‘সন্ন্যাসী বিদ্রোহ’ নামে অভিহিত হলেও এতে ফকির সম্প্রদায়ও যোগ দিয়েছিল। সন্ন্যাসী বিদ্রোহে সক্রিয় অংশ গ্রহণের জন্য আরও যাঁরা প্ৰসিদ্ধ হয়ে। আছেন, তাঁদের মধ্যে আছেন ইমামবাড়ী শাহ, জয়রাম, জহুরী শাহ, দর্পদেব, বুদ্ধু শাহ, মজনু শাহ, মুসা শাহ, রামানন্দ গোঁসাই, ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরাণী ও সোভান আলি। (‘সন্ন্যাসী বিদ্রোহ’ অধ্যায় দ্রষ্টব্য)।
আট
কিন্তু ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের এই দুৰ্যোগের সময় ইংরেজরা ভারতে সাম্রাজ্য স্থাপনের স্বপ্নবিলাসে মত্ত হয়ে, দক্ষিণ ভারতের যুদ্ধসমূহে লিপ্ত হয়ে পড়ে। বস্তুত ১৭৭০ খ্রীস্টাব্দে বাঙলার আর্থিক সঙ্গতি নিয়দিকে এমনই স্তরে গিয়ে পৌঁছায় যে এক সমসাময়িক প্রতিবেদনে বলা হল-“the company seemed on the verge of ruin”। কিন্তু দেশের এই শোচনীয় অবস্থা হলেও, কোম্পানির কর্মচারীরা (তাদের ‘নবাব’ আখ্যা দেওয়া হত) স্বদেশে ফেরবার সময় প্রচুর অর্থ সঙ্গে করে নিয়ে যেত। এটা বিলাতের কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি এড়ালো না, এবং তারা বিলাতের শাসনতন্ত্রের সঙ্গে কোম্পানির সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণের জন্য পার্লামেণ্টে কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ আইন পাশ করলেন।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত
বাঙলার ভূমিরাজস্ব প্রশাসনের ইতিহাসে কর্নওয়ালিস প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবন্ত এক বিতর্কিত ব্যাপার। কোন পরিস্থিতিতে এর উদ্ভব ঘটেছিল, তা এখানে আলোচনা করার প্রয়োজন আছে। আমরা আগে উল্লেখ করেছি যে ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দে কোম্পানি বাঙলা, বিহার ও ওড়িশার দেওয়ানী লাভের পরবর্তী সাত বছর পূর্বতন ভূমিরাজস্ব প্রশাসনই বলবৎ রাখে। কোম্পানির তরফ থেকে কোম্পানির নায়েব দেওয়ানরূপে মহম্মদ রেজা খা ভূমিরাজস্ব পরিচালনা করতে থাকে। এর ফলে দ্বৈতশাসনের উদ্ভব হয়। দ্বৈতশাসনের ফলে দেশের মধ্যে স্বৈরতন্ত্র ও অরাজকতা প্ৰকাশ পায় ও কৃষি-ব্যবস্থার বিপৰ্যয় ঘটে। এরই পদাঙ্কে ১৭৭০ খ্ৰীস্টাব্দে আসে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। মন্বন্তরে বাঙলার অর্ধেক কৃষক মারা যায়. ও আবাদী জমির অর্ধেকাংশ অনাবাদী হয়ে পড়ে। কিন্তু রেজা খা খাজনার দাবী ক্রমশই বাড়াতে থাকে। এর ফলে দেশের মধ্যে অসন্তোষ প্ৰকাশ পায়। এদিকে রাজস্ব সম্পর্কে কোম্পানির প্রত্যাশাও পূরণ হয় না। রাজস্বের টাকা আত্মসাৎ করবার অভিযোগও রেজা খাঁর বিরুদ্ধে আসে। ১৭৭২ খ্ৰীস্টাব্দে ওয়ারেন হেষ্টিংস যখন গভর্নর হয়ে আসেন, তখন তাকে দ্বৈতশাসনের অবসান ঘটাবার নির্দেশ দেওয়া হয়। ওয়ারেন হেষ্টিংস কোম্পানির সারকিট কমিটির তত্ত্বাবধানে জমিদারী মহলগুলিকে নিলামে চড়িয়ে দিয়ে, ইজারাদারদের সঙ্গে পাঁচশালা বন্দোবস্ত করেন। যারা ইজাৱা নেয়, তাদের অধিকাংশই কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের বেনিয়ান। এদের মধ্যে ছিলেন হেষ্টিংস-এর নিজস্ব বেনিয়ান কাস্তবাবু, কিন্তু ইজারাদারদের অধিকাংশই নিজেদের প্রতিশ্রুতি পালন করতে পারে না। কোম্পানির সমস্ত প্ৰত্যাশাই ব্যৰ্থ হয়। এই ব্যর্থতার পর ১৭৭৭ খ্ৰীস্টাব্দে কোম্পানি জমিদারদের সঙ্গে বাৎসরিক বন্দোবস্ত করে।
