দুই
এই একশাল, পাঁচশালা ও দশশালা বন্দোবস্তের অন্তরালেই ঘটেছিল বাঙলার বৃহত্তম জমিদারীর বিলুপ্তি। এ জমিদারী ছিল রাণী ভবানীর। বাঙলা দেশের প্রায় আধখানা জুড়ে ছিল এ জমিদারীর বিস্তৃতি। কোম্পানির রেভেন্যু কালেকটর জেমস গ্রাণ্ট বলেছেন—“Rajesahy, the most unwieldy and extensive zemindary of Bengal or perhaps in India”. তাঁর এই বিশাল জমিদারী থেকে লব্ধ দেড় কোটি টাকা খাজনার অর্ধেক তিনি দিতেন নবাব সরকারে, আর বাকী অর্ধেক ব্যয় করতেন নানারকম জনহিতকর ও ধর্মীয় কাজে৷ অকাতরে অর্থ দান করে যেতেন। দীনদুঃখীর দুঃখমোচনে, ব্ৰাহ্মণপণ্ডিত প্ৰতিপালনে ও গুণীজনকে বৃত্তিদানে। তার দান খয়রাতি ও বৃত্তিদান বাঙলা দেশে প্ৰবচনে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। দুদিনের জন্য কখনও তিনি কিছু মজুত করেন নি। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পদক্ষেপে যখন প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা অনাদায় রইল, তখন তাঁর জমিদারীর একটার পর একটা মহাল ও পরগণা নীলামে উঠল। সুযোগসন্ধানীরা সেগুলো হস্তগত করবার জন্য বাপিয়ে পড়ল। ওয়ারেন হেষ্টিংস-এর কুকাৰ্যসমূহের যারা সহায়ক ছিল, তারাই এল এগিয়ে। রাণী ভবানীর জমিদারীর অংশসমূহ কিনে নিয়ে তারা এক একটা রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে বসল। কান্ত বাবু (যিনি হেষ্টিংসকে সাহায্য করেছিলেন চৈত সিং-এর সম্পত্তি লুণ্ঠন করতে এবং যেজন্য তার অংশবিশেষ তিনি পেয়েছিলেন) প্রতিষ্ঠা করলেন কাশিমবাজার রাজবংশ, গঙ্গগোবিন্দ সিংহ প্রতিষ্ঠা করলেন পাইকপাড়ার রাজবংশ, দুর্বৃত্ত দেবী সিংহ প্ৰতিষ্ঠা করলেন নসীপুরের রাজবংশ, এমন কি রাণী ভবানীর নিজ দেওয়ান দয়ারাম প্ৰতিষ্ঠা করলেন দিঘাপতিয়ার রাজবংশ। শেষ পর্যন্ত রাণী ভবানী এমন নিঃস্ব হয়ে গেলেন যে তাঁকে নির্ভর করতে হল কোম্পানি প্রদত্ত মাসিক এক হাজার টাকা বৃত্তির ওপর। তাঁর পারলৌকিক ক্রিয়াকর্মাদি করবার জন্য, তার স্বজনদের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল ইংরেজ কোম্পানির কাছে। আর তার ললাটে পরিয়ে দেওয়া হয়েছিল কালিমার টীকা। ১৭৯৯ খ্রীস্টাব্দের ১০ অকটোবর তারিখের (তাঁর মৃত্যুর তিন বছর আগে) এক সরকারী আদেশে বলা হল—’The former rank and situation of Maharanny Bowanny, her great age, and the distress to which both herself and the family have been reduced by the imprudence and misconduct of the Late Rajah of Rajesahy, are circumstances which give her claims to the consideration of Government. We therefore authorise to continue to her an allowance of Rs 1000 per month” অথচ তাঁর মৃত্যুর পর যখন তাঁর স্বজনবর্গ কোম্পানির দ্বারস্থ হল তখন কোম্পানীর রেভেন্যু বোর্ডের কতাঁরা বললেন—“(Board) have reasons to suppose that the Late . Ranny left ample funds by which the expenses of her funeral obsequies may be discharged”.
সন্ন্যাসী বিদ্রোহ
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে উৎকটভাবে প্ৰকাশ পেয়েছিল বাঙালীর বিদ্রোহী মানসিকতার। এই সময়ের সব চেয়ে বড় বিদ্রোহ হচ্ছে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ। এটা ঘটেছিল ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পটভূমিকায়। এই বিদ্রোহেই আমরা এক মহিলাকে নেতৃত্ব করতে দেখি। সেই মহিলা হচ্ছে দেবী চৌধুরাণী। বিদ্রোহের অন্ততম নেতা হচ্ছে ভবানী পাঠক। দুজনেই ঐতিহাসিক ব্যক্তি। ১৭৬৭ খ্রীস্টাব্দে ঢাকায় ইংরেজদের কাছে অভিযোগ আসে যে ভবানী পাঠক নামে এক ব্যক্তি তাদের নৌকা লুঠ করেছে। ইংরেজরা তাকে গ্রেপ্তার করবার জন্য সৈন্যসামন্ত পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু তাকে বন্দী করতে সক্ষম হয় না। ভবানী পাঠক ইংরেজদের দেশের শাসক বলে মানতে অস্বীকার করেন। দেবী চৌধুরাণীর সহায়তায় তিনি ইংরেজদের ওপর হামলা চালান। তার ফলে ময়মনসিংহ ও বগুড়া জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে শাসন ব্যবস্থা আচল হয়ে পড়ে। লেফটানেণ্ট ব্রেনের নেতৃত্বে পরিচালিত ইংরেজবাহিনী তাকে এক ভীষণ জলযুদ্ধে পরাজিত করে ও ভবানী পাঠক নিহত হন। উত্তরবঙ্গে এই বিদ্রোহের অন্যতম নেতা ছিল ফকির সম্প্রদায়ের মজনু শাহ। মজনুর কার্যকলাপে উত্তরবঙ্গ, ময়মনসিংহ ও ঢাকা জেলায় ইংরেজরা নাস্তানাবুদ হয়। সশস্ত্র বাহিনীর সাহায্যে তাকে দমন করা সম্ভবপর হয় না। ভবানী পাঠকের সন্ন্যাসীর দলের সঙ্গে মজনুর ফকির দলের একবার সজঘর্ষ হলেও, তারা সঙ্ঘবদ্ধ হয়েই নিজেদের কার্যকলাপ চালাত। তাদের কার্যকলাপের অন্তভুক্ত ছিল জমিদারদের কাছ থেকে কর আদায় করা, ইংরেজ সরকারের কোষাগার লুণ্ঠন করা ইত্যাদি। তবে জনসাধারণের ওপর তারা অত্যাচার বা বলপ্ৰয়োগ করত না। ১৭৮৬ খ্রীস্টাব্দের ২৯ ডিসেম্বর তারিখে মজনু পাঁচশত সৈন্যসহ বগুড়া জেলা থেকে পূর্বদিকে যাত্রা করবার পথে কালেশ্বর নামক জায়গায় ইংরেজবাহিনী কর্তৃক মারাত্মকভাবে আহত হয়। মজদুর দল বিহারের সীমান্তে পালিয়ে যায়। মাখনপুর নামক স্থানে মজনুর মৃত্যু হয়।
সন্ন্যাসীদের একজন মঠাধ্যক্ষ কৃপানাথের কথা আমরা আগেই বলেছি। বাইশ জন সহকারী সেনাপতিসহ তিনি দুপুরে ইংরেজবাহিনীদ্বারা ঘেরাও হলে, তিনি বিপদ বুঝে নেপাল ও ভুটানের দিকে পালিয়ে যান।