মন্বন্তয়ে সবচেয়ে বেশী বিপৰ্যন্ত হয়েছিল জমিদাররা। কেননা এই সময় বাঙলার নায়েব দেওয়ান মহম্মদ রেজা খাঁ শতকরা দশটাকা হারে রাজস্ব বাড়িয়ে দিয়েছিল। তার ফলে বাঙলায় কান্নার কোলাহল পড়ে গিয়েছিল। একে তো মন্বন্তরের বছর। লোক না খেতে পেয়েই মরে যাচ্ছে। জমিদারকে তারা খাজনা দিবে কি করে? জমিদারও প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা না পেলে সরকারে রাজস্ব জমা দেবে কেমন করে? জমিদারদের ওপরই গিয়ে পড়ল চূড়ান্ত নিৰ্যাতন। তাদের উলঙ্গ করে বিছুটির চাবুক মেরে সর্বাঙ্গ রক্তাক্ত করে দেওয়া হল। তারপর অচৈতন্য অবস্থায় তাদের অন্ধকার কারাগারে নিক্ষেপ করা হল। শুধু তাই নয়। স্বামীর সামনে স্ত্রীকে ও পিতার সামনে কন্যাকে বিবস্ত্রা করে শুরু হল নিষ্ঠুর নির্যাতন। বর্ধমানের মহারাজা, নদীয়ার মহারাজা, নাটোরের রানী ভবানী, বীরভূম ও বিষ্ণুপুরের রাজাদের যে কি দুৰ্গতি হয়েছিল, সে সব হাণ্টার তাঁর ‘অ্যানালস অভ রুরাল বেঙ্গল’ বইয়ে লিখে গেছেন। এর প্রতিক্রিয়ায় জনগণ যে ক্ষিপ্ত হয়ে একটা সমাজ বিপ্লব ঘটবে তা বলাই বাহুল্য মাত্র। হাণ্টার বলেছেন—‘অরাজকতা প্ৰসব করে অরাজকতা এবং বাঙলার দুর্দশাগ্ৰস্ত কৃষক সম্প্রদায় আগামী শীতকালের খাদ্যফসল থেকে বঞ্চিত হয়ে ও দস্যুদ্বারা বিধ্বস্ত হয়ে, নিজেরাই দস্যুতে পরিণত হল। যাঁরা প্ৰতিবেশীর নিকট আদর্শ চরিত্রের লোক বলে পরিগণিত হত, সে সকল কৃষক ও পেটের দায়ে ডাকাতে পরিণত হল এবং সন্ন্যাসীর দল গঠন করল। তাদের দমন করবার জন্য যখন ইংরেজ কালেকটররা সামরিকবাহিনী পাঠাল, তখন এক এক দলে পঞ্চাশ হাজার সন্ন্যাসী, সিপাইদের নস্যাৎ করে দিল। মন্বন্তর এবং তার পরবর্তী কয়েক বছর এরূপই চলল। পরে অবশ্য ইংরেজদের হাতে তারা পরাভূত হল।‘ এটা সবই হাণ্টারের কাহিনী। এই কাহিনীকেই পল্লবিত করে বঙ্কিম তার উপন্যাসকে ‘আনন্দমঠ’-এর রূপ দিয়েছিলেন।
মন্বন্তর মাত্ৰ এক বছরেরই ঘটনা। কিন্তু তার জের চলেছিল বেশ কয়েক বছর। মন্বন্তরের পরের দু’বছরে বাঙলা আবার শস্যশ্যামলা হয়ে উঠেছিল। লোক “পেট ভরে খেতে পেল বটে, কিন্তু লোকের আর্থিক দুৰ্গতি চরমে গিয়ে পৌঁছাল।। অত্যধিক শস্য ফলনের ফলে কৃষি পণ্যের দাম এমন নিয়ন্তরে গিয়ে পৌঁছাল যে হাণ্টার বলেছেন—‘হাটে শস্য নিয়ে গেলে বেচে গাড়ীভাড়া তোলাও দায় হল।‘ সুতরাং বাঙলার কৃষক নিঃস্বই থেকে গেল। এদিকে খাজনা আদায় পুরোদমে চলতে লাগল, এবং তার জন্য নিৰ্যাতনও বাড়তে লাগল। কিন্তু নিৰ্যাতনের পরেও আধা রাজস্ব আদায় হল না। এটা পূৰ্ববতী কয়েক বছরের খাজনা আদায়ের পরিমাণ থেকে বুঝতে পারা যাবে—
বৎসর দেয় রাজস্ব (পাউণ্ডে লিখিত) আদায়ীকৃত রাজস্ব
১৭৭২ ৯৯,৪১০ ৫৫,৯৩৭
১৭৭৩ ১০৩,০৮৯ ৬২,৩৬৫
১৭৭৪ ১০১,৭৯৯ ৫২,৫৩৩
১৭৭৫ ১০০,৯৮০ ৫৩,৯৯৭
১৭৭৬ ১১১,৪৮২ ৬৩,৩৫০
যেখানে উৎপন্ন শস্য হাটে নিয়ে গিয়ে বেচিতে গেলে, গাড়ীভাড়াই ওঠে না, সে ক্ষেত্রে নিঃস্ব কৃষক খাজনা দেবে কি করে? উপরে যে আদায়ীকৃত খাজনার’ পরিমাণ দেখানো হয়েছে, তা হচ্ছে নিৰ্যাতন-লব্ধ খাজনা। সুতরাং নিৰ্যাতনলন্ধ খাজনা সন্ন্যাসীরা লুঠ করতে লাগল। দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন, এই ছিল এদের ধর্ম। সন্ন্যাসীদের এরূপ সংগঠন ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের অনেক আগে থেকেই ছিল। এরূপ এক মঠাধ্যক্ষই রক্ষা করেছিল রানী ভবানীর বাল্যবিধবা, সুন্দরী কন্যা তারাসুন্দরীকে সিরাজের কুৎসিত কমলালসা থেকে।
সন্ন্যাসীদের একজন মঠাধ্যক্ষ কৃপানাথ এক বিরাট বাহিনী নিয়ে রংপুরের বিশাল বৈকুণ্ঠপুরের জঙ্গল অধিকার করেন। তাঁর ২২ জন সহকারী সেনাপতি ছিল। রংপুরের কালেকটর ম্যাকডোয়াল পরিচালিত বিরাট সৈন্যবাহিনী দ্বারা, জঙ্গল ঘেরাও হলে ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের খণ্ডযুদ্ধ হয়। বিদ্রোহিগণ বিপদ বুঝে নেপাল ও ভুটানের দিকে পালিয়ে যায়।
‘সন্ন্যাসী বিদ্রোহ’ নামে অভিহিত হলেও এতে ফকির সম্প্রদায়ও যোগ দিয়েছিল। সন্ন্যাসী বিদ্রোহে সক্রিয় অংশ গ্রহণের জন্য আরও যাঁরা প্ৰসিদ্ধ হয়ে। আছেন, তাঁদের মধ্যে আছেন ইমামবাড়ী শাহ, জয়রাম, জহুরী শাহ, দর্পদেব, বুদ্ধু শাহ, মজনু শাহ, মুসা শাহ, রামানন্দ গোঁসাই, ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরাণী ও সোভান আলি। (‘সন্ন্যাসী বিদ্রোহ’ অধ্যায় দ্রষ্টব্য)।
আট
কিন্তু ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের এই দুৰ্যোগের সময় ইংরেজরা ভারতে সাম্রাজ্য স্থাপনের স্বপ্নবিলাসে মত্ত হয়ে, দক্ষিণ ভারতের যুদ্ধসমূহে লিপ্ত হয়ে পড়ে। বস্তুত ১৭৭০ খ্রীস্টাব্দে বাঙলার আর্থিক সঙ্গতি নিয়দিকে এমনই স্তরে গিয়ে পৌঁছায় যে এক সমসাময়িক প্রতিবেদনে বলা হল-“the company seemed on the verge of ruin”। কিন্তু দেশের এই শোচনীয় অবস্থা হলেও, কোম্পানির কর্মচারীরা (তাদের ‘নবাব’ আখ্যা দেওয়া হত) স্বদেশে ফেরবার সময় প্রচুর অর্থ সঙ্গে করে নিয়ে যেত। এটা বিলাতের কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি এড়ালো না, এবং তারা বিলাতের শাসনতন্ত্রের সঙ্গে কোম্পানির সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণের জন্য পার্লামেণ্টে কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ আইন পাশ করলেন।
ইংরেজের প্রভুত্ব
পলাশী যুদ্ধের পরই মীরজাফর ক্লাইভের সঙ্গে দাউদপুরে দেখা করে। ১৭৫৭ খ্ৰীস্টাব্দের ২৯ জুন তারিখে ক্লাইভ, মীরজাফরকে নবাবের মসনদে বসান। এই সময় থেকেই ইংরেজরা বাঙলার প্রকৃত অধিপতি হয়ে দাঁড়ায়, যদিও শাসনভার নবাবের হাতেই থাকে।