পাঁচশালা পরিকল্পনার সময় থেকেই অনেকে জমিদারদের সঙ্গে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কথা তুলেছিল। তাদের মধ্যে ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্নেল আলেকজাণ্ডার ডাউ, স্কটল্যাণ্ডের প্রখ্যাত কৃষিবিন্যাবিদ হেনরী পাটুলো ও কোম্পানির কয়েকজন কর্মচারী যথা মিডলটন, ডেকার্স, ডুকারেল, রাউস প্ৰভৃতি। কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সবচেয়ে বড় প্ৰস্তাবক ছিলেন ফিলিপ ফ্রান্সিস। তিনি বললেন, ভারতের বিধিবিধান অনুযায়ী জমিদাররাই জমির মালিক। অর্থনৈতিক মহলের ফিজিওক্রাটদের ভাবধারায় তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। সেই বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে তিনি বললেন, যে কৃষিই সামাজিক ধন্যবৃদ্ধির একমাত্র সুত্র এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দ্বারা জমিদারদের ভূমির মালিকানা স্বত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করলে, তাদের উদ্যোগে কৃষির পুনরভু্যুদয় ঘটবে এবং তাতে কোম্পানির আর্থিক সমস্যার সমাধান হবে। ফ্রান্সিসের লেখার প্ৰভাবেই ব্রিটিশ পার্লামেণ্ট কর্তৃক ১৭৮৪ খ্ৰীস্টাব্দে বিধিবদ্ধ পিট-এর ‘ভারত আইন’-এ রাজা, জমিদার, তালুকদার ও অনান্য ভূস্বামীদের সঙ্গে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই নির্দেশ অনুযায়ীই ১৭৮৯-৯০ খ্রীস্টাব্দে লর্ড কর্নওয়ালিস বাঙলা, বিহার ও ওড়িশার জমিদারদের সঙ্গে দশশালা বন্দোবস্ত করে। (দশশালা বন্দোবস্তের সময় আলোহাবাদের রাজা ও জমিদারদের সঙ্গে বন্দোবন্ত করবার জন্য দেওয়ানীর ভার পেয়ে নোয়াখালির জগমোহন বিশ্বাস অ্যালাহাবাদে যান। তিনি ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানিকে এককালীন দুই লক্ষ টাকা দিয়ে তীর্থযাত্রীদের ওপর থেকে পূর্বপ্রচলিত তীৰ্থকর চিরতরে রহিত করেন)। ১৭৯৩ খ্রীস্টাব্দে এক রেগুলেশন দ্বারা এটাই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে রূপান্তরিত হয়। এর সবচের বড় সমর্থক ছিলেন বিহারের কালেকটর টমাস লা। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দ্বারা জমিদারেরা ও স্বাধীন তালুকদারের জমির মালিক ঘোষিত হয়। এর দ্বারা বিভিন্ন শ্রেণীর জমিদারদের (যথা কুচবিহার ও ত্রিপুরার রাজাদের মত মোঘল যুগের করদ নৃপতি, রাজশাহী, বর্ধমান ও দিনাজপুরের রাজাদের মত পুৱাতন প্ৰতিষ্ঠিত রাজবংশ, মোঘল সম্রাটগণের সময় থেকে বংশানুক্রমিক-ভাবে রাজস্ব-সংগ্ৰাহকের পদভোগী পরিবারসমূহ ও কোম্পানি কর্তৃক দেওয়ানী লাভের পর ভূমিরাজস্ব আদায়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীরা) একই শ্রেণীভূক্ত করে তাদের সকলকেই জমির মালিক বলে স্বীকার করে নেওয়া হয়। ১৭৮৯ খ্রীস্টাব্দের এক মিনিট-এ কর্নওয়ালিস মত প্ৰকাশ করেন-“আমার সুদৃঢ় মত এই যে ভূমিতে জমিদারগণের মালিকানা স্বত্ব দেওয়া জনহিতার্থে আবশ্যক।” বাঙলার জমিদারদের জমার পরিমাণ ২৬৮ লক্ষ সিককা টাকা নির্দিষ্ট হয়। কোম্পানির আর্থিক প্ৰয়োজন বিচার করেই জমার পরিমাণ নির্দিষ্ট হয়। যাতে নিয়মিতভাবে ভূমিরাজস্ব দেওয়া হয়, সেই উদ্দেশ্যে ‘সূর্যাস্ত আইন’ জারি করা হয়। এই আইন অনুযায়ী কিস্তি দেওয়ার শেষ দিন সন্ধ্যার পূর্বে কোন মহালের টাকা জমা না পড়লে, সেই মহালকে নিলামে চড়ানো হত; অনাদায়, অনাবৃষ্টি, দুৰ্ভিক্ষ প্রভৃতি কোন আছিলাই চলত না। কর্নওয়ালিসের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, সুনিশ্চিত আদায় ও কৃষির বিস্তার। কিন্তু কর্নওয়ালিসের উদ্দেশ্য ও প্রত্যাশা কিছুই সিদ্ধ হয়নি। উপরন্তু জমিদাররা সম্পূর্ণ নির্জীব হয়ে দাঁড়ায় ও প্রজাপীড়ন ক্রমশঃ ঊর্ধ্বগতি লাভ করে।