বৈশিষ্ট্যের বিলুপ্তি ঘটিছিল। তবে এই সময় কায়স্থসমাজের প্রসার ও প্ৰতিপত্তি লক্ষণীয়। এর কারণ, মহারাজা নবকৃষ্ণ দেব বাহাদুরের ‘জাত কাছারী’। কলকাতায় আগন্তুক অপরিচিত ও অজ্ঞাতকুলশীল অনেকেই সামাজিক মৰ্যাদা লাভের জন্য, ‘জাত কাছারী’-র কাছে আবেদন করে ‘কায়স্থ’ স্বীকৃতি লাভ করেছিল। এর ফলে, কলকাতার কায়স্থসমাজ বেশ প্রসারিত হয়ে উঠেছিল।