ইংরেজরা নবাবের কাছ থেকে অনেক কিছু সুযোগ-সুবিধা সংগ্ৰহ করে। তারা ২৪ পরগণার জমিদারী স্বত্ব পায়, বিনাশুল্কে ব্যবসা করবার অধিকার লাভ করে, এবং বাঙলার অভ্যন্তরস্থ অঞ্চলে কুঠি নির্মাণের অধিকার পায় কলকাতায়। তারা একটা টাকশালও স্থাপন করে, যেখানে ১৭৫৭ খ্রীস্টাব্দের ১৯ আগস্ট তারিখ থেকে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির নিজ নামে মুদ্রা নির্মাণ হতে থাকে।
নবাব ইংরেজদের হাতে খেলার পুতুল হয়ে দাঁড়ায়। এই সময় নবাব বুদ্ধিহীনের মত দুর্লভরাম, রামনারায়ণ সিং প্রভৃতির ন্যায় বিচক্ষণ হিন্দু কর্মচারীদের বরখাস্ত করে। এর ফলে রাজ্যের সর্বত্র অসন্তোষ ও বিদ্বেষ প্রকাশ পায়। পাটনা, পূর্ণিয়া, মেদিনীপুর, ঢাকা প্ৰভৃতি স্থানে গণবিদ্রোহ দেখা দেয়। নবাব ক্লাইভকে তা দমন করতে বলে। নবাবের এই উপকার সাধনের জন্য ইংরেজরা বিহারের সোরা বাণিজ্যের একচেটিয়া অধিকার পায়।
১৭৫৯ খ্রীষ্টাব্দে দিল্লীর বাদশাহ দ্বিতীয় শাহ আলম বাঙলা আক্রমণ করবার উদ্দেশ্যে বিহারের সীমান্তে এসে আবির্ভূত হন। নবাব তখন ইংরেজদের কাছ থেকে আবার সাহায্য প্রার্থনা করে। এর বিনিময়ে ইংরেজরা কলকাতার পার্শ্ববর্তী সমস্ত অঞ্চলের খাজনা আদায়ের অধিকার পায়।
ইংরেজদের এ রকম উত্তরোত্তর শক্তি বৃদ্ধি দেখে ওলন্দাজরা ঈৰ্ষাপরায়ণ হয়ে ওঠে। তারা নিজেদের নিরাপত্তা, সম্বন্ধে ভীতিগ্ৰস্ত হয়ে ১৭৫৯ খ্রীস্টাব্দে ইংরেজদের বিরুদ্ধে এক অভিযান চালায়। এ সময় নবাবও ইংরেজদের ক্ৰমবধমান প্ৰভাবে অসন্তুষ্ট হয়ে ওলন্দাজদের উৎসাহিত করে। নবাবের প্রকৃত মনোভাব যাই থাকুক না কেন, চুঁচুড়া ও চন্দ্রনগরের অন্তবর্তী বেদার নামক স্থানের যুদ্ধে, নবাব ইংরেজদেরই পক্ষ অবলম্বন করে। বেদারার যুদ্ধে ওলন্দাজরা সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয়, এবং ইংরেজদের, ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু, এই পরাজয়ের পরমুহুর্ভেই মীরজাফরের পুত্র মীরণ ওলন্দাজদের শান্তি দেবায় জন্য চুঁচুড়ায় এসে হাজির হয়। কিন্তু ইংরেজদের মধ্যস্থতায় ওলন্দাজরা মীরণের রোষের হাত থেকে রক্ষা পায়, তবে তাদের প্রতিশ্রুতি দিতে হয় যে তারা ভবিষ্যতে আর যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হবে না, সৈন্যসামন্ত সংগ্ৰহ করবে না, এবং নিজ অঞ্চলে আর কোনরূপ দুৰ্গ নির্মাণ করবে না। বস্তুতঃ এর পর থেকেই বাঙলা দেশে ওলন্দাজদের অস্তিত্ব সম্পূর্ণভাবে ইংরেজদের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে। ১৭৯৫ খ্রীস্টাব্দে ওলন্দাজদের ঘাটি বরানগর ইংরেজদের হাতে চলে আসে। চুঁচুড়া আসে ১৮২৪ খীস্টাব্দে।
দুই
