পাঁচ
বস্তুতঃ বকসারের যুদ্ধের পর বাঙলার নবাব মাত্র সাক্ষীগোপালে পরিণত হয়। প্রকৃত ক্ষমতা কোম্পানির কর্মচারীদের হাতে চলে যায়। তাদের অত্যাচার, স্বার্থাদ্ধতা ও জুলুম দেশের মধ্যে এক নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। অবহিত হয়ে কোম্পানির বিলাতে অবস্থিত কোর্ট অভ ডিরেকটরসরা ক্লাইভকে পুনরায় বাঙলার গভর্নর করে পাঠান (১৭৬৫)। এখানে পৌঁছে ক্লাইভ যে পরিস্থিতি দেখেন, তা তাঁর নিজের ভাষায়—“A presidency divided, headstrong and licentious, a government without subordination, discipline or public spirit. . . . amidst a general stagnation of useful industry and of licensed commerce, individuals were accumulating immense riches, which they had ravished from the insulted prince and his helpless people who groaned under the united pressure of discontent, poverty and oppression. . . . . . Such a scene of anarchy, confusion, bribery, corruption and extortion was never seen or heard of in any country but Bengal; nor such and so many fortunes acquired in so unjust and rapacious a manner. The three provinces of Bengal, Bihar and Orissa, producing a clear revenue of £3,000,000 sterling had been under the absolute management of the company’s servants, ever since Mirjafar’s restoration to the subaship; and they exacted and levied contributions from every man of
power and consequence, from the Nawab down to the lowest zemindar.” (Quoted in A. K. Sur’s “History & Culture of Bengai’, 1963, page 175)
এই শোচনীয় পরিস্থিতির সংশোধনে ক্লাইণ্ড জানিয়োগ করেন। তিনি কোম্পানির কর্মচারীদর দিয়ে চুক্তিসূত্র স্বাক্ষর কবিয়ে নেন যে তারা ব্যক্তিগতভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যে লিপ্ত থাকতে পারবে না ও কোনরূপ উপঢৌকন গ্ৰহণ করবে না। এই সংস্কারের জন্য ক্লাইভ এদেশবাসী ইংরেজদের কাছ থেকে ঘৃণাব্যঞ্জক নিন্দা অর্জন করেন। কিন্তু তাদের সন্তুষ্ট করবার জন্য তিনি এদেশের লোকরা যে সকল সামগ্ৰী ব্যবহার করত, যেমন–লবণ, আফিম, পান ইত্যাদির আভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের একচেটিয়া অধিকার তাদের দেন। যখন বিলাতের কোর্ট অভ ডিরেকটরসর আভ্যন্তরীণ বাণিজ্য সম্পর্কে কোম্পানির কর্মচারীদের এরূপ একচেটিয়া অধিকার বিতরণ সম্বন্ধে বিরূপ মনোভাব প্ৰকাশ করে, তখন তিনি তার প্রতিবাদও জানান।
ক্লাইভ সৈন্যবিভাগেরও সংস্কার করেন। সৈন্যবিভাগে তিনি যুগল-বাট্টা প্রণালী রহিত করেন। সৈন্যবাহিনীর গঠনেরও তিনি পুনর্বিন্যাস করেন। তিনি সৈন্যবিভাগকে তিনটি ব্রিগেডে বিভক্ত করেন। প্ৰত্যেক ব্রিগেড়ে থাকে একদল ইংরেজ পদাতিক, একদল গোলন্দাজ, ছয়দল এদেশী সিপাহী ও একদল এদেশী অশ্বারোহী সৈন্য। মারাঠাদের আক্রমণ প্ৰতিহত করবার জন্য এই তিনটি ব্রিগেডকে তিনি যথাক্রমে মুঙ্গের, বঁকিপুর ও আলাহাবাদে অবস্থিত করান। অযোধ্যার নবাব ও সম্রাট শাহ আলমের সঙ্গে তিনি এক বন্দোবস্ত করেন। এই বন্দোবস্ত অনুযায়ী ২৬ লক্ষ টাকা বার্ষিক বৃত্তি প্ৰদানের পরিবর্তে তিনি সম্রাটের কাছ থেকে বাঙলা, বিহার ও ওড়িশার দেওয়ানী (রাজস্ব শাসন) সংগ্ৰহ করেন। দেওয়ানী লাভের ফলে এখন থেকে ইংরেজরাই এই তিন প্রদেশের রাজস্ব আদায় করবে, সম্রাট মাত্র একটা বার্ষিক বৃত্তি পাবেন। এর ফলে ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দের পর থেকে নিজামত (যা ইংরেজরা নবাব নজম-উদ-দৌল্লার কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিল) ও দেওয়ানী, এ দুই-ই ইংরেজদের হাতে এসে পড়ে, এবং তারাই এদেশের প্রকৃত শাসক হয়ে দাঁড়ায়।
দেওয়ানী লাভের পর আরও সাত বছর পর্যন্ত আগেকার ভূমিরাজস্ব প্ৰশাসনই বলবৎ থাকে। (পরে দেখুন) এবং কোম্পানির নায়েব-দেওয়ানরূপে মহম্মদ রেজা খা বাঙলার ভূমিরাজস্বের পরিচালনা করতে থাকেন। এর ফলে দ্বৈতশাসনের প্রবর্তন হয় (নীচে দেখুন)। কিন্তু অত্যধিক রাজস্ব দাবী, বাৎসরিক ইজারা দান ইত্যাদির ফলে দেশের মধ্যে এক স্বৈরতান্ত্রিক অরাজকতার আবির্ভাব ঘটে।
ছয়
দেওয়ানী পাবার পর ইংরেজরাই যে প্রকৃতপক্ষে ভারতের অধীশ্বর হলেন, এটা অন্যান্য ইওরোপীয় জাতিগণের কাছে গোপন রাখবার জন্য, ক্লাইভ আনুষ্ঠানিকভাবে দেশশাসনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব গ্ৰহণ করেন নি। নবাবই দেশশাসন করছেন, এটা বাহত দেখাবার জন্যই তিনি নবাবের নিযুক্ত দুই পূর্বতন প্ৰতিভুকে-মুরশিদাবাদে মহম্মদ রেজা খান ও পাটনায় রাজা সিতাব রায়কেতাদের রাজস্ব আদায়ের কাজে বহাল রাখেন। তারাই রাজস্ব আদায় করবে, মাত্র রাজস্ব আদায়ের জন্য একটা নির্দিষ্ট টাকা পাবে, এরূপ স্থিরীকৃত হয়। এর ফলে দেশের মধ্যে দ্বৈতশাসনের প্রবর্তন হয়। কিন্তু দ্বৈতশাসন হয়ে দাঁড়ায় প্ৰজাপীড়ন ও নির্মম অত্যাচারের এক যন্ত্র। এ সম্পর্কে দেবীসিংহ-এর অমানুষিক অত্যাচার বিশেষভাবে উল্লেখনীয়। দেবীসিংহ ছিলেন পাঞ্জাবের লোক। ১৭৫৬ খ্রীস্টাব্দ নাগাদ তিনি বাঙলা দেশে আসেন। মহম্মদ রেজা খাঁ তাকে পূৰ্ণিয়ার ইজারাদার করেন। অর্থ সংগ্রহের জন্য দেবীসিংহ কোন রকম অত্যাচার, অবিচার ও অন্যায় করতে দ্বিধা করত না, তার অত্যাচার ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের অন্যতম কারণ। ১৭৮১ খ্রীস্টাব্দে সে বেনামীতে রঙপুর, দিনাজপুর ও এন্দরাকপুর ইজারা নেয়। ইটাকুমারীর রাজা শিবচন্দ্র রায়ের ওপর সে অমানুষিক অত্যাচার করে। তাঁর শোষণের ফলে ১৭৮৩ খ্রীস্টাব্দে রঙপুরের জনগণ বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এই বিদ্রোহের নেতা ছিল নুরুলুদ্দিন। তিনি নিজেকে ‘নবাব’ ঘোষণা করেন ও দয়াশীল নামে এক প্ৰবীণ কৃষককে তাঁর দেওয়ান নিযুক্ত করে দেবীসিংহকে কর না দেবার আদেশ জারি করেন। তাঁর অনুচররা দেবীসিংহ ও ইংরেজদের ঘাঁটি মোগলহাট বন্দরের ওপর আক্রমণ চালায়। এক ভীষণ যুদ্ধ হয়। ওই যুদ্ধে নুরুলুদ্দিন জখম ও বন্দী হন ও কয়েক দিন পরে মারা যান।