মীরকাশিমের মত সুদক্ষ ও সুযোগ্য নবাবের পক্ষে তার প্রজাবৃন্দের ওপর কোম্পানির কর্মচারীদের অত্যাচার ও লোভাতুর আচরণ সহ করা অসম্ভব ছিল। কোম্পানির কর্মচারীরা এ সময় বিনাতকে বাণিজ্য করত। মালি কেনাবেচা সম্পর্কে লোকদের ওপর অত্যাচার ও দুর্দান্ত জুলুম করত। এই অত্যাচায়ের বিরুদ্ধে যেখানে নবাবের কর্মচারীরা হস্তক্ষেপ করত, তা তারা পদদলিত করত। আভ্যন্তরীন বাণিজ্যে ইংরেজ কর্মচারীদের এরূপ আচরণ নিবারণ করতে না পেরে, মীরকাশিম নিজ প্ৰজাবৃন্দকে ইংরেজদের সঙ্গে সমান পর্যায়ে ফেলবার জন্য ১৭৬২ খ্রিস্টাব্দে রাজ্যের সর্বত্র বাণিজ্য শুষ্ক রহিত করেন। ইংরেজরা বাণিজ্য শুষ্ক পুনরায় ন্যন্ত করবার দাবী জানায়। নবাব সে দাবী গ্ৰাহ করতে অস্বীকৃত হন। এই সকল বিবাদ-বিসংবাদের ফলে নবাবের সহিত ইংরেজদের শত্রুত। ঘটে। ইংরেজরা যখন নৌপথে পাটনায় অন্ত্রশস্ত্র নিয়ে যাচ্ছিল, নবাবের কর্মচারীরা তখন তা আটক করে। এর ফলে কোম্পানির পাটনা কুঠির অধিকর্তা এলিস নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং পাটনা দখল করে নেয়। মীরকাশিমের সৈন্যবাহিনী শীঘ্রই পাটনা পুনরুদ্ধার করে ও এলিস সমেত অন্যান্য ইংরেজদের বন্দী করে। কিন্তু গিরিয়া, সুতি ও উদয়নালার যুদ্ধে (১৭৬৩) নবাববাহিনী পরাজিত হয়। ক্রুদ্ধ হয়ে নবাব ইংরেজ বন্দীদের হত্যা করে। (ওয়ালটার রাইনহার্ট ওরফে সম্বর’ নামে নবাবের একজন জার্মান কর্মচারী নবাবের আদেশে এই কাজ করে)। উদয়নালার যুদ্ধের পূর্বে নবাব রাজা রামনারায়ণকেও হত্যা করেন এবং রাজা রাজবল্লভকে মুঙ্গেরে গঙ্গায় ডুবিয়ে মারেন। পাটনার পথে নবাব জগৎশেঠ, মহাতপরায় ও তাঁর ভ্রাতা স্বরূপচাঁদ। এবং রাজা উনিদরায়কেও খতম করেন।
ইংরেজরা যখন পাটনা পুনঃদখল করে, মীরকাশিম তখন পালিয়ে গিয়ে অযোধ্যার নবাৰ শুজাউদ্দৌলার কাছে আশ্ৰয় নেয়। অযোধ্যার নবাব, সম্রাট শাহ আলম ও কয়েকজন দুঃসাহসিক ফরাসীদের সঙ্গে মিলিত হয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান করে। অযোধ্যা ও বিহারের উপপ্ৰান্তে কয়েকটি অমীমাংসিত সংঘর্ষের পর, বকসারের যুদ্ধে (১৭৬৪) ইংরেজদের হাতে মীরকাশিমের যুক্তবাহিনী পরাজিত হয়। মীরকাশিম দিল্লীতে পালিয়ে যায়, এবং দিল্লীর নিকট পাশোয়ান গ্রামে দুরবস্থার মধ্যে উদারী রোগে তার মৃত্যু ঘটে।
চার
ইংরেজরা মীরজাফরকে আবায় বাঙলার মসনদে বসায় (১৭৬৩)। এই সময় ইংরেজরা মীরজাফরের সঙ্গে এক নূতন সন্ধি করে। এই সন্ধি অনুযায়ী মীরজাফর বর্ধমান, 4 মেদিনীপুর ও চট্টগ্রাম জেলা ইংরেজদের দিয়ে দেয়। তাছাড়া ইংরেজর লবণ ব্যতীত বাঙলাদেশে আর সব পণ্যের বাণিজ্য বিনাশুকে করবার অনুমতি পায়। মীরজাফর ইংরেজদের ত্ৰিশ লক্ষ টাকা দিতে রাজি হয় ও মুরশিদাবাদে ইংরেজদের একজন আবাসিক প্রতিনিধি রাখবার অনুমতি দেয়।
১৭৬৫ খ্রীস্টাব্দে কুষ্ঠরোগে মীরজাফরের মৃত্যুর পর, ইংরেজরা মীরজাফরের পুত্র নজম-উদ-দৌল্লাকে নবাবের মসনদে বসায়। নবাব হবার পর নজম-উদ-দৌলা ইংরেজদের সঙ্গে এক চুক্তি করে। ওই চুক্তির বলে নবাব ইংরেজদের হাতে নিজামত (রাষ্ট্রশাসন, সৈন্যবাহিনী, প্রতিরক্ষণ, পুলিশ ইত্যাদি) তুলে দেয়, এবং নিজের সম্মান ও রাজস্ব আদায়ের জন্য যে স্বল্পসংখ্যক সৈন্যের প্রয়োজন, তা নিজ হাতে রাখেন। ইংরেজদের অনুমতি ব্যতীত নিজ কৰ্মচারী নিয়োগের অধিকারও তিনি হারান। ইংরেজদের বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত থাকে, এবং নূতন নবাবের কাছ থেকে তারা ১৫ লক্ষ টাকা উপঢৌকন পায়। উপঢৌকনটা আর কিছুই নয়, ঘুষ মাত্র। এখানে এই উপঢৌকন সম্বন্ধে বিশদভাবে কিছু বলা দরকার। সিরাজউদ্দৌলার বদলে মীরজাফরকে নবাব করবার সময় ক্লাইভ ঘুষ পেয়েছিল ২১১,৫০০ পাউণ্ড, ওয়াটস। ১১৭,০০০ পাউণ্ড, কিলপ্যাট্রিক ৬০,৭৫০ পাউণ্ড, ওয়ালিশ ৫৬,২৫০ পাউণ্ড, ড়েক ৩১,৫০০ পাউণ্ড, ম্যানিংহাম ও বেশীর প্রত্যেকে ২৭,০০০ পাউণ্ড, ফ্ৰাফটন। ২২,৫০০ পাউণ্ড, বোডোম, ফ্রাঙ্কল্যাণ্ড, ম্যাকেট, কোলেট, অমিয়ট ও মেজর গ্ৰাণ্ট প্ৰত্যেকে ১১,০০০ পাউণ্ড করে। লুশিংটন পেয়েছিল ৫,৬২৫ পাউণ্ড। আর মীরজাফরের বদলে মীরকাশিমকে নবাব করবার সময় ভ্যানসিটাট নিয়েছিল ৫৮,৩৩৩ পাউণ্ড, হলওয়েল ৩০,৯৩৭ পাউণ্ড, ম্যাকগুইয়ার ২৯,৩৭৫ পাউণ্ড, সামনার ২৮,০০০ পাউণ্ড, কেল্যান্ড ২২,৯১৬ পাউণ্ড এবং স্মিথ ও ইয়র্ক প্ৰত্যেকে ১৫,৩৫৪ পাউণ্ড। আর নজম-উদ-দৌল্লাকে নবাবের গদিতে বসাবার সময় ক্লাইভ দক্ষিণা পেয়েছিল ৫৮,৩৩৩ পাউণ্ড, কার্নাক ৩২,৬৬৬ পাউণ্ড, জনস্টোন ২৭,৬৫০ পাউণ্ড, স্পেনসার ২৩,৩৩৩ পাউণ্ড, সিনিয়র ২০,১১৫ পাউণ্ড, মিডলটন ১৪,২৯১ পাউণ্ড, লেসেস্টার ১৩,১২৫ পাউণ্ড, প্লেডেল, বার্ডেট ও গ্ৰে প্ৰত্যেকে ১১,৬৬৭ পাউণ্ড করে, ও জি, জনস্টোন ৫,৮৩৩ পাউণ্ড। এছাড়া মেজর মুনরো ও তার সহকারীরা সকলে মিলে ১৬,০০০ পাউণ্ড পেয়েছিল। এ তো গেল নবাব অদল-বদলের সময়ের প্রাপ্তিযোগ। এ ছাড়া, জমিদারী বিলি-ব্যবস্থার সময়ও তারা যথেষ্ট ঘুষ নিত। এক কথায়, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে ইংরেজদের ঘুষ নেবার কোন সীমা ছিল না। অবশ্য, মাত্র সাহেবরাই যে ঘুষ নিত তা নয়। তাদের এদেশী সহকারী দেওয়ানরাও ঘুষ নিত। তাদের এদেশী সহকারীরা এইভাবে লক্ষ লক্ষ টাকা উপায় করে কলকাতায় সভ্রান্ত পরিবারসমূহের পত্তন করে গেছে।