১৭৬০ খ্রীষ্টাব্দে ক্লাইভ বিলাত চলে যান। বাঙলায় কোম্পানির পরিচালনার ভার হলওয়েলের ওপর ন্যন্ত হয়। এই সময় কোম্পানির বোর্ড অভ ডিরেকটরসায়া লিখে পাঠান যে কোম্পানির সাহায্যার্থে তারা বিলাত থেকে কোন অর্থ পাঠাবেন। না, কেননা কোম্পানি বাঙলায় যথেষ্ট অর্থ অর্জন করছে। অর্থের অভাবে হলওয়েল নবাবের ওপর চাপ দিয়ে ১৭৫৭ খ্ৰীস্টাব্দের চুক্তি ‘অনুযায়ী কিস্তির টাকা চেয়ে পাঠান। কিন্তু নবাবের খাজাঞ্চীখানা তখন শূন্য। নিজ সৈন্যদেরই তখন তিনি মাহিনী দিতে পারছিলেন না এবং তারা বিদ্রোহ করবার জন্য প্ৰস্তুত হচ্ছিল। নবাবের তখন না আছে অর্থ, না আছে সামর্থ্য। নিজ প্রজাদের তখন তিনি কোম্পানির কর্মচারিগণ কর্তৃক ‘দস্তক’ আদায়ের জুলুম থেকে রক্ষা করতে পারছিলেন না। তাছাড়া, কোম্পানির কর্মচারীদের জুলুমের ফলে দেশীয় বণিকরাও ক্ষতিগ্ৰন্ত হছিল। একজন ইংরেজ লেখক বলে গেছেন।–Bengal by this time had fallen into a state of anarchy and misery’
এই পরিস্থিতির জন্য হলওয়েল নবাবকেই দায়ী করলেন, এবং চক্রান্ত করে নবাবকে গদিচ্যুত করে ১৭৬০ খ্ৰীস্টাব্দে তার জামাতা মীরকাশিমকে গদিতে বসালেন।
তিন
চরিত্র এবং দক্ষতায় সীরকাশিম তীর শ্বশুর মীরজাফরের একেবারে বিণীত ছিলেন। বস্তুতঃ তিনি দৃঢ় চৰিত্র ও অসাধারণ শাসনক্ষ্মতায় অধিকারী ছিলেন। ইংরেজদের অনুসৃত সুশৃঙ্খল কায়দায় নিজ সৈন্যবাহিনীকে পুনর্বিন্যাস করে তিনি নিজেকে শক্তিমান করেন। তারপর তিনি রাজকোষের উন্নতির – দিকে মন দেন। অবাধ্য জমিদারদের তিনি দমন করেন, এবং প্ৰবীণ কর্মচারীরা খাজিরি-জমা নামে যে রাজস্ব লুকিয়ে রাখত, তা প্ৰত্যাৰ্পণ করতে বাধ্য করেন। রাজকোষ বৰ্ধিত করে, তিনি কোম্পানির নিকট নবাবের যে বকেয়া ঋণ ছিল তা পরিশোধ করেন। সৈন্যবাহিনীর বকেয়া মাহিনাও তিনি প্ৰদান করেন। রাজ্যের সর্বত্র তিনি তার প্রভাব বিস্তার করেন। কর্মপটুতায় তিনি মুরশিদকুলি এখানের সমকক্ষ ছিলেন। তার সম্বন্ধে গোলাম হুসেন সলীম তার ১৭৮৮ খ্রীষ্টাব্দে রচিত ‘রিয়াজ-উস্-সালাতীন’ গ্রন্থে লিখেছেন—“In unravelling the intricacies of affairs of government and especially the knotty mystefies of finance, in examining and determining private differences, in establishing regular payment for his troops and for his household; in honouring and rewarding men of merit and men of learning, in conducting his expenditure exactly between the extremities of parsimony and prodigality; and in knowing intuitively where he must spend and where with moderationin all these qualifications he was an incomparable man indeed and the most extraordinary prince of his age” (Ghulam Husain Salim, Riyat-us-salatin translated by Abdus Salam, quoted in A. K. Sur’s “History and Culture of Bengal”, 1963 page 173)। তাঁর গুণের জন্য দিল্লীর বাদশাহ তাঁকে ‘আলীজাহ নশীর-উল-মুলক এমতাজদ্দৌলা কাশিম আলি খান নশরৎ জঙ্গ’ উপাধি দিয়েছিলেন।