এ ছাড়া ছিল ধর্মান্তরিত মুসলমান সমাজ। তাদের কথা আমরা এখানে বলছি না ।
।। চার ।।
আগেই বলেছি যে আঠারো শতকের গোড়ায় বাঙলাদেশের বিরাট আকার ছিল। এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। ওড়িশা, আসাম, ও কুচবিহারের অংশবিশেষ ও ত্রিপুরা। এটা বিভক্ত ছিল ১৬৬০ মহাল বা পরগণায়। সব মহল অবশ্য সমান আকারের ছিল না। কোন কোনটা খুব বড়, যার বাৎসরিক রাজস্বের পরিমাণ ছিল ৭০ লক্ষ টাকা। আবার কোন কোনটা খুবই ছোট, এত ছোট যে রাজদরবারে দেয় বার্ষিক রাজস্বের পরিমাণ ছিল মাত্ৰ পঁচিশ টাকা। এই সকল ছোট-বড় মহালগুলি যাদের অধীনে ছিল, তারা নানা অভিধা বহন করত, যথা জমিদার, ইজারাদার, ঘাটওয়াল, তালুকদার, পতনিদার, মহলদার, জোতদার, গাতিদার ইত্যাদি। বড় বড় মহালগুলি জমিদারদেরই অধীনস্থ ছিল। এ সকল জমিদারীর মধ্যে যেগুলো সবচেয়ে বড়, সে সব জমিদারদের প্রায় সামন্তরাজার মত আধিপত্য ছিল। দিল্লীর বাদশাহ তাদের রাজা, মহারাজা, খান, সুলতান প্রভৃতি উপাধিতে ভূষিত করতেন। তারাই ছিল সাহিত্য, শিল্পকলা, সংস্কৃতি ও স্থাপত্যের পৃষ্ঠপোষক। তাদের সম্বন্ধে শিবনাথ শাস্ত্রী যা বলেছেন, তা এখানে উন্মুক্ত করা যেতে পারে। “দেশীয় রাজগণ এক সময় দেশের মহোপকার সাধন করিয়াছেন। যখন সমগ্ৰ দেশ যবন রাজাদিগের করকবলিত হইয়া মুহ্যমান হইতেছিল, তখন তাহারা স্বীয় মস্তকে ঝড়বৃষ্টি সহিয়া দেশ মধ্যে জ্ঞানী ও গুণীজনকে রক্ষা করিয়াছেন ; এবং শিল্প সাহিত্য কলাদির উৎসাহ দান করিয়াছেন। যবনাধিকার কালে দেশীয় রাজগণ অনেক পরিমাণে সর্বময় কর্তা ছিলেন। তাঁহাদের দেয় নির্ধারিত রাজস্ব দিলেই তাহারা স্বীয় অধিকার মধ্যে যথেচ্ছ বাস করিতে পারিতেন। সুতরাং তাহারা পাত্ৰ, মিত্র, সভাসদে পরিবেষ্টিত হইয়া সুখেই বাস করিতেন। জ্ঞানী ব্যক্তিগণ অনেক সময়ে ইহাদের আশ্রয়ে বাস করিয়া নিরাপদে স্বীয় স্বীয় প্ৰতিভাকে বিকাশ করিবার অবসর পাইতেন।”
এরূপ জমিদারদের অন্যতম ছিল জঙ্গলমহল ও গোপীভূমের সদগোপ রাজার, বাঁকুড়ার মল্লরাজগণ, বর্ধমানের ক্ষত্ৰিয় রাজবংশ, চন্দ্ৰকোেনার ব্ৰাহ্মণ রাজারা, নদীয়ার ব্ৰাহ্মণ রাজবংশ, নাটোরের ব্ৰাহ্মণ রাজবংশ ও আরও অনেকে।
জঙ্গলমহলের রাজাদের মধ্যে প্ৰসিদ্ধ ছিলেন নারায়ণগড়, নাড়াজোল ও কর্ণগড়ের রাজারা। এর মধ্যে নারায়ণগড়ের আয়তন ছিল ৮১,২৫৪ একর বা ২২৬,৯৬ বর্গমাইল, আর নাড়াজোলের ছিল ৮,৯৯৭ একর বা ১৪.০৪ বর্গমাইল । সুতরাং নারায়ণগড়ই বড় রাজ্য ছিল। কিংবদন্তী অনুযায়ী এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা গন্ধৰ্বপাল। তিনি বর্ধমানের গড় আমরাবতীর নিকটবর্তী দিগনগর গ্রাম থেকে এসে নারায়ণগড় রাজ্য প্ৰতিষ্ঠা করেন। ১৮৫২ খ্ৰীস্টাব্দের ৭ জানুয়ারী তারিখে মেদিনীপুরের কালেকটর মিস্টার এচ. বি. বেইলী লিখিত এক মেমোরাণ্ডাম থেকে আমরা জানতে পারি যে নারায়ণগড়ের রাজারাই ছিলেন জঙ্গলমহলের প্ৰধানতম জমিদার। তাদের কুলজীতে ৩০ পুরুষের নাম আছে। তাঁরা খুরদার রাজার কাছ থেকে ‘শ্ৰীচন্দন’ ও দিল্পীর বাদশাহের কাছ থেকে ‘মাড়ি সুলতান’ উপাধি পেয়েছিলেন। বেইলী সাহেব এই দুই উপাধি পাবার কারণও উল্লেখ করে গেছেন। যে চন্দনকাষ্ঠ দিয়ে পুরীর জগন্নাথদেবের বিগ্রহ তৈরী হত, তা নারায়ণগড়ের রাজারা সরবরাহ করতেন বলেই খুরদার রাজা তাদের ‘শ্ৰীচন্দন’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। ‘মাড়ি সুলতান’ মানে ‘পথের মালিক’। শাহজাদা খুররম (উত্তরকালের সম্রাট শাহজাহান) যখন পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হন, তখন সম্রাট সৈন্যদ্বারা পরাজিত হয়ে মেদিনীপুরের ভিতর দিয়ে পলায়ন করতে গিয়ে দেখেন যে ঘোর জঙ্গলের ভিতর দিয়ে পলায়ন করা অসম্ভব । তখন নারায়ণগড়ের রাজা শ্যামবল্লভ এক রাত্রির মধ্যে তাঁর গমনের জন্য পথ তৈরি করে দেন। এই উপকারের কথা স্মরণ করে পরবর্তীকালে সম্রাট শাহজাহান রক্তচন্দনে পাঁচ আঙুলের ছাপবিশিষ্ট এক সনদ দ্বারা তাঁকে ‘মাড়ি সুলতান’ বা ‘পথের মালিক’ উপাধি দেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে বৰ্গীর হাঙ্গামার সময় ও ১৮০৩ খ্রীস্টাব্দে মারাঠাদের বিরুদ্ধে নারায়ণগড়ের রাজারা ইংরেজদের সাহায্য করেছিলেন । বেইলী সাহেব নারায়ণগড়ের তৎকালীন ২৫ বৎসর বয়স্ক রাজার জনহিতকর কাজের জন্য খুব প্ৰশংসা করে গেছেন।
কিংবদন্তী অনুযায়ী কর্ণগড়ের রাজারা খ্ৰীষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে বর্ধমানের নীলপুর থেকে মেদিনীপুরে আসেন। প্ৰথম যিনি আসেন তিনি হচ্ছেন রাজা লক্ষণসিংহ ( ১৫৬৮-১৬৬১ খ্রীস্টাব্দ ) । অষ্টাদশ শতাব্দীতে যারা কর্ণগড়ের রাজা ছিলেন তাঁরা হচ্ছেন রাজা রামসিংহ ( ১৬৯৩-১৭১১ ), রাজা যশোমন্ত সিংহ ( ১৭২২-১৭৪৮ ), রাজা অজিত সিংহ ( ১৭৪৯-১৭৫৬ ), ও রাণী শিরোমণি ( ১৭৫৬-১৮১২ )। রাজা রামসিংহের আমলেই মধ্যযুগের অন্যতম প্ৰধান কবি রামেশ্বর ভট্টাচাৰ্য, তাঁর জন্মস্থান যদুপুর থেকে শোভাসিংহের ভাই হিমতসিংহ কর্তৃক বিতারিত হয়ে, কর্ণগড়ে এসে বাস করেন । রাজা যশোমন্ত সিংহের আমলে কর্ণগড়ের দেয় রাজস্বের পরিমাণ ছিল ৪০,১২৬ টাকা ১২ আনা ও তাঁর সৈন্যসংখ্যা ছিল ১৫,০০০ । তৎকালীন জঙ্গলমহলের প্রায় সমস্ত রাজা তাঁর অধীনতা স্বীকার করত। রাণী শিরোমণির আমলে প্ৰথম চুয়াড় বিদ্রোহ ঘটে এবং যদিও যশোমন্ত সিংহের মাতুল নাড়াজোলের রাজা ত্ৰিলোচন খানের দ্বারা চুয়াড়রা পরাহত হয়, তা হলেও দ্বিতীয় চুয়াড় বিদ্রোহের সময় ইংরেজ সরকার রাণী শিরোমণিকে ওই বিদ্রোহের নেতা ভেবে ১৭৯৯ খ্রীস্টাব্দের ৬ এপ্রিল তাঁকে তাঁর অমাত্য চুনীলাল খান ও নীরু বকসীসহ বন্দী করে কলকাতায় নিয়ে আসে। কর্ণগড় ইংরেজ সৈন্যদল কর্তৃক লুষ্ঠিত হয়ে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। মুক্ত হবার পর রাণী শিরোমণি আর কর্ণগড়ে বাস করেন নি। জীবনের শেষ দিন পৰ্যন্ত মেদিনীপুরের আবাসগড়ে বাস করে এই নিৰ্ভীক রমণী ১৮১২ খ্রীস্টাব্দের ১৭ সেপটেম্বর তারিখে মারা যান। তারপর কর্ণগড় নাড়াজোল রাজবংশের অধীনে চলে যায